নিজের নাম লেখা বিশ্বকাপ জার্সির খোঁজে

এবার আর হলুদ কিংবা আকাশি-সাদা জার্সির জন্য কাড়াকাড়ি নয়। লাল-সবুজে ভরে যাবে হাটমাঠ-পথঘাট-ক্যাম্পাস। বাংলাদেশ দলের টুয়েলভথ ম্যান তো সমর্থকেরাই! এর জন্য জার্সিও তো চাই। পিঠে আবার লেখাতে হবে নিজের নাম, না হলে মন যে ভরে না। সেই নামের সঙ্গে দিতে হবে নম্বর। কেউ দেবে ৭৫, কেউ ২, কেউ ২৮।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আছে সেই জার্সিতে নিজের নামটি লিখিয়ে নেওয়ার সুযোগ। এখানকার জার্সির বাজার ‘টুইন টাওয়ার’ মার্কেট। যার আরেক নাম সমবায় মার্কেট। মার্কেটের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শুধু জার্সি আর জার্সি। দেশ বা দল তো বটেই, এলাকাভিত্তিক দল বা টুর্নামেন্টের জার্সি বানাতেও এখানেই আসে অনেকে। জার্সিতে মনমতো নাম, নকশা আর নম্বর বসানোর পাইকারি বাজারও এটি।

মার্কেটটি নির্মাণাধীন। এর মধ্যেই সিঁড়িতে সিঁড়িতে বসেছে স্ক্রিন প্রিন্টের দোকান। এখানে জার্সিতে নাম লেখানো হয়। জার্সির কেনাকাটার মতো এইখানে ধুম নেই খুব বেশি, তবে নাম লেখাতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন এক-একজন। আর দোকানিদের হাতেও আছে বেশ কাজ।

ডাইস দিয়ে রং বসানো চলছে জার্সিতে। ছবি: প্রথম আলো

টুইন টাওয়ারে জার্সিতে নাম লেখাতে খরচ হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মার্কেটের দোকানিরা নাম লেখাতে নেন ৩০০। ওই দোকানিরাও আসলে শেষ পর্যন্ত টুইন টাওয়ারে এসে করিয়ে নেন কাজ। বাকিটা তাদের মুনাফা। জার্সির নাম লেখানো কারবারেও মধ্যস্বত্বভোগী আছে, কে জানত!

সুদূর চট্টগ্রাম থেকে ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া টুইন টাওয়ারে এসেছেন জার্সিতে নাম লেখাতে। বললেন, ‘আমার ছেলে আয়ান বয়স ছয় বছর। আগের বিশ্বকাপে ও খুব ছোট ছিল, এখন খেলাটা খুব বোঝে। তাই ওর নামে একটি জার্সি বানাতে এসেছি, ঈদের উপহার।’ ইকবালের পরিবারের সবাই জার্সি পরেন। কারণ? ‘খেলার দিন ভাই, ভাইপো, বন্ধু সবাই মিলে এক জার্সিতে আসলে যে অনুভূতিটা তৈরি হয়, তা অতুলনীয়’—বললেন তিনি।

বিশ্বকাপের জার্সি পাওয়া যাবে শুধু নির্দিষ্ট কিছু দোকান ও বিক্রেতার কাছে, দাম ১১৫০ টাকা—এই নির্দেশনাকে কাঁচকলা দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ হয়ে গিয়েছে জার্সির খুচরা ও পাইকারি বাজার। স্টেডিয়ামের দোকানগুলোতে বাংলাদেশের ফাঁকে-ফোকরে আছে অন্যান্য দেশের জার্সি। আমজনতার ফুটপাথ পুরোটাই বাংলাদেশের দখলে।

প্রতিদিন প্রচুর জার্সিতে নাম লেখানো হচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর ফুটপাথের দোকানি মো. জসীম বলেন, ‘প্রতিদিন ঊর্ধ্বে ১০০টি নিম্নে ৮০টি করে জার্সি বিক্রি তার। দাম তিন থেকে পাঁচ শ।’

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দোকানগুলোয় জার্সির দাম পাঁচ শ থেকে হাজার টাকা। সেই জার্সি কিনে নিচ্ছেন অনেকেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ক্রেতা বলেন, ‘জার্সি মাত্র কয়েক দিন পরা হবে, সে হিসেবে অফিশিয়াল জার্সির দামটা একটু চড়াই। তাই এই বাজারে আসা। এখানে জার্সির দাম যুক্তিসংগত।’ অনেকেই বললেন, অফিশিয়াল জার্সির দাম ও মানের সঙ্গে বিস্তর ফারাক দেখছেন। পল্টনের একজন পিন্টু হোসেন যেমন বলছিলেন, ‘আমরা খেলা পাগল। বিশ্বকাপ মানেই আমাদের কাছে জার্সি। ফুটবল বিশ্বকাপে আমরা দলবেঁধে জার্সি কিনি। ফলে অরিজিনাল রেপ্লিকা জার্সি বলে আমাদের হাতে বাজে মানের কিছু গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না, আমরা ঠিকই বুঝি।’

পছন্দের জার্সিতে নাম লেখানো এখন ভীষণ জনপ্রিয়। ছবি: প্রথম আলো

এ কারণেই আইন মানা হচ্ছে নাকি ভাঙা হচ্ছে—এসব বেশি পাত্তা পাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর বাজারে আছে অনেক মানের জার্সি। একজন দোকানি এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা বলেন, ‘আমাদের কাছে পাঁচ শ থেকে আট শ টাকার মধ্যে জার্সি আছে। এ ছাড়া আমাদের কাছে দেড় শ টাকার মানের জার্সিও আছে।’

আয়ানের জার্সিটা অফিশিয়াল ফ্র্যাঞ্চাইজির থেকে কেনা বলেই জানালেন ইকবাল। কিন্তু মানে খুব পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। ইকবাল অভিযোগ করেন, ‘বেশি দামিটাই কিনলাম।’ বড়-ছোট সব সাইজের একই দামটা ঠিক নয় বলেও মত দেন তিনি।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জার্সি কেনার হিড়িক পড়েছে। ছবি: প্রথম আলো

আয়ানের জার্সিতে নামটা লিখে দিচ্ছিলেন মদিনা স্ক্রিন প্রিন্টের মালিক মো. হ‌ুমায়ূন কবীর। ছয়তলার ওপরে ছোট্ট একটা দোকান। প্রায় আট বছর বয়স থেকে জার্সি রাঙানোর কাজ করা হ‌ুমায়ূন বলেন, ‘এই মার্কেটে মোট ২৩টি দোকান আছে যারা জার্সিতে নাম বসাই। বিশ্বকাপ ২০১৯ এসেছে থেকে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৫০ পর্যন্ত জার্সিতে নাম লেখাচ্ছি। সবাই মিলে সংখ্যা খুব কম না।’

কথার ফাঁকে ফাঁকে ডাইস দিয়ে রং বসানো চলে আয়ানের জার্সিতে। এই জার্সি যাবে চট্টগ্রামে আয়ানের কাছে। সেই জার্সি পরেই আয়ান আজ দেখবে বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা। বাংলাদেশে বসে আয়ানের মতো হাজারো সমর্থকের সেই শুভ কামনা পৌঁছে যাবে ওভালে বাংলাদেশ দলের কাছে। জার্সি আসল হোক কিংবা নকল, আবেগটা কিন্তু খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি।