দারুণ চারটি দিন কাটাল বাংলাদেশ
দারুণ চারটি দিন কাটাল বাংলাদেশ

পারফরম্যান্সই বলে দিচ্ছে, এটা ‘ফ্লুক’ নয়

মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে আমাদের ছেলেরা গত চার দিন যা করেছে, কাল শেষ দিনে জয়ের জন্য আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু দরকার নেই। বাংলাদেশ সব মিলিয়ে খুবই ভালো ক্রিকেট খেলছে। ব্যাটিং, বোলিং—সব মিলিয়েই খুবই ভালো যাচ্ছে এ টেস্ট ম্যাচটা। আমাদের ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা এখন খুবই বেশি। আজ শেষ দিকের উইকেটগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বোলাররা যা করে যাচ্ছে, লাইন–লেংথ ধরে রাখা, এককথায় অসাধারণ। টেস্টের শেষ দিনেও এভাবেই বল করে যেতে হবে।

আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ এখন টেস্টে নিরাপদ অবস্থানে আছে, অর্থাৎ অন্তত ড্র তো হবেই। এখন আমাদের মৌলিক কাজগুলোই করে যেতে হবে—উইকেট পাওয়ার জন্য আক্রমণাত্মক মানসিকতা, লাইন-লেংথ ঠিক রেখে বল করা, বাজে রান না দেওয়া। কারণ, ওদের লিড কোনো কারণে বড় হয়ে গেলে তাড়া করার যথেষ্ট সময় থাকবে না। টেল-এন্ডারদের আউট করার জন্য আক্রমণাত্মক মানসিকতা ধরে রাখতে হবে। রস টেলরের উইকেটটা গুরুত্বপূর্ণ, তাকে তুলে নিতে পারলে সকাল সকালই ম্যাচ বের হয়ে যাবে। না হলে তার মতো ব্যাটসম্যান একটু ঝামেলা করবেই।

দারুণ এক স্পেল উপহার দিয়েছেন ইবাদত

এমন একটা উপলক্ষ সামনে রেখে আমি ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। ইতিহাসে ভালো-খারাপ থাকবেই। খুব কাছে গিয়ে মুলতানে পাকিস্তানের সঙ্গে, ফতুল্লায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছিলাম। হয়তো এ রকম কয়েকটা ম্যাচ আমরা জিততে পারতাম বা ড্র করতে পারতাম; কিন্তু সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। অর্জন থাকবে, হতাশাও থাকবে—এটাই তো খেলা! ইতিহাস ঘেঁটে তাই লাভ নেই।

এটা অস্বীকার করব না যে বাংলাদেশ এ টেস্টে এতটা ভালো খেলবে, সেটা আমি আশা করিনি। কারণ, বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। এটাকে তাই মুমিনুল হকের দলের অসাধারণ প্রত্যাবর্তনই বলব।

তাদের পারফরম্যান্সই বলে দিচ্ছে, এটা ‘ফ্লুক’ নয়। ম্যাচের প্রতিটি সেশনেই বাংলাদেশ ভালো খেলছে, আধিপত্য বজায় রাখছে। স্বাভাবিক খেলাটা খেললে কাল চা-বিরতির আগেই ম্যাচ বের হয়ে আসবে। খেলাটা যেহেতু ক্রিকেট, যেকোনো কিছুই হতে পারে, তবে যেভাবে ওরাও খেলেছে, তাতে কাজটা খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। পরের দুটি উইকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কাল জয়ের স্বপ্ন নিয়েই মাঠে নামবে বাংলাদেশ

ইবাদত, শরীফুল ও তাসকিন একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করল এ ম্যাচে—পেসাররাও বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতাতে সহায়তা করে। আমাদের দেশেও যে ভালো পেস বোলার হতে পারে, এটা তা–ই প্রমাণ করল। আমাদের দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিটা হচ্ছে, যারা মূলত আমাদের শক্তির জায়গা, ওয়ানডে বা এমন জায়গায় সফল—তাদের পেছনেই আমরা বিনিয়োগ করি, তাদের কাছেই ফল আশা করি। ফাস্ট বোলাররা সব সময়ই এখানে অবহেলিত। আশা করি এবার সেটা বদলাবে।

আবারও বলি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওদের মাটিতে টেস্ট জিতলে সেটা অসাধারণ এক অর্জন হবে। নিউজিল্যান্ডে গিয়ে টেস্টে অনেক ভালো দলই নাকানিচুবানি খেয়ে আসে। সেখানে বাংলাদেশের মতো দল যদি এমন একটা ম্যাচ জেতে, সেটা কোনো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়েও বড় পাওয়া হবে। হয়তো এই একটা টেস্ট জিতলেই আমাদের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা হয়ে যাবে না, কিন্তু মর্যাদার দিক দিয়ে বিশাল এক পাওয়া হবে। এমন তো নয় যে সকালে একটু সুবিধা পেয়ে বিকেলেই ম্যাচ জিতে গেছেন, জিততে হলে আপনাকে পাঁচ দিন ধরেই ভালো খেলতে হবে।

ক্যারিয়ারসেরা বোলিং ইবাদতের

আমি ভাগ্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, এ টেস্টে এখন পর্যন্ত আমরা সেই ভাগ্যের সহায়তা পাচ্ছি। টসটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা পরদিন আরও ভালো ব্যাটিং কন্ডিশন পেয়েছি। ফলাফল শেষ পর্যন্ত যা–ই হোক, এ টেস্ট আমাদের ভবিষ্যতের জন্য বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেবে। তরুণদেরও এটা একটা বার্তা দেবে—টেস্ট ম্যাচেও রান করা যায়, যদি আপনি বাড়তি চাপ না নেন, নিজেকে ছোট না ভাবেন।

বাংলাদেশে মেধার অভাব নেই। কিন্তু ক্রিকেটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সেভাবে হয়নি বলে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভুগি। মেধার পুরোটা কাজে লাগাতে পারি না। আমি মনে করি, এদিক দিয়ে ভারতের সমকক্ষ হওয়া উচিত আমাদের। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ বেশি ক্রিকেট ভালোবাসে, শতকরার হারে তাই হবে। আর ভারতে বিনোদনের আরও ক্ষেত্র আছে, পারফর্মার আছে। বাংলাদেশে তো ক্রিকেটটাকেই সবাই অনুসরণ করে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলের লোকজন, সচিব, কৃষক, রিকশাওয়ালা, সব শ্রেণি–পেশার মানুষ খেলাটা পছন্দ করে। এমন দেশে প্রক্রিয়াটা মানতে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। বাচ্চারা তো খেলতে চায়, প্রয়োজনীয় সুযোগ–সুবিধাটাই শুধু দরকার এখানে। সেটাও এমন কোনো কঠিন কিছু নয়। এক–দুই বছরের জন্য একটা কর্মপরিকল্পনা সাজানো দরকার। বিশেষজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ মানুষ দরকার।

দলকে ভালো অবস্থান এনে দিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা

অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানে শুধু মাঠ বা দালানকোঠা নয়। একটা বাচ্চা উপজেলা পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে পারবে—সেই পথটা তৈরি করে দিতে হবে। আঞ্চলিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া দরকার। স্কুলগুলোর গেম টিচারদেরও একটা ন্যূনতম প্রশিক্ষণ থাকা উচিত। সব প্রাইভেট সেক্টরেই এমন হয়, ক্রিকেটে কেন হবে না? উচ্চপর্যায়েও ফেডারেশন, বোর্ড আর মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় দরকার।

আর একটা কথা বলি, শেষ কিছুদিন কিন্তু খুব সমালোচনা হলো ক্রিকেটারদের। কাল যদি বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে যায়, তাহলে সামনের সারিতে দেখবেন সব ম্যানেজমেন্টের লোকজন। ‘এর জন্য এটা হয়েছে, ওর জন্য ওটা হয়েছে’, এসব বলাবলি শুরু হবে। এটাই সমস্যা আমাদের। বিশ্বকাপে যখন দল খারাপ খেলল, বলা হলো খেলোয়াড়েরা খারাপ খেলেছে। আর জিতলে বলা হবে ‘আমি এই করেছি, ওই করেছি।’ তাহলে দুই বছর ধরে করা হয়নি কেন? আমি সব সময় খেলোয়াড়দের পক্ষে। এ টেস্টেও অসাধারণ পারফরম্যান্স আমাদের সব খেলোয়াড়ের।

* লেখক: জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক।