এমন দিনে কী খেতে ইচ্ছা করে? চিরন্তন বাঙালি মন প্রথমেই খিচুড়ির কথা বলবে। সঙ্গে ইলিশ ভাজা হলে তো কথাই নেই। আর কষানো মাংসও যদি থাকে, তা হলে সোনায় সোহাগা। অথচ ওয়েলিংটনের বৃষ্টিমুখর আরেকটি দিনে আমি কিনা লাঞ্চ সারলাম পাস্তা, বিস্বাদ সেদ্ধ মুরগির মাংস আর কিছু লতাপাতা দিয়ে!
সেটিই দেখলাম বাংলাদেশের অন্য সাংবাদিকদের খুব পছন্দ হয়েছে। দোষটা আসলে আমারই। পাস্তা-নুডলস আমার দু চোখের বিষ। জীবনে যে কবার খেয়েছি, নিতান্তই আজকের মতো বাধ্য হয়ে। বাধ্যতামূলক সেই লাঞ্চটা মাঠেই হয়েছে। খেলা হচ্ছে না তাতে কী, মাঠে সাংবাদিকদের জন্য ঠিকই লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। সেটিতে সম্ভাব্য কী থাকতে পারে জেনে রাস্তার ওপারের মোটেলে থেকেও কাল মাঠমুখো হইনি।
আজ যেতে হলো উবারইটস্ কাজ করছে না বলে। উবারইটস্ মানে বাংলাদেশে ‘ফুড পান্ডা’ ও ‘হাংরি নাকি’র মতো ঘরে বসে পছন্দমতো খাবার পাওয়ার ব্যবস্থা। সার্ভিস খুব ভালো। সুবেশী, স্মার্ট ছেলেমেয়ে ঝকঝকে গাড়ি চালিয়ে অর্ডার করা খাবার নিয়ে একেবারে সময়মতো রুমের দরজায় টোকা দেয়। কাল দুপুরে-রাতে উবারইটসের মাধ্যমেই ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়েছে। আজও সেরকমই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি, তা নিতে আপত্তি জানাচ্ছেন ‘জনাব’।
খুব দ্রুতই বুঝতে পারলাম, সমস্যাটা উবারইটসের নয়। এখানে উবারের গাড়িতে চড়তে যান বা উবারইটসে খাবার অর্ডার—নগদ টাকার কোনো কারবার নেই। সব লেনদেন ক্রেডিট কার্ডে। এখানে আসার আগে যা জানা ছিল না। সমস্যাটা হয়েছে সেখানেই। জালিয়াতি থেকে সুরক্ষার জন্য দেশের বাইরে আসার আগে ক্রেডিট কার্ডে সর্বোচ্চ লেনদেনের একটা সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়ে আসাই নিরাপদ। হোটেল বিল আর প্লেন বা বাসে দূরপাল্লার যাত্রা ছাড়া ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করব না সিদ্ধান্ত থেকে যে সংখ্যাটা নির্দিষ্ট করে দিয়ে এসেছিলাম, উবার আর উবারইটসের কল্যাণে সেটি দ্রুতই শেষ হয়ে গেছে।
এ কারণে রাস্তা পেরিয়ে মাঠে যেতেই হলো। আরেকটা কারণও অবশ্য ছিল। বৃষ্টি তখন একটু ধরে এসেছে। জেগেছে খেলা হওয়ার ক্ষীণ একটা সম্ভাবনাও। মোটেলের বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখছি, ঘোমটা খুলে বের করে আনা হয়েছে উইকেট। শেষ পর্যন্ত সেই সম্ভাবনা যে বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে, সেটি তো আপনি এরই মধ্যে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন।
এখানে একটা সংশোধনী দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি। লেখার শুরুতে ‘বৃষ্টিমুখর দিন’ লিখেছি, একটু আগে লিখলাম খেলা হওয়ার সম্ভাবনা ‘বৃষ্টিতে ধুয়ে’ যাওয়ার কথা। এ থেকে আপনার যা মনে হওয়া স্বাভাবিক, ওয়েলিংটনের বৃষ্টিটা মোটেই সেরকম নয়। একটু ছ্যাঁচড়া টাইপ বৃষ্টি। ঝমঝমিয়ে নামার কোনো ব্যাপার নেই। বেশির ভাগ সময় সেটি এমন মিহি দানায় ঝরে পড়ে যে, খালি চোখে ঠিকমতো দেখাই যায় না। সকাল থেকে দুবার যেমন বৃষ্টি থেমে গেছে ভেবে বাইরে বেরিয়ে টের পেয়েছি, উনি প্রায় অদৃশ্য চেহারায় ঠিকই ঝরে চলেছেন। বাংলায় এই বৃষ্টির একটা সুন্দর নাম আছে—ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি (ধেৎ, আবার ইলিশ মাছের কথা মনে হয়ে গেল!)। তবে এটির যে ধরন, তাতে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বললে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়ে যায়। বড়জোর বলা যায় ‘জাটকাগুঁড়ি’!
বৃষ্টি মাঝেমধ্যেই একটু দম দিচ্ছে, হঠাৎ খেলা শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও তাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দিনের খেলা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাই কোথাও ঘুরতে যেতেও পারছি না। আজ আম্পায়াররা যখন সেই ঘোষণা দিলেন, ততক্ষণে কোথাও গিয়ে কিছু খোলা পাওয়ার আর সুযোগ নেই। একমাত্র যাওয়া যেত প্রাকৃতিক কোনো দর্শনীয় জায়গায়। ওয়েলিংটনে তা যথেষ্টই আছে।
কিন্তু এই বৃষ্টিতে আর বেরোতে ইচ্ছা করল না। আর উবার সংক্রান্ত জটিলতার কথা তো আগেই বলেছি। রিসেপশনে বললেই ট্যাক্সি ডেকে দেবে। কিন্তু প্রথম কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা থেকে এখন ট্যাক্সি দেখলেই ভয় করে। ট্যাক্সিতে উঠলেই মিটার প্রায় আলোর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করে। উবারের ভাড়াটা তুলনামূলক সহনীয়। ট্যাক্সিতে করে অনির্দিষ্ট কোনো জায়গা ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করাটা তাই একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। দুপুরে মাঠ থেকে এক চক্কর দিয়ে আসার আগে-পরে তাই রুমেই বন্দী। মাঝেমধ্যে একটু বারান্দায় গিয়ে মাঠে উঁকি দিই। ডানে তাকালে সুন্দর একটা পাহাড় চোখে পড়ে। কখনো বা সেটির সঙ্গে কথা বলি।
কিন্তু একতরফা কথাবার্তা আর কতক্ষণ চালানো যায়! ল্যাপটপ খুলে তাই নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের পুরোনো ট্যুরগুলোতে এসে যা লিখেছিলাম, সেগুলো পড়তে শুরু করলাম। অকারণে নয়, একটা উদ্দেশ্য ছিল। সেটি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবেন। স্মৃতি থেকে যা মনে করতে পারছিলাম, ঘটনা তো আসলেই তাই। ২০০১ সালে নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম ট্যুরের অনেক কিছুই তো দেখি এই ওয়েলিংটন টেস্টের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এতটাই যে, প্রায় দেড় যুগ আগের ম্যাচ রিপোর্টের হেডিংগুলোই অনায়াসে আজ আবার দিয়ে দেওয়া যায়!
২০০১ সালের ট্যুরে বাংলাদেশ দুটিই টেস্ট খেলেছিল। সেই দুটি আবার এই হ্যামিল্টন আর ওয়েলিংটনেই। ২০০১ সালের ২৮ ডিসেম্বরের প্রথম আলোতে ওয়েলিংটন টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া রিপোর্টের হেডিং কী ছিল, জানেন? ‘ওয়েলিংটন টেস্ট এখন বৃষ্টির কৃপাপ্রার্থী’। কালকের পত্রিকার রিপোর্টের জন্যও তো এই হেডিংটাই সবচেয়ে উপযুক্ত। ইতিহাস তাহলে সত্যি সত্যিই ফিরে ফিরে আসে!
সতেরো বছর আগের ওয়েলিংটন টেস্টের অবস্থা অবশ্য এত খারাপ ছিল না। সেটি ছিল বক্সিং ডে টেস্ট। বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল প্রথম দিনেও। এসব দেশে যা না মেলাটা খুবই অস্বাভাবিক। সেই অস্বাভাবিক ব্যাপারটিই ঘটেছিল সেবার। হয়তো আগের দিন প্রতিশ্রুতিমতো আসতে না পারার অপরাধবোধ থেকেই টেস্টের দ্বিতীয় দিনে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বৃষ্টি। যা একটা বলও হতে দেয়নি। তৃতীয় দিনও বৃষ্টির কারণে দুপুর ১টার আগে শুরু হতে পারেনি খেলা। বাংলাদেশ অবশ্য তারপরও চতুর্থ দিন সকালেই হারতে সক্ষম হয়েছিল।
এবার ওয়েলিংটন টেস্টের যে অবস্থা, সেবার ঠিক এটাই হয়েছিল হ্যামিল্টন টেস্টে। আশ্চর্যই বলতে হবে, সেই টেস্ট নিয়ে প্রথম লেখার হেডিংটাও কালকের পত্রিকার জন্য খুব উপযুক্ত হয়। সেটি কী? ‘বৃষ্টির কারণে হ্যামিল্টন টেস্ট এখন তিনদিনের ম্যাচ।’ শুধু হ্যামিল্টনের জায়গায় শুধু ‘ওয়েলিংটন’ বসিয়ে দিলেই তো হয়। হ্যামিল্টনে প্রথম দুদিন প্রায় টানা বৃষ্টির পর টস হয়েছিল তৃতীয় দিন সকালে। এখানেও যা মিলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
টেস্টের দ্বিতীয় দিনে গিয়ে প্রথম লেখা কেন? কারণ ২০০১ সালের সেই হ্যামিল্টন টেস্টের প্রথম দিনটি পড়েছিল ঈদের ছুটির মধ্যে। বাংলাদেশ দলের হয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার সেটিই প্রথম ট্যুর। সবকিছু এখনো পরিষ্কার মনে আছে তাঁর। ডানেডিনে শেষ ওয়ানডের আগের দিন বিকেলে হোটেল রুমের ব্যালকনিতে বসে সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে অনেক কিছু নিয়েই হাসিতে ভেঙে পড়ছিলেন। এর মধ্যে একটা হলো, ঈদের দিন সকালে বাড়িতে ফোন করে ‘তোমরা সবাই খিচুড়ি খাচ্ছ’ বলে হাবিবুল বাশারের হাউমাউ কান্না।
‘হাউমাউ’টা আমার ধারণা, হাবিবুলের সঙ্গে খুনসুটির অংশ হিসাবে বলা। হাবিবুল কেঁদেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই কার্ডফোনের যুগে হাউমাউ করে কান্নার সুযোগই তো ছিল না। দেশে কথা বলার জন্য বাইরে লাইন দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে থাকত না! সেই ট্যুরে নিজের একটা বোকামির কথা বলেও খুব হেসেছিলেন মাশরাফি। ওয়েলিংটন থেকে দেশে ফেরার আগে পাঞ্জাবি কেনার জন্য হন্যে হয়ে দোকানে দোকানে ঘোরার কথা মনে করে বলছিলেন, ‘তখন কেমন বোকা ছিলাম, একবার ভাবেন!’
মাশরাফির কথাটা তুললাম খালেদ মাসুদ যে পুরোপুরি এর বিপরীত, এই কথাটা বলব বলে। সেই ট্যুরে হ্যামিল্টনেই টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে তাঁর অভিষেক। অথচ তাঁর নাকি কিছুই মনে নেই! প্রায়ই একই রকম শহর, একই হোটেল—তারপরও নভোটেল তানুই হোটেলের লবিতে বসে খালেদ মাসুদ যখন বলছেন, ‘বিশ্বাস করেন, আমার কিছু্ই মনে পড়ছে না’; প্রথমে ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি করছেন। পরে বুঝলাম, ঘটনা তা নয়। মাঠে গিয়েও কিছু মনে না পড়ার পর মাসুদকে ‘গোল্ডফিশের বংশধর’ বলে মানতেই হলো।
ওয়েলিংটনে এসে অবশ্য সেটি একটু মোলায়েম করে বলার প্রয়োজন পড়ছে। বেসিন রিজার্ভে পা রেখেই নাকি তাঁর মনে পড়ে গেছে যে, এখানে একটা টেস্ট খেলেছিলেন। মজার একটা খেলাই হচ্ছে এই সুযোগে। আমি বিভিন্ন ট্যুর আর বিভিন্ন ম্যাচের কথা স্মৃতি থেকে বলে যাই, আর খালেদ মাসুদ হা করে থাকেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, তাঁর নিজের ক্যারিয়ারের অনেক কিছুও তিনি ভুলে বসে আছেন।
আমার আবার উল্টো সমস্যা। ইদানীং দেখছি, একেবারে সাম্প্রতিক অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি, কিন্তু অনেক পুরোনো দিনের কথাও ঠিকই বলে দিতে পারছি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট আর বৃষ্টি নিয়ে লিখতে লিখতেই যেমন কৌতুককর একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ২০০৮ সালের অক্টোবরে মিরপুরে টেস্ট ম্যাচ। এখানে তো এখন পর্যন্ত প্রথম দুই দিন, সেই টেস্টের প্রথম তিন দিনই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বৃষ্টি। চতুর্থ দিন খেলা শুরু হওয়ার পর নিউজিল্যান্ড ৬ উইকেটে ২৬২ রান করে ডিক্লেয়ার করে দিল। তারপরও কী আর রেজাল্ট হওয়া সম্ভব!
নিজেরা ব্যাটিং করতে নেমে সেটিকে প্রায় সম্ভবের রূপ দিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। ড্যানিয়েল ভেট্টোরি বোলিং করতে এসে প্রথম ওভারেই তিন উইকেট নিয়ে নিলেন। বাংলাদেশ দিন শেষ করল ৩ উইকেটে ১৩ রানে! ফলো অনের শঙ্কা তখন চোখ রাঙাচ্ছে। দিনশেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে যা শুনে সে সময়ের বাংলাদেশ অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল যেন আকাশ থেকে পড়লেন। নিউজিল্যান্ড ২৬২ করেছে, বাংলাদেশ কি ৬২ রানে অলআউট হয়ে যাবে নাকি! তাহলেই না ফলো অনের প্রশ্ন আসবে। আশরাফুলের জানাই ছিল না, ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে গেলে ফলো অনের নিয়মও বদলে যায়। পাঁচ দিনের টেস্টের জন্য যা ২০০ রান, চার ও তিন দিনের জন্য সেটিই ১৫০। টেস্ট দুই দিনে নেমে এলে তখন প্রথম ইনিংসে ১০০ রান এগিয়ে থাকলেই প্রতিপক্ষকে ফলো অন করানো যায়।
স্মৃতি, স্মৃতি, স্মৃতি...পাগলা হাওয়ার বাদল দিনেই কি তা আরও বেশি জড়িয়ে ধরে!
আরও পড়ুন: