অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টি ম্যাচ জয়ের অন্যতম নায়ক আফিফ হোসেন
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টি ম্যাচ জয়ের অন্যতম নায়ক আফিফ হোসেন

সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি

নিজেকে চিনে ফেলেছেন আফিফ

খেলার বাইরে অন্য সবকিছুতেই তাঁর কেমন যেন নির্লিপ্ততা। মাঠে সেটাই অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিচ্ছে ২১ বছর বয়সী আফিফ হোসেনকে।

আবেগের স্পর্শ থেকে দূরেই থাকতে চান আফিফ

চাপ, ভয়, শঙ্কা, আনন্দ, তৃপ্তি, উল্লাস—কত আবেগ–অনুভূতির মধ্য দিয়েই না যেতে হয় ক্রিকেটারদের! সে আবেগ নিয়ন্ত্রণের ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতা। কিন্তু আফিফ হোসেনকে এ–জাতীয় আবেগ–অনুভূতি যেন একটু কমই প্রভাবিত করে। নিশ্ছিদ্র এক অদৃশ্য বলয় যে সব আবেগের স্পর্শ থেকে দূরে রাখে তাঁকে। সেখানে শুধু আফিফেরই বসবাস।

জিম্বাবুয়ে সফরের পর অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও ব্যাট হাতে নিজেকে চেনাচ্ছেন আফিফ। তবে ব্যাটিংয়ে হাত আর চোখের দুর্দান্ত সমন্বয় নয়, মাঠে আফিফের প্রথম প্রতিরক্ষার প্রথম বাঁধ ওই ইস্পাতকঠিন মানসিকতা। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে যে ৭ ওয়ানডে আর ২০টি টি–টোয়েন্টি খেলা আফিফকেই সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলা হচ্ছে, তার একটা বড় কারণ কিন্তু ওটাও।

আফিফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগের ক্রিকেটার। শব্দের চেয়ে ‘ইমোজি’তেই তাঁর বেশি ভাব আদান–প্রদানের অভ্যাস। কথা খুব বেশি বলেন না। আজকাল ক্রিকেটাররা ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক স্টোরিতে নিজের অনেক কিছুই ভক্তদের জানালেও তিনি যেন ঠিক তার উল্টো। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আফিফ খেলা না থাকলে ব্যস্ত থাকেন পড়াশোনা আর ফিফা গেমস নিয়ে। বাংলাদেশ জাতীয় দলে ক্রিকেটারদের ফিফা প্রতিযোগিতায় তিনিই চ্যাম্পিয়ন। বন্ধুবান্ধবের ভিড় আফিফের অপছন্দ। খেলা–পড়াশোনা না থাকার দিনগুলোয় নিজের মতো করেই নিভৃতে কাটিয়ে দেন সন্ধ্যা। অনুশীলন শেষে বাড়ি ফেরার পথে আফিফ একদিন বলছিলেন, ‘এই যে অনুশীলন করলাম। বাসায় যাব। বিশ্রাম নিয়ে কিছুক্ষণ ফিফা খেলেই দেব ঘুম।’

বন্ধুবান্ধবের ভিড়ই পছন্দ নয় আফিফের

অথচ আফিফ এমনই এক যুগের ক্রিকেটার, যখন একটি কাভার ড্রাইভ মারলেই ফেসবুকে খুলে যায় ১০-১২টি ফ্যানক্লাব। সেই ড্রাইভের ভিডিও দেখা হয়, শেয়ার হয় লাখ লাখবার। প্রশংসার স্রোতে ভাসতে থাকেন ক্রিকেটাররা। উল্টোটাও ঘটে অবশ্য। একটিমাত্র বাজে শট বা ক্যাচ মিসই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন ক্রিকেটারকে বানিয়ে দিতে পারে জাতীয় ভিলেন। ট্রলে ট্রলে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে তাঁর। দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে যখন দিন দিন এই চাপও বড় হয়ে উঠছে, টিকে থাকার জন্য তখন ক্রিকেটীয় দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োজন মানসিক দৃঢ়তারও। আফিফের মধ্যে সেটি ভালোভাবেই আছে বলে মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত। খেলার বাইরে আর সবকিছুতেই নিজের নির্লিপ্ত স্বভাব নিয়ে আফিফ সেদিন বলেছিলেন, ‘আমার মধ্যে তেমন আবেগ-টাবেগ নেই। খেলা কখনো ভালো হবে, কখনো খারাপ হবে। এত মাতামাতিতে কান দিয়ে কী হবে!’

বিখ্যাত মনোবিদ প্যাডি আপটন ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ছিলেন ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের মানসিকভাবে চাঙা রাখার দায়িত্বে। তাঁর একটা পর্যবেক্ষণ—যে ক্রিকেটার নিজেকে চিনতে দেরি করেন, তাঁর সাফল্যের ধারাবাহিকতাও আসে দেরিতে। কেউ নিজেকে চিনে ফেলেন ২১-২২ বছর বয়সেই। কারও লেগে যায় ২৯-৩০ বছর। আপটনের সেই তত্ত্বে ২১ বছর বয়সী আফিফ ‘লেটার’ নম্বরই পাবেন। তা না হলে এই বয়সেই নিজের সামর্থ্যে এতটা আত্মবিশ্বাসী হন কী করে!

অস্ট্রেলিয়া সিরিজে পরপর দুই দিন আফিফকে খেলতে হয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার মিচেল স্টার্ককে। আফিফ এই দুই ম্যাচে দারুণ বিস্ময়ই উপহার দিয়েছেন তাঁকে। দুই ম্যাচেই কাভার দিয়ে চোখধাঁধানো দুটি চার মেরে স্টার্কের দিকে আফিফ যে দৃষ্টিতে তাকালেন, তার অনুবাদ হতে পারে একটাই—মিচেল স্টার্ককে এত ভয়ের কী আছে!

আগামী দিনের ভরসা হয়ে উঠছেন আফিফ

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ১৭ বলে ২৩ রান করে স্টার্কের বলে বোল্ড হয়ে যান আফিফ। বাংলাদেশ জিতলেও ম্যাচ শেষে এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছিলেন তিনি। শেষ বলটা চার মারতে পারলে বাংলাদেশের রানটা একটু বাড়ত। আফিফ অতৃপ্তিটা মেটালেন দ্বিতীয় ম্যাচে। জস হ্যাজেলউডকে চার মেরেই এদিন জয় নিশ্চিত করেন বাংলাদেশের। আফিফের গোপন আবেগটাও কি তখন একটু বেরিয়ে এল!

জয় নিশ্চিত করা শটটি খেলার পর কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন আফিফ বেরিয়ে এলেন নিজের বলয় থেকে। বাতাসে ঘুষি মারতে গিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘ইয়েস’! একটু পরই চেহারা–চাহনিতে আবার সেই নির্লিপ্ততা। ম্যাচসেরার পুরস্কার নিতে এসে যেটা বললেন, সেটাতে তো মনে হলো একটু আগে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে তেমন কিছুই ঘটেনি, ‘তরুণ হই আর যা–ই হই, দলকে তো জেতাতে হবে। এটাই আমার কাজ।’

আফিফ যেন এ কাজই করে যেতে পারেন ম্যাচের পর ম্যাচ।