করোনাদিনের ডায়েরি

নয়তো রাতে ঘুম আসবে না

>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অণুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এইসময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো-
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। ছবি: প্রথম আলো

সময়টা আমার ভালোই যাচ্ছে। সব স্বাভাবিক থাকলে হয়তো ঢাকায় কর্মব্যস্ত জীবন পার করতাম। সেটা যেহেতু হচ্ছে না, চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করার। বিষণ্ন থাকার চেয়ে যেই সময়টা পাচ্ছি, সেটার ভালো ব্যবহার করছি।

আমি ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই ঢাকায় খেলা শুরু করি। পেশাদার ক্রিকেটে দীর্ঘ ক্যারিয়ারের পর ক্রিকেট কোচিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ৪৬ বছর বয়স হয়ে গেল। এতদিনে আমার মা কে ঠিকমতো সময় দিতে পারিনি। দুই মাস হয়ে গেল আমি রাজশাহীতে। মায়ের সঙ্গে লম্বা সময় কাটাচ্ছি অনেক দিন পর। আগে হয়তো দুই দিনের জন্য আসা হতো। সবার সঙ্গে দেখা করে আবার ঢাকায় ফিরতাম। এখন সেই ব্যস্ততা না থাকায় সবার সঙ্গেই আবার ওঠাবসা হচ্ছে।

একটু চিন্তা করে দেখলাম, আমরা কর্মব্যস্ততায় এতই ডুবে ছিলাম যে আমরা অনেকেই নিজেদের শেকড় ভুলতে বসেছিলাম। আমরা অর্থ, সম্মান, খ্যাতির পেছনে ছুটতে ছুটতে ভুলে গিয়েছি আসলে কোনটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাস এসে আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ পরিবারের কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিল। সুযোগ করে দিল পরিবারের আরও কাছে আসার। এই সময়ে আপনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। ভালো লাগার জিনিস গুলো আপনি করতে পারছেন না। কিন্তু এর মধ্যেও অনেক খুঁটিনাটি ভালো লাগার ব্যাপার আছে যা আগে হয়তো উপভোগ করতেন, কিন্তু কর্মব্যস্ততায় ভুলে বসে আছেন। এখন সেই ভালো লাগাগুলো জাগিয়ে তুলতে পারেন।

আমি যেমন দিনটা আমি তিন ভাগে ভাগ করে নেই। সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত আমার রাজশাহীর একাডেমিতে কাজ করি। দুই মাস হয়ে গেল একাডেমি বন্ধ। অন্যান্য সময় অনেক ব্যস্ত থাকে একাডেমিটা। একাডেমির মাঠটা অতিব্যবহারে নষ্ট হয়ে যায় যায় অবস্থা। সবুজ ঘাস গুলো কেমন জানি ধূসর হয়ে যায়। সকাল থেকেই একাডেমির মাঠে পানি দেওয়া শুরু করি। রোজার মাস দেখে গ্রাউন্ডসম্যানদের বিশ্রাম দিয়েছি। এক বেলা কাজ করেই তাঁরা চলে যায়। নিয়মিত পানি দিয়ে মাঠ পুরো সবুজ করে ফেলেছি। একরকম গ্রাউন্ডসম্যান হয়ে গিয়েছি বলা যায়। একাডেমিতে কাজ করলে নিজের দৈনিক ব্যায়ামটাও হয়ে যায়। সময় তো কাটাতে হবে। ক্লান্ত হতে হবে কিছু একটা করে। নয়তো রাতে ঘুম আসবে না। তাই একাডেমির যত্ন নিচ্ছি।


১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকি করোনার সাহায্য তহবিল নিয়ে। আমাদের রাজশাহীর ১০-১২ জন সাবেক ক্রিকেটার ও ঢাকার বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে আমরা একটা ফান্ড তৈরি করেছি। আমরা চেষ্টা করছি করোনার সময় রাজশাহীতে আগে যেকোনো পর্যায়ে খেলা ক্রিকেটারদের সাহায্য করতে। কেউ কেউ হয়তো ভালো অবস্থানে নেই। কিন্তু সাহায্য চাইতে পারছে না। তাদের সাহায্য করছি প্রতিনিয়ত। প্রথমে ক্রিকেটার দিয়ে শুরু করলেও এখন অন্যান্য খেলার সাবেক খেলোয়াড়দেরও সাহায্য করার চেষ্টা করছি। সেটা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ব্যস্ত থাকি।

বিকেল বেলাটা বেশ আয়োজন করে ঘুড়ি উড়ানো হয়। নিয়মিত এটা করা হচ্ছে। শুরুর দিকে আমি একাই ঘুড়ি ওড়াতাম। এখন বিকেল হওয়া মানেই পুরো এলাকার প্রতিটি ছাদে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা লাগে। বিকেল হলেও সব ছাদের ওপর। চারপাশে ঘুড়ি আর ঘুড়ি। পরিবারের সবাই ওই সময়টা ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে আসে। করোনার শুরুর দিকে এলাকার ছেলেদের দেখতাম এখানে সেখানে আড্ডা মারত। কারণ এলাকায় তরুণেরা তো ঘরে থাকতে অভ্যস্ত না। ওরা দেখা যেত ঠিকই বের হতো আর পুলিশ তাদের তাড়িয়ে বেড়াত। এখন তারাও বিকেল বেলাটা বাইরে না কাটিয়ে ছাদে ঘুড়ি উড়িয়ে কাটাচ্ছে। চিত্তবিনোদনও হয়ে গেল। কিছু সময়ও কাটল।

আমি খুব চেষ্টা করি বিষণ্নতা এড়িয়ে চলতে। অখুশি হলে হবে না। হয়তো এই ছয় মাস খারাপ যাচ্ছে। তাতে কী হয়েছে। আশপাশে কত মানুষ আমার চেয়েও বাজে অবস্থায় আছে। সব সময় ইতিবাচক মানসিকতা লালন করতে হবে। নিজের মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখ হবে। আপনার তো সুস্থ থাকতে হবে। রাতে ঘুমোতে হবে। সে জন্য আপনাকে দিনে কাজ করে ক্লান্ত হতে হবে। অনেকে শুনছি সারা রাত জেগে থাকছে। ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঘুম আসছে না। ফেসবুক ব্যবহার করে, সিনেমা দেখে সময় পার করছে। এভাবে কয়দিন আর! তাই নিজেকে যতটা গুছিয়ে নেওয়া যায় সেই চেষ্টা করছি।

ক্রিকেটে দেখবেন খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা সবার আগে চিন্তা করা হয়। একটু বৃষ্টি হলে আউটফিল্ড ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আম্পায়াররা খেলা শুরু করেন না। খেলোয়াড়দের যদি কোনো চোট লাগে সেই চিন্তা সবার মাথায় থাকে। করোনাভাইরাসের সংকটেও খেলা হচ্ছে না, এটাই স্বাভাবিক। যারা ভালো ক্রিকেটার, খেয়াল করে দেখবেন তাঁরা করোনা শেষে ঠিকই নিজেদের খেলার সঙ্গে মানিয়ে নেবেন। ভালো ক্রিকেটাররা সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। এই সময় অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু ভালো ব্যবসায়ীরা দেখবেন ঠিকই টিকে যাবে। অনেকেই ব্যবসা হারাবে। অনেকে দেখবেন শূন্য থেকে শুরু করে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে। হার মানবে না। ঠিকই কষ্ট করে নিজেদের দাঁড় করাবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম।