ক্রিকেটে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম—নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম
ক্রিকেটে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম—নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম

নাতি–নাতনির কাছে গল্প করতেই পারেন ইশান্ত শর্মা

বিশ্বের বৃহত্তম স্টেডিয়ামের নাম নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। যা উদ্বোধন করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখানে ক্রিকেট কোথায়? পুরোই রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার!

নরেন্দ্র মোদি অবশ্য একসময় গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাতেও নিশ্চিতভাবে রাজনীতির যোগসূত্র ছিল। তখনই নাকি মোদি স্বপ্ন দেখেছিলেন, আহমেদাবাদে একদিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে সেই স্টেডিয়াম উদ্বোধন করানোটাও কি মোদির স্বপ্নের তালিকায় ছিল? মনে হয় না। মোদি যখন গুজরাট ক্রিকেটের দায়িত্বে, ট্রাম্প তো তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টই হননি। মোদি তো আর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করাননি, করিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে দিয়ে। পুরোটাই রাজনীতি।

আমরা তাই এ থেকে বরং দূরেই থাকি। খেলায় ফিরি, মানে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে। টিভিতে দেখেই এমন মুগ্ধ যে ‘অবশ্যই দ্রষ্টব্য’ তালিকায় ঢুকে গেছে এই স্টেডিয়াম। মনে হচ্ছে, দর্শকে পূর্ণ এই স্টেডিয়ামে একটা খেলা না দেখতে পারলে জীবনই বৃথা। ৯০ হাজার দর্শকের মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড, মানে এমসিজিতে খেলা দেখেছি। তা যে রকম শিহরণ জাগানো অনুভূতি হয়ে আছে, ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শকে ভরা এনএমএসে (নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের সংক্ষিপ্ত রূপ করলাম আরকি!) খেলা দেখতে না জানি কেমন লাগবে! তার ওপর আবার উপমহাদেশীয় দর্শক! যাদের পাঁচ হাজারই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার দশ হাজারের সমান আওয়াজ তোলার ক্ষমতা রাখে।

মোদি এই স্টেডিয়ামের স্বপ্নদ্রষ্টা হতে পারেন, স্টেডিয়ামটা তাঁর নামে হতে পারে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এর উদ্বোধক হতে পারেন; কিন্তু এই মাঠে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটা তো সবচেয়ে বেশি মনে রাখবেন অন্য একজন।

সেই একজন, ইশান্ত শর্মা বুড়ো বয়সে নাতি–নাতনির সঙ্গে গল্প করতেই পারেন, ‘জানিস, আমার শততম টেস্ট উপলক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম বানানো হয়েছিল।’

গল্পটা এখানেই শেষ হবে না। ইশান্ত আরও বলবেন, ‘তোদের তো বিশ্বাস হতে চাইবে না, আমার অভিষেক টেস্টেও কিন্তু একই ঘটনা। আমি প্রথম টেস্টও খেলতে নেমেছিলাম নতুন একটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।’

ক্যারিয়ারের শততম টেস্টে ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দের কাছ থেকে স্মারক উপহার নিচ্ছেন ইশান্ত শর্মা

প্রথম কথার দাবিটা না হয় উড়িয়েই দিলেন, দ্বিতীয়টা কিন্তু সত্যি। ইশান্ত শর্মার টেস্ট অভিষেক আর মিরপুর শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের টেস্ট অভিষেক আসলেই একই দিনে। ২০০৭ সালের ২৫ মে।

শততম টেস্ট খেলতে নেমেই বিরাট এক কীর্তি গড়ে ফেলেছেন। ভারতের পক্ষে এর আগে মাত্র একজনই পেসারই যা খেলতে পেরেছেন। তাঁর নাম কপিল দেব। পুরো উপমহাদেশ বিবেচনায় নিলেও আর একটা নামই যোগ হয়। ওয়াসিম আকরাম।

বাকি দুজনের সঙ্গে ব্যতিক্রম হয়ে ইশান্তের ক্ষেত্রে প্রভাত একদমই দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়নি। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১৩ ওভার বোলিং করে একটা মাত্র উইকেট। ম্যাচের একমাত্র অভিষিক্ত ক্রিকেটার প্রায় অদৃশ্য হয়ে থাকলেও ঘটনার ঘনঘটায় তা ছিল রীতিমতো নাটকীয় এক টেস্ট ম্যাচ। নাটকীয় তো ইশান্তের টেস্ট অভিষেকটাও। চোটে পড়ে ছিটকে গেছেন মুনাফ প্যাটেল। তাঁর বিকল্প হিসেবে কাকে উড়িয়ে আনা হচ্ছে, তা নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের মধ্যে তুমুল জল্পনাকল্পনা। বিশেষ করে কলকাতার সাংবাদিকেরা খুব উত্তেজিত। কড়া নাড়তে থাকা বাংলার পেসার অশোক দিন্দার জন্য টেস্টের দরজা মনে হয় এবার খুলছে। শেষ পর্যন্ত তা আর খোলেনি, পাশের আরেক দরজা ভেঙে ঢুকে গেলেন ইশান্ত শর্মা। লম্বায় ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি, লিকলিকে শরীর...দেখলেই ‘তালপাতার সেপাই’ কথাটা মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে যায়।

বোলিংয়েও তেমন কিছু চোখে পড়েনি, চেহারা-ছবিও ইম্প্রেসিভ নয়...সেদিন কল্পনাও করিনি, আজ মাঠে বসে যাঁর অভিষেক দেখছি, ১৪ বছর পর টিভিতে তাঁর শততম টেস্ট দেখব। ঘটনাচক্রে যা পরিণত হবে উদ্‌যাপনের এক বিশাল উপলক্ষে।

২০০৭ মিরপুর টেস্টে অভিষিক্ত ইশান্ত শর্মা অ্যাকশনে

এত দিন পর মিরপুরের সেই টেস্টে ফিরে যাওয়ার একমাত্র কারণ তো অবশ্যই ইশান্ত শর্মা। তবে ওই টেস্ট ম্যাচটা কিন্তু বারবার ফিরে দেখার মতোই। কত কারণেই না তা স্মরণীয়! চলুন, একটা তালিকা করে ফেলি:

১. মিরপুরে প্রথম টেস্ট
২. অধিনায়ক হিসেবে হাবিবুল বাশারের শেষ টেস্ট
৩. বাংলাদেশের কোচ হিসেবে ডেভ হোয়াটমোরের শেষ টেস্ট
মাঠেও তো কত ঘটনা...
* ভারতের প্রথম চার ব্যাটসম্যানেরই সেঞ্চুরি।
* চার ব্যাটসম্যানের মিলিত অবদানে ভারতের ‘বিনা উইকেটে’ ৪০৮ রান।
* বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ স্কোর।
* আশরাফুল ও জাভেদ ওমরের বিশ্ব রেকর্ড।

চুম্বক অংশ তুলে দিলাম। এবার একটু বিস্তারিত বলা যাক।

প্রথমেই টস। টেস্টের প্রথম দুদিন তো টসই ‘টক অব দ্য ম্যাচ’। টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়ে কোনো অধিনায়ক বিপদে পড়তে দেখলে এখনো হাবিবুল বাশারের এই টেস্টের কথা মনে পড়ে যায়। ভারতের হাতে ব্যাট তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অবশ্য অধিনায়কের চেয়ে কোচের ভূমিকাই বেশি ছিল। দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে উইকেট বুঝতে না পারার কথা অকপটে স্বীকারও করেছিলেন ডেভ হোয়াটমোর।

একাধিক ক্যাচ ফেলে প্রথম দিনে কোনো উইকেটই নিতে পারেননি বাংলাদেশের বোলাররা। তাহলে তো দিন শেষে দুই ওপেনারের অপরাজিত থেকে বেরিয়ে আসার কথা, তাই না? অথচ বেরিয়ে এসেছিলেন তিন আর চার নম্বর ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড় ও শচীন টেন্ডুলকার!

কারণ, দুই ওপেনার দিনেশ কার্তিক ও ওয়াসিম জাফর মে মাসের ঢাকার প্রচণ্ড গরম আর আর্দ্রতায় পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হয়ে অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন। দিনেশ কার্তিক পরদিন আবার ব্যাট করতে নামলেও সম্ভবত সেঞ্চুরি করে ফেলায় ওয়াসিম জাফর আর নামেননি। স্কোরকার্ডে তাঁর নামের পাশে লেখা হয়েছে ‘রিটায়ার্ড ইল’।

মজাটা হলো, টেস্টের দ্বিতীয় দিন ভারতের রান চার শ পেরিয়ে যাওয়ার পর। তিন-চার নম্বর ব্যাটসম্যান ব্যাটিং করছেন, কিন্তু উইকেটের ঘরে তো ‘শূন্য’। টেকনিক্যালি এটা তাই প্রথম উইকেট জুটি। যে জুটিতে বিশ্ব রেকর্ড তখন ৪১৩। তা পেরিয়ে গেলে কি এটা নতুন রেকর্ড হিসেবে গণ্য হবে? চারজন ব্যাটসম্যানের মিলিত অবদানে কোনো জুটি হয় নাকি! উত্তরটা পরে জানা গেছে, কিন্তু তখন প্রেসবক্সে কনফিউশন আর কনফিউশন।

৪০৮ রানে প্রথম উইকেট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারত ইনিংস ঘোষণা করেছিল ৩ উইকেটে ৬১০ রানে। টেস্ট ইতিহাসে সেই প্রথম কোনো ইনিংসে প্রথম চার ব্যাটসম্যানেরই সেঞ্চুরি। এরপরও যা হয়েছে মাত্র একবারই (২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করাচিতে যা করেছে পাকিস্তান)।

দুই ইনিংসে ১১৮ ও ২৫৩ রান করে ম্যাচটা এক ইনিংস ও ২৩৯ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তাতেও বলার মতো অনেক ঘটনা। এর দুটিই শুধু বলি। না বলে উপায় নেই; কারণ, আশরাফুল আর জাভেদ ওমর যে বিশ্ব রেকর্ডই করে ফেলেছিলেন! চরিত্রে বিপরীত দুই রেকর্ড। একজন সারা জীবন তা মনে রাখবেন, আরেকজন ভুলে যেতে পারলে বাঁচেন।

রেকর্ড ১: প্রমত্ত আশরাফুল

প্রথম ইনিংসে ‘গোল্ডেন ডাক’ পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। দ্বিতীয় ইনিংসে তিনিই খেললেন অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। ৪১ বলে ৬৭ রান যা মোটেই বোঝাতে পারছে না। ১২টি চার ও ২টি ছয়, মানে শুধু বাউন্ডারিতেই আসা ৬০ রান কিছুটা পারছে। হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন ২৬ বলে, বলের হিসাবে তখন যা টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় দ্রুততম (দ্রুততম ছিল জ্যাক ক্যালিসের ২৪ বল)। বলের হিসাবে বিশ্ব রেকর্ড হয়নি, তবে সময়ের হিসাবে হয়েছিল। মাত্র ২৭ মিনিটে হাফ সেঞ্চুরি ভেঙে দিয়েছিল প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন রেকর্ড। সাত বছর পর তিন মিনিট কম সময় নিয়ে যেটিকে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছেন মিসবাহ-উল হক।

ইশান্ত শর্মার অভিষেক টেস্টে স্মরণীয় এক ইনিংস খেলেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল

আশরাফুলের ওই ইনিংসটার সময় ম্যাচের বাকি সবকিছু মুছে গিয়ে সত্যি হয়ে ছিল শুধু তাঁর উদ্ধত স্ট্রোক প্লে; যা দেখতে দেখতে নেভিল কার্ডাসের অমর ওই কথাটা মনে পড়ছিল। রঞ্জির ব্যাটিং দেখে কার্ডাস লিখেছিলেন, ‘আমরা কি সত্যি তাঁকে দেখেছি? নাকি পুরোটাই মধ্যদুপুরের মায়াবী বিভ্রম!’ ম্যাচ রিপোর্টে কথাটা ব্যবহারও করেছিলাম।

রেকর্ড ২: দুর্ভাগা জাভেদ
আশরাফুলের বিশ্ব রেকর্ডটা ভেঙে গেছে, তবে জাভেদ ওমরেরটা টিকে আছে এখনো। না থাকলেই তিনি খুশি হতেন। টেস্টের দুই ইনিংসেই প্রথম বলে আউট হওয়ার একমাত্র ‘কীর্তি’ কি আর বলার মতো কোনো রেকর্ড! জাভেদকে অবশ্য একটু দুর্ভাগাই বলতে হয়। দ্বিতীয় ইনিংসে জহির খানের লেগ সাইডের বল উইকেটকিপারের গ্লাভসে যাওয়ার আগে তাঁর ব্যাটে লাগেইনি। তারপরও কট বিহাইন্ড দিয়ে দিয়েছেন আম্পায়ার। তখন তো আর ডিআরএস ছিল না।


***

রেজাল্টের বিচারে পুরোপুরি একতরফা ইশান্ত শর্মার অভিষেক টেস্টে এত সব কাহিনি! তাঁর শততম টেস্টটা না জানি কী কী উপহার দেয়! একদিক থেকে এটি এখনই এগিয়ে। টেস্টটা তো শুরুই হয়েছে রেকর্ড দিয়ে।