হাসিটা অসাধারণ। চাহনিটাও কী নিষ্পাপ! অথচ তিনিই কিনা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের বুকে ধরান কাঁপন; ‘ঘাতক’ হয়ে কেড়ে নেন জয়ের স্বপ্ন! তিনি তাসকিন আহমেদ। বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ে যদি বাংলাদেশের প্রাপ্তি হন সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, তবে বোলিংয়ে তাসকিন।
অভিষেকেই আলো ছড়িয়েছিলেন। গত বছর জুনে ফুটবল বিশ্বকাপের ডামাডোলে মিরপুরে ভারতের বিপক্ষে নিয়েছিলেন ২৮ রানে ৫ উইকেট। তাসকিনের তোপেই সেদিন ভারত গুটিয়ে গিয়েছিল মাত্র ১০৫ রানে। যে ম্যাচটা হতে পারত স্মরণযোগ্য কিংবা তাসকিনময়; সেটি কিনা বাংলাদেশ ভুলে যেতে পারলেই বাঁচে! বাংলাদেশ যে অলআউট হয়েছিল মাত্র ৫৮ রানে!
অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে তারও আগে। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন অ্যারন ফিঞ্চ-ডেভিড ওয়ার্নারদের। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে অভিষেক নিয়ে তাই তাসকিনের খানিকটা আফসোস, ‘ভাগ্য খারাপ! ভালো বল করেছি কিন্তু দল জিততে পারেনি।’ সেই আফসোসটা এবার অনেকটা ফুরিয়েছে। তাসকিন নিয়মিত উইকেট পেয়েছেন, দলও জিতেছে। ৬ ম্যাচে পেয়েছেন ৯ উইকেট। বিশ্বকাপের আগে আভাস দিয়েছিলেন, ‘চেষ্টা করব সর্বোচ্চ ১০ উইকেটশিকারির মধ্যে থাকতে।’ সেটা হয়নি। তবে এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়েছেন ঠিকই।
তবে বিশ্বকাপে ব্যক্তিগত সাফল্যে এখনই তৃপ্ত হতে চান না ১৯ বছর বয়সী এ পেসার। বললেন, ‘আমরা বিশ্বাস, যতটুকু পেরেছি এর চেয়ে বেশি করতে পারতাম। তবে ৯ উইকেট পেয়েছি, তার জন্য খুশি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে। জীবনের প্রথম বিশ্বকাপেই কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে পেরেছি বলে আরও বেশি খুশি।’
২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ায় খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাসকিনের। সেখানকার উইকেট সম্পর্কে প্রথম ধারণাটা পেয়েছেন তখনই। তাসকিন ভালো করেই জানতেন, অস্ট্রেলিয়ার উইকেটের আচরণ। তবে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বিশ্বকাপ শুরুর আগের ১২ দিনের অভিজ্ঞতার কথাই জানালেন, ‘বিশ্বকাপের আগে যে ১২ দিন অনুশীলন করেছিলাম, সেটা খুবই কাজে দিয়েছে। আসলে আমরা সবাই খুব ভালো ক্রিকেট খেলেছি। দলে সবার অবদান ভালো ছিল। কেউ একক সাফল্য পায়নি। সবাই ভালো খেলেছে। ব্যাটিং-বোলিংয়ে সবাই ব্যক্তিগত অবদান রাখার চেষ্টা করেছে।’
বিশ্বকাপে ৯ উইকেটের মধ্যে প্রতিটিই মূল্যবান। তবে এর মধ্যে সেরা মানেন ইংল্যান্ডের জস বাটলারের উইকেটটি। কেন? তাসকিন বললেন, ‘আসলে ওই মুহূর্তে উইকেটটা খুব দরকার ছিল। কারণ, সেট হয়ে গিয়েছিল বাটলার। উইকেটটা তুলে না নিতে পারলে জয়টা কঠিন হয়ে যেত।’ নিঃসন্দেহে তাসকিনের চোখে বাংলাদেশের সেরা ম্যাচ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিই। ওই ম্যাচে যে খুলে গিয়েছিল স্বপ্নের দরজা।
উইকেট পেলেও কয়েকটি ম্যাচে ছিলেন বেশ খরচে। বিশেষ করে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের বিপক্ষে বেশি রান দিয়ে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বললেন, ‘আসলে কিছু ম্যাচে ব্যাটের কানাই লেগে বেশ কয়েকটি চার রান হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে ৩ উইকেট নিলেও ‘‘এজ’’ হয়ে চারটা বাউন্ডারি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বোলারের কিছুই করার থাকে না।’
আদর্শ মানেন মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। প্রতি ম্যাচের আগেই ভীষণ উৎসাহ পেয়েছেন অধিনায়কের কাছ থেকে। কৃতজ্ঞতা ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘মাশরাফি ভাই খেলোয়াড় হিসেবে যেমন ভালো, মানুষ হিসেবেও। তিনি সবাইকে উৎসাহিত করেছেন। বিশেষ করে জুনিয়রদের তাদের রুমে ডেকে অনেক কিছু বুঝিয়েছেন। মাঠে-মাঠের বাইরে সবাইকে উৎসাহিত করেছেন নানাভাবে।’ কথা প্রসঙ্গে উঠল ভারতের বিপক্ষে মাশরাফির সঙ্গে তাঁর অসাধারণ উদ্যাপনটা নিয়ে। এমন উদ্যাপন নিয়ে কি কোনো পরিকল্পনা ছিল? ট্রেডমার্ক হাসি দিয়ে বললেন, ‘আসলে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা থেকে হয়েছে। পরিকল্পনা করে নয়।’
সামনের দিনগুলো নিয়ে ভাবনা প্রসঙ্গে জানালেন, কেবল পথের শুরু, এগোতে চান আরও। স্বপ্নাতুর চোখে বললেন, ‘বিশ্বে নাম্বার ওয়ান ফাস্ট বোলার হতে চাই। বড় বড় টুর্নামেন্ট খেলতে চাই।’ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালের আনন্দেই সীমাবদ্ধ থাকতে চান না। প্রত্যয়ী কণ্ঠে জানালেন নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়েও, ‘আমরা বিশ্বকাপে ভালো ক্রিকেট খেলেছি। তবে আরও ভালো করতে সক্ষম। ভবিষ্যতে সেটাই করে দেখাব ইনশা আল্লাহ।’
আরও পড়ুন: