সুপার টুয়েলভে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ভারতকে ১০ উইকেটে হারিয়ে আকাশে ওড়া শুরু করেছিল পাকিস্তান। এরপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ এক লড়াইয়ে জয়। পাকিস্তান আর মাটিতে নামেনি। আফগানিস্তান, নামিবিয়া আর স্কটল্যান্ডকে হারাতে খুব কষ্ট করতে হয়নি, অনায়াসেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত একমাত্র অপরাজিত দল হিসেবে সেমিফাইনালে খেলছেন বাবর আজম–মোহাম্মদ হাফিজ–শোয়েব মালিক–শাহিন শাহ আফ্রিদিরা।
‘আকাশে উড়তে থাকা’ পাকিস্তানের সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। এ ম্যাচ যে দলের ক্রিকেটারদের ‘পেট গুড়গুড়’ করাচ্ছে, সেটি আগেই জানিয়ে দিয়েছেন দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ তারকা শোয়েব মালিক। এ কথা বলার পর তিনি যতই বলেন, ‘এই ম্যাচ আর দশটা ম্যাচের মতোই’—তবু কথা থেকে যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলতে নামবে পাকিস্তান, আর তাদের পেট একটু ‘গুড়গুড়’ করবে না, এটা কীভাবে হয়!
অস্ট্রেলিয়া জয় দিয়েই শুরু করেছিল এবারের বিশ্বকাপ। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকার অল্প সংগ্রহের বিপক্ষে সে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ঘাম ঝরিয়েই জিততে হয়েছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তারা খেলেছে যাচ্ছেতাই এক ম্যাচ। ১২৫ রান গুটিয়ে গিয়ে সে ম্যাচে জস বাটলারের ব্যাটে উড়ে যেতে হয়। একটু ধীরে শুরু করা অস্ট্রেলিয়া অবশ্য এর পরের সব ম্যাচ জিতেই সেমিতে পা রেখেছে। শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ—বাকি তিনটি ম্যাচেই ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত ছিল তাদের। সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে তারা যদি এই ক্রমোন্নতির ধারাটা বজায় রাখে, তাহলে পাকিস্তানের জন্য বড় চিন্তাই।
নকআউট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তানের অতীত ইতিহাসও পাকিস্তানিদের চিন্তার কারণ হতে পারে। ১৯৯৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দারুণ ফর্মে থাকা ওয়াসিম আকরামের পাকিস্তান ফাইনালে গুটিয়ে গিয়েছিল ১৩২ রানে। অথচ গ্রুপ পর্বে স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় পেয়েছিল পাকিস্তান। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সাবেক ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতারও সে ম্যাচের স্মৃতি সামনে এনে বাবর–রিজওয়ানদের সাবধান করে দিয়েছেন। শোয়েব অবশ্য ১৯৯৬ ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্মৃতি উল্লেখ করেননি। গ্রুপ পর্বে প্রতিটি ম্যাচে জয় পাওয়া পাকিস্তান কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়ে হেরেছিল ভারতের কাছে। বেঙ্গালুরুর সেই ম্যাচে আগে বোলিং করা পাকিস্তান ম্যাচটা হেরেছিল ওয়াকার ইউনিসের শেষের দিকে করা দুটি ওভারেই। ওই দুই ওভারে ৪২ রান দিয়েছিলেন তিনি।
বড় টুর্নামেন্টে নকআউট রাউন্ডে গিয়ে পা হড়কানোর ইতিহাস পাকিস্তানের আছে বলেই বড় ভয় পাকিস্তানি ভক্তদের। তবে দলটা পাকিস্তান বলেই আবার আশাবাদটাও বড়ই। বড় টুর্নামেন্টে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে জিতে শিরোপার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার ইতিহাস পাকিস্তানের কম নেই। ১৯৯২ বিশ্বকাপের কথা বাদ দিন। গত ১২ বছরেও এমন ইতিহাস আছে। ২০০৯ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে কেউ গোনায় ধরতে চায়নি। কিন্তু তারাই সেবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়ে ফাইনালে উঠে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় তারা। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথাও এখানে আসবে। গ্রুপ পর্বে কে ভেবেছিল পাকিস্তান শিরোপা জিতবে, কিন্তু সেমিতে ইংল্যান্ডকে দারুণ খেলে হারিয়ে ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তারা তুলে নেয় অসাধারণ এক জয়।
এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তান আগেই নিজেদের সেরা খেলাটা খেলে ফেলেছে কি না, সে আলাপও উঠেছে। ভারত আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি বড় ম্যাচ জেতার পর পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ছিল সবই অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল। আফগানিস্তান কিছুটা পরীক্ষা নিলেও নামিবিয়া আর স্কটল্যান্ডকে হেসেখেলেই হারিয়েছে পাকিস্তান। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে ‘হালকা–পাতলা’ তিনটি ম্যাচ পাকিস্তান দলকে মানসিকভাবে কিছুটা আয়েশি জায়গায় নিয়ে গেছে কি না, সেই শঙ্কা থাকতেই পারে।
শিরোপা জিততে পাকিস্তানকে বিরাট দুটি বাধা পার হতে হবে। সেমিতে অস্ট্রেলিয়া, ফাইনালে উঠলে ইংল্যান্ড অথবা নিউজিল্যান্ড। শেষের দুটি দল তো বিশ্বকাপের সেরা দুটি দলই। তাই পাকিস্তানের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জই অপেক্ষা করে আছে।
তবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে দলটির মানসিকতা। গোটা বিশ্বকাপে পাকিস্তান দলের ‘সুখী পরিবার’ হয়ে থাকাটা বড় একটা শক্তি দলটির। বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ব্যাটিং করতে না পারার অনুযোগ যদি থাকে, তাহলে অভিজ্ঞ মোহাম্মদ হাফিজ, শোয়েব মালিক আর মারকুটে আসিফ আলীর ফর্ম সেমিতে বড় অস্ত্রই হবে পাকিস্তানের। সেই সঙ্গে শাহিন শাহ আফ্রিদির নেতৃত্বাধীন বোলিং আক্রমণ তো আছেই।
পা হড়কানোর ইতিহাস আছে পাকিস্তানের, থাকছে অননুমেয়তার তকমাও। কিন্তু তেড়েফুঁড়ে সবকিছু জিতে নেওয়ার সুন্দর অতীতই পাকিস্তানকে সবচেয়ে বড় ভরসাটা দিচ্ছে।