ঋষভ পন্তের ভক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ভারতীয় উইকেটকিপারকে নিয়ে জাতীয় দলের কোচ রবি শাস্ত্রী নিজেই স্তুতিগাথা গেয়েছেন। এই মারকুটে ব্যাটসম্যান নাকি এর মধ্যেই যা করেছেন, তা করার স্বপ্ন দেখেন সব উইকেটকিপার। উত্তর প্রদেশের ২৩ বছর বয়সী এই কিপারের ভয়ডরহীন ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ না হয়ে অবশ্য উপায় নেই। যেকোনো উইকেটে, যেকোনো বোলিং আক্রমণের বিপক্ষেই সাহসী ব্যাটিং করেন নিজের একটি ব্র্যান্ডই গড়ে তুলেছেন পন্ত। প্রতি–আক্রমণই তাঁর একমাত্র মন্ত্র যেন।
শুধু নিজের কোচই নন, সঞ্জয় মাঞ্জরেকারের মতো সন্দেহবাতিককেও প্রশংসা করতে বাধ্য করেছেন পন্ত। সৌরভ গাঙ্গুলী, কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তরা তো আছেনই। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হক। পাকিস্তানের সাবেক প্রধান নির্বাচককে পন্ত বীরেন্দর শেবাগের কথা মনে করিয়ে দেন। তাঁর চোখে পন্ত যেন শেবাগই, শুধু বাঁ হাতে ব্যাট করছেন—এই যা। সদ্য সমাপ্ত ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ নিয়ে মতামত জানাতে গিয়ে ভারতের তরুণ ক্রিকেটারদের প্রশংসায় ভাসিয়েছেন ইনজামাম। আর সবচেয়ে বেশি প্রশংসা জুটেছে পন্তের কপালে।
পাকিস্তানের আরও অনেক সাবেক ক্রিকেটারের মতোই ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন ইনজামাম। সেখানে নিয়মিতই ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করেন, বিশেষজ্ঞ মতামত দেন। আর ক্রিকেটারদের নাম ভুলভাবে বলে হাসির খোরাক জোগান। এই যেমন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের সিরিজ জয় আর টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠা নিয়েই নতুন ভিডিও দিয়েছেন ইউটিউবে, সেখানে ঋষভ পন্তকে বারবার ‘রাশি’ বলেই ডেকেছেন। নামের উচ্চারণ নিয়ে আরও কাজ করতে হলেও পন্তের স্তুতিবাক্যে কোনো খামতি নেই ইনজামামের, ‘ঋষভ পন্ত, একদম দুর্দান্ত। বহুদিন পর কোনো খেলোয়াড় দেখলাম, যার ওপর চাপ কোনো প্রভাব ফেলে না। ১৪৬ রানে ৬ উইকেট পড়ে গেলেও সেভাবে ইনিংস শুরু করে, সেটা কেউ করে না। সে তার শট খেলে। উইকেট কেমন কিংবা অন্য দল কত রান কত করেছে, তা নিয়ে ভাবে না। সে স্পিন ও পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে সমান ভালো। ওর খেলা আমি পুরোপুরি উপভোগ করেছি। মনে হচ্ছিল শেবাগ বাঁ হাতে ব্যাট করছে।’
শেবাগের বিদায়ের পর যা টেস্ট থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা ফিরিয়ে এনেছেন পন্ত। আর সেটা হলো কোন সংস্করণে খেলছেন, সেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল নিজের মতো করে খেলা। গত অক্টোবরেও বাড়তি ওজনের কারণে ভারত জাতীয় দলে ঢোকা প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল যাঁর, সেই পন্ত এখন জাতীয় নায়ক। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টানা দুই টেস্টে দুর্দান্ত দুই ইনিংস খেলেছেন। আহমেদাবাদ স্রোতের বিপক্ষে গিয়ে ১১৫ বলে তুলে নিয়েছেন সেঞ্চুরি। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের পর মাত্র দ্বিতীয় উইকেটকিপার হিসেবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মাটিতে সেঞ্চুরি আছে পন্তের। মিডল অর্ডারের শেষ ভাগে নেমে গিলক্রিস্টের মতোই ম্যাচের রূপ বদলে দিচ্ছেন পন্ত। যখনই প্রতিপক্ষ ভাবছে, এখনই ম্যাচে ফেরার সুযোগ, তখনই পাল্টা–আক্রমণ করছেন পন্ত। যে কাজটা একমাত্র উইকেটকিপার হিসেবে গিলক্রিস্টকে করতে দেখা যেত।
ইনজামাম অবশ্য শুধু উইকেটকিপারদের গণ্ডিতেই আটকে রাখতে রাজি হচ্ছেন না; ব্যাটিংয়ের ধরন, মানসিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় শেবাগের সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছেন, ‘আমি শেবাগের সঙ্গে খেলেছি এবং শেবাগও অন্য সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাত না। সে যখন ব্যাট করত, উইকেট কেমন আচরণ করছে কিংবা প্রতিপক্ষের বোলিং কেমন—এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। সে তার নিজের মতো শট খেলত, ফিল্ডাররা সীমানায় থাকলেও গা করত না। শেবাগের পর আরেকজনকে দেখছি, যার কাছে অন্য সবকিছু গুরুত্ব হারায়।’
শুধু ভারতের মাটিতেই যে আক্রমণাত্মক খেলছেন তা নয়, পন্ত অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডে এমন আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে সাফল্য পেয়েছেন। ব্রিসবেন টেস্টে ম্যাচ জেতানো ৮৯ রানের আগে সিডনির পঞ্চম দিনের উইকেটে তাঁর ঝোড়ো ৯৭ রানই ভারতকে অবিশ্বাস্য এক জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। ইনজামামের চোখে এমন ব্যাটসম্যান খুব কমই আসে ক্রিকেটে, ‘আমি বেশ আগ থেকেই খেয়াল করেছি, সে ভারতেই এমন করছে না; সে অস্ট্রেলিয়াতেও তাই করেছে। সে বেশি সেঞ্চুরি পায় না, কারণ সে নিজের গতিতে খেলে। বহুদিন পর এমন কাউকে দেখলাম। ভারতের শচীন, দ্রাবিড় ছিল...এখন তাদের বিরাট আর রোহিত আছে। কিন্তু পন্ত যেভাবে খেলে, এটা দুর্দান্ত। ওর মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, সেটা চমকে দেওয়ার মতো। ক্রিকেটে এমন খেলোয়াড় আগে দেখিনি।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টেই যেমন, ভারত ম্যাচটা হেরেছিল। সে ম্যাচে ভারতকে ইনিংসে হারানোর সুযোগ পেয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু এই পন্তের কারণেই সে সাহস দেখাতে রাজি হননি ইংলিশ অধিনায়ক জো রুট। ম্যাচ শেষে জানিয়েছিলেন, ভারতের লাইনআপে পন্তের মতো একজনকে এক সেশন ব্যাটিং করার সুযোগ দিলে ইনিংসে ম্যাচ জেতা তো দূর, বরং ম্যাচ হারার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, তাই ভারতকে আর ফলোঅন করাননি রুট। ম্যাচ হারলেও তখনই বোঝা গিয়েছিল, পন্তকে এখন কতটা সমীহ করে প্রতিপক্ষ!
ওদিকে সঞ্জয় মাঞ্জরেকার পন্তকে অন্য উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন। হিন্দুস্তান টাইমসের কলামে বলেছেন, ঘরের মাঠে ভারতের জয় তাঁকে আর টানে না। তবু পন্ত যেভাবে খেলেছেন, তাতে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর ধারণা, ভারতের অন্য ব্যাটসম্যানদের চেয়ে পন্ত আলাদা। কারণ, দেশটির সবার মধ্যে সেঞ্চুরি করার একটা অসুস্থ চেষ্টা দেখা যায়। সেদিক থেকে পন্ত সেঞ্চুরির কথা ভুলে নিজের মতো খেলতে থাকেন। আর তাঁর এই ধরন দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের নিজেদের খেলা খেলতে সাহায্য করছে।
কলামে আরও বলেছেন পন্তের কারণে, টেস্ট ক্রিকেটের পরিচিত ব্যাটিং ধরনটাই বদলে যেতে পারে, ‘দুই মাসেরও কম সময়ে পন্ত অসাধারণ দুটি টেস্ট ইনিংস খেলে ফেলল। এটা অসাধারণ এক কীর্তি। বিশেষ করে অনেক দারুণ ক্রিকেটারই পুরো ক্যারিয়ার সত্যিকারের ভালো টেস্ট পারফরম্যান্স ছাড়া কাটিয়ে দেন। পন্তের কারণে ক্রিকেট বিশ্ব টেস্ট ব্যাটিংয়ের দিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাতে বাধ্য হচ্ছে। দ্বিতীয় নতুন বলে জিমি অ্যান্ডারসনের বলে সে রিভার্স ল্যাপ খেলেছে। সেটাও আবার একই বোলারের আগের বলেই এগিয়ে এসে মাথার ওপর দিয়ে মারার পর। সবই ৯০-এ থাকার সময়। এরপর ঠিক বীরেন্দর শেবাগ যেমন করত, ছক্কা মেরে ঘরের মাঠে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি পেল।’