আজ কে? না, শুধু ‘কে’ দিয়ে হবে না। গত বিশ্বকাপ ফুটবল দেখিয়েছে লিওনেল মেসি একা কোনো শক্তি নন। আশপাশের যন্ত্রগুলো সচল না থাকলে তিনিও অনেকটা অচল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিদ্যুৎ গতিও বার্নাদো সিলভা-জোয়াও মুতিনিওদের প্রভাবেই তাড়িত। প্রশ্নটা তাই হওয়া উচিত, ‘আজ কে কে?’
ক্রিকেটের রসায়ন ফুটবলের সঙ্গে মেলে না। ফুটবল ১১ জনের সঙ্গে ১১ জনের লড়াই। ক্রিকেটে ১১ জনের সঙ্গে লড়াইটা শুরু করেন দুজন। এরপর একজন একজন করে প্রত্যেকে। তবু দুটোই শেষ পর্যন্ত ‘টিম গেম’। লড়াইয়ে জিততে সবাইকেই কিছু না কিছু করতে হয়। কেউ উইকেট পাবে, কেউ রান করবে, কেউ দারুণ একটা ক্যাচ নেবে। যে এসবের কিছুই করতে পারবে না, সে প্রয়োজনে উইকেটের আশপাশ থেকে এমন এক-দুটি শব্দ উচ্চারণ করে দেবে, যেটা কানে গেলে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের পিত্তি জ্বলে যাবে। তিরিক্ষি মেজাজ তখন তাকে দিয়ে ভুল করাবে, ক্যাচ ওঠাবে। নাম হবে বোলার-ফিল্ডারের। কিন্তু নিজেদের আড্ডায় ঠিকই কোনো খেলোয়াড় হেসে উঠে বলবেন, ‘তুই যদি ওই সময় ব্যাটাকে ওইভাবে রাগিয়ে না দিতি...হা হা হা!’
এই হলো ক্রিকেট। সাফল্য-ব্যর্থতায় কম-বেশি অবদান সবার। নাম-দুর্নাম দু-চারজনের। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর মুশফিকুর রহিম এ কথাটাই বলেছিলেন। তাঁর সেঞ্চুরির যেমন গুরুত্ব আছে; শেষ দিকে যে মিরাজ ১৫ রান করলেন, মোস্তাফিজের ব্যাট থেকে ১০ রান এল-বাংলাদেশের জয়ে সেগুলোরও অনেক অবদান।
এই দেখুন, ‘কে বা কারা’ খোঁজার আলোচনায় কি করে মুশফিকের নামটাই আগে চলে এল! আসলে আমিরাতের এশিয়া কাপটা মুশফিক খেলছেনই এমন রাজকীয় ঢঙে যে, ভালো কিছু আশা করতে গেলে তাঁর ছবিটাই ভেসে উঠবে সবার আগে। সুপার ফোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় দেখিয়েছে, ব্যাটিংয়ে ১৪৪ রানের একটা জুটিই সব নয়। ম্যাচ তবু পিছলে যেতে পারে বোলার-ফিল্ডারদের হাত হয়ে। মাশরাফির বিচক্ষণ নেতৃত্ব আর মিরাজ-মোস্তাফিজের বোলিং জাদুরও দরকার আছে। কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে ঠিকই মুশফিক, জয়ী বাংলাদেশের ক্যানভাসের নিউক্লিয়াস। প্রশ্নটা তাই মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়ই। মুশফিকের ব্যাটে আজ ফাইনালেও কি জ্বলবে আলো?
কিংবা ইমরুল কায়েস নতুন কোনো চমক দেখাবেন না তো! আমিরাত এশিয়া কাপের সবচেয়ে বড় দুটি চমকেই তো আছেন এই বাঁহাতি! প্রথম চমক, তাঁকে আর সৌম্যকে হুট করে মরুর দেশে উড়িয়ে নেওয়া। দ্বিতীয় চমক, দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তির মধ্যেই জীবনে প্রথমবারের মতো ছয় নম্বরে নেমে আফগানদের বিপক্ষে ৭২ রানে অপরাজিত থাকা। ম্যাচের মাত্র আধা ঘণ্টা আগে ইমরুল জানতে পারেলন ছয় নম্বরে খেলবেন। অথচ ব্যাট হাতে থাকলেন কতই না সাবলীল! দুবাইয়ের ফাইনালে আজ তিনিও আবার দ্যুতি ছড়ালে অবাক হওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঝলমলে আবির্ভাবের পর চোট-আঘাতের কারণে চুপসে গিয়েছিল মোস্তাফিজের পারফরম্যান্স। শুরুতেই অতি ভালো খেলে ফেললে যে সমস্যাটা হয়, প্রত্যাশার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল তাঁর তরুণ কাঁধ। মোস্তাফিজ বল হাতে নিলেই উইকেট পড়ে, এটাকে নিয়ম ধরে নিয়েছিলেন সবাই। তিনি যখন তা পারেন না তখন হা-হুতাশ-আহা! ছেলেটা কত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে!
এশিয়া কাপ যেন শুরুরও মোস্তাফিজকে ফিরিয়ে আনল আবার। সেই মায়াবী কাটার, উইকেট পাওয়ার আনন্দে সেই শিশুসুলভ হাততালি। লিটন ক্যাচ না ফেললে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়ে মাঠ ছাড়তেন মোস্তাফিজ। ওই ম্যাচের চার উইকেটসহ টুর্নামেন্টে এই বাঁহাতি পেসারের শিকার এখন পর্যন্ত ৮ উইকেট। আছেন সর্বোচ্চ ১০ উইকেট পাওয়া রশিদ খানের পরই। মোস্তাফিজ যেন বলছেন, ‘ফাইনালে আমার ওপর থেকে চোখ সরিও না।’
মাহমুদউল্লাহ, মিঠুন বা মিরাজের কথা কি ভুলে যাচ্ছেন? মুশফিক-মোস্তাফিজ যদি একক আলোয় আলোকিত হয়ে থাকেন, সেই আলোর দীপ্তি বাড়িয়ে দেওয়া পার্শ্বনায়ক এঁরা। মুশফিকের সঙ্গে দুবার ষাটোর্ধ্ব সংগতে দুটি শতাধিক রানের জুটির অংশীদার মিঠুন। দুটি জুটিই ভাঙাচোরা ইনিংস মেরামত করে বাংলাদেশকে দেখিয়েছে জয়ের দিগন্ত। গ্রুপ পর্বে আফগান বোলারদের কচুকাটা করায় ইমরুলের সঙ্গী মাহমুদউল্লাহ। মিরাজ তো সব সময়ই তুরুপের তাস। বল হাতে ব্রেক থ্রু, ব্যাট হাতে চকিতে কিছু রান এনে দেওয়া মিরাজের ওপর অধিনায়ক মাশরাফির নির্ভরতা সব সময়ই।
এই তো, মাশরাফিও চলে এলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ‘আইকন’। তাঁর সঙ্গে কি আর দলের দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক! সাফল্যের প্রতি সেন্টিমিটারে ছাপ রেখে যায় মাশরাফির নি-ক্যাপে বাঁধা হাঁটু, চোটের সঙ্গে নিত্য লড়াইয়ে ক্লান্ত শরীর। মোস্তাফিজ, মুশফিকদের ভালো খেলার দিনেও শোনা যায়, ‘মাশরাফি ভাই-ই তো আমাকে বলেছিলেন...।’
এটুকু পড়ে নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত সবাই। মনে হতে পারে ফাইনাল বুঝি শুধু নায়ক খোঁজারই দিন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ হেরেই দেখুক না আজ। মধ্যরাতে ফেসবুক ভরে যাবে অসংখ্য ‘ভিলেনে’। ক্রিকেটটাকে দয়া করে একটু বড় চোখে দেখুন। দেখবেন, পরাজয়েও আছে আশার আলো। ট্র্যাজেডিরও তো নায়ক থাকে!
আরও পড়ুন: