‘ক্রিকেটের বিশ্বযুদ্ধে এক বাংলার আলোর ঝলক, অন্য বাংলা অন্ধকারে।’ লিখেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। বাংলাদেশের ১১ বাঙালি যখন বিশ্বকাপের আসর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের একজনও কেন নেই ভারতীয় একাদশে! সৌরভ গাঙ্গুলীর বিদায়ের পর কেন একজনও নেই পশ্চিম বাংলার, যাঁকে অন্তত জাতীয় দলের জন্য ভাবা যেতে পারত! কেন এমন হচ্ছে, আনন্দবাজার পত্রিকায় কৃশানু মজুমদার তা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। ওই লেখায় কবি জয় গোস্বামীর উক্তি, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জেদ, তারুণ্য, তেজ, সাহস, সবটাই অবাক করে। এপার বাংলায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেটা দেখা যায় না।’
কৃশানু বলছেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, হারুক বা জিতুক, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা মাঠে অন্য এক খিদে অনুভব করেন। অসম্ভবকে সম্ভব করার এক প্রবল তাগিদ বারবার ফুটে বেরোতে দেখা যাচ্ছে সাকিব, মাশরাফি, তামিম, মুশফিকদের। সেই মানসিক তেজ কি এপার বাংলার খেলোয়াড়দের মধ্যে কম?’ সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী বলছেন, ‘(ভারতের) বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের চেহারা বিভিন্ন। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে কর্মক্ষমতার বিভিন্নতা দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ তেমনটা নয়। সেখানকার তরুণদের ভিন্ন চেহারার ও তুলনামূলকভাবে বেশি কর্মক্ষম প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়তে হয় না।’
কথাটার অন্য একটা মানে আছে। বাঙালিরা শারীরিকভাবে ছোটখাটো, কম বলশালী। যোদ্ধা জাতি হিসেবে বাঙালির কোনো ঐতিহাসিক সুনাম নেই।
সে কারণে ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা পিছিয়ে পড়ছে।
কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিরাও তো ভাতই খায়। বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা যখন অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়ান, তখন উচ্চতা ও স্বাস্থ্যের তারতম্য খুবই চোখে পড়ে। কিন্তু খেলা কেবল লম্বা-চওড়া মানুষদের ব্যাপার নয়। তা যদি হতো, মেসি কিংবা ম্যারাডোনা ফুটবলে পৃথিবীসেরা হতেন না, শচীন টেন্ডুলকার হতেন না বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান। অনুশীলন, প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা, দূরদর্শিতা, অবকাঠামোর সঙ্গে প্রতিভা যোগ হলে যেকোনো বিষয়েই ভালো করা যায়। আর জয়ের জন্য লাগে জিগীষা! জয় করার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা।
ক্রিকেট কেবল শারীরিক খেলা নয়, মনেরও খেলা। বোলার আর ব্যাটসম্যান দ্বৈরথ হতে থাকে, কে কার ওপরে চড়াও হতে পারে। ফিল্ডিংয়ে লাগে অতন্দ্র মনঃসংযোগ। বাঙালির কাছে এসব ব্যাপারে বেশি প্রত্যাশা করা বোধ হয় বাড়াবাড়ি হবে। আমরা সবাই কবিতা লিখি, কারণ তাতে পরিশ্রম কম হয়, আমাদের উপন্যাস হয় ৬০ পৃষ্ঠার। আমাদের ধৈর্য কম।
তবু মাশরাফি বাহিনী লড়ে যাচ্ছে। হারাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। অতীতে ক্রিকেট বিশ্বকাপে হারিয়েছে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ভারত, নিউজিল্যান্ডের মতো দলকে। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে পশ্চিম বাংলার সাবেক অধিনায়ক লক্ষ্মীর উক্তি, ‘বাংলাদেশ একটা দেশ। পশ্চিমবঙ্গ একটা রাজ্য। এভাবে তো তুলনা হয় না।’
আসলে বাংলাদেশ যে ভালো করছে, তার কারণ নবীন এবং তারুণ্যপ্রধান এই দেশটা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। তা যেমন ক্রিকেটে, যেমন মেয়েদের ফুটবলে, তেমনি অর্থনীতিতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে। ক্রিকেটের বিশ্বদরবারে যে ১১ বাঙালি দাপট দেখাচ্ছেন, তার কারণ যুদ্ধজয়ী একটা স্বাধীন দেশের নাছোড় বিজয়-আকাঙ্ক্ষা।
এই বিজয়-আকাঙ্ক্ষার তীব্র স্রোতকে যদি ঠিক চ্যানেলে প্রবাহিত করা যায়, তা আমাদের দেবে আলো, দেবে শক্তি। দেশনায়কদের কাছে আমাদের সেইটাই চাওয়া।
আর খেলার অধিনায়কের কাছে চাওয়া, হারার আগে হারবেন না। শেষ বল পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে। খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই, কিন্তু নামতে হবে জয়ের জন্য। বিজয় মহান, কিন্তু বিজয়ের জন্য সংগ্রাম মহত্তর।