দ. আফ্রিকার ভাগ্যবিপর্যয়ের গল্প

দক্ষিণ আফ্রিকা ভালো দল নয়—যেকোনো আইসিসি টুর্নামেন্টের আগে এমন কথা বলারই সাহস হবে না কারও। তারায় খচিত এক দল। সব বিভাগে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের সমারোহ। দ্বিপক্ষীয় সিরিজগুলোতে একচ্ছত্র দাপট। কিন্তু আইসিসির প্রতিযোগিতাগুলো এলেই সেই শক্তিশালী দলটিই হয়ে যায় অন্য রকম। সেই ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ থেকে শুরু। এরপর আইসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্টগুলোতে প্রোটিয়াদের একই চেহারা—গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভেঙে পড়া। মাঝে ১৯৯৮ সালে ঢাকার মিনি বিশ্বকাপ (চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আদি নাম) বাদ দিলে গল্পটা কমবেশি একই।

বৃষ্টিতে থেমে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা। ছবি: ফাইল ছবি
বৃষ্টিতে থেমে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা। ছবি: ফাইল ছবি

১৯৯২ বিশ্বকাপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড
বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগেই বর্ণবাদের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২১ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেই রূপকথার ইতিহাস গড়ার পথেই ছিল প্রোটিয়ারা। লিগ-পদ্ধতিতে আয়োজিত ১৯৯২ বিশ্বকাপের রাউন্ড রবিন লিগে মোটামুটি দাপট দেখিয়েই সেমিফাইনালে উঠে যায় কেপলার ওয়েসেলসের দক্ষিণ আফ্রিকা। সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও জয়ের পথেই ছিল তারা। ইংলিশদের ২৫২ রানের জবাবে একপর্যায়ে ৬ উইকেটে ২০৬ রান তুলে ফেলার পরই বৃষ্টি ভাগ্যবিপর্যয় ঘটায় দক্ষিণ আফ্রিকার। বৃষ্টির কারণে প্রথমে নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৩ বলে ২২। কিন্তু আবারও বৃষ্টি সেই লক্ষ্যকেই বানিয়ে দেয় ১ বলে ২২। নিজেদের ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকে ট্র্যাজিক বিদায় ঘটে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশের।

ব্রায়ান লারাই বাধা হয়ে দাঁড়ালেন প্রোটিয়াদের সামনে। ছবি: ফাইল ছবি

১৯৯৬ বিশ্বকাপ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা
উপমহাদেশে আয়োজিত এই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ে দাপট দেখিয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আরব আমিরাত, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, হল্যান্ড প্রোটিয়াদের কাছে উড়ে যায় খড়কুটোর মতোই। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়েই ঘটে ভাগ্যবিপর্যয়। ব্রায়ান লারার ১১১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসে ক্যারিবীয়দের গড়া ২৬৪ রানের ইনিংস আর টপকাতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। ২৪৫ রানে অলআউট হয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় ঘটে যায় তাদের।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে এজবাস্টনে দক্ষিণ আফ্রিকার সেই হৃদয় ভেঙে যাওয়া দৃশ্য। ছবি: এএফপি

১৯৯৯ বিশ্বকাপ, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড
এই বিশ্বকাপেও দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল দারুণ ফেবারিট। ক্রিকেট দুনিয়ায় তখন প্রোটিয়াদের মতো ভারসাম্যপূর্ণ দল খুব বেশি ছিল না। গ্রুপ পর্যায়েই অবশ্য সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা বড় অঘটনের শিকার হয়েছিল। হেরে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ের কাছে। তবে বাকি ম্যাচগুলো (ইংল্যান্ড, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা) জিতে সুপার সিক্সে উঠে গিয়েছিল খুব সহজেই।
সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচটি থেকেই তাদের বিপর্যয়ের শুরু। দক্ষিণ আফ্রিকা তত দিনে সেমিতে উঠে গেলেও অস্ট্রেলিয়ার জন্য সেটি ছিল ‘জিততেই হবে’-জাতীয় ম্যাচ। জিতলেই কেবল অস্ট্রেলিয়া নিশ্চিত করতে পারবে সেমিফাইনাল। সেই সেমিফাইনালও তখন খেলতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকারই সঙ্গে—সমীকরণটা ছিল এমনই। প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়ার সমীকরণটা কঠিন করে দেয় হানসি ক্রোনিয়ের দল। ২৭২ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে অস্ট্রেলিয়াকে পথ দেখান স্টিভ ওয়াহ। দারুণ এক সেঞ্চুরি করে শেষ ওভারে ম্যাচ জেতান। এখানে একটা ছোট্ট ঘটনাও আছে। ওয়াহ যখন ৫৬ রানে, তখন মিড উইকেটে তাঁর ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন হার্শেল গিবস। সেই ক্যাচটা কীভাবে ফেলেছিলেন, সেটি হয়তো এখনো আনমনে ভাবেন গিবস। নতুন জীবন পেয়ে বড় ওয়াহ অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন জয়ের বন্দরে।
সেমিতে শন পোলকের বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয়ে যায় মাত্র ২১৩ রানেই। কিন্তু এই রান তাড়া করতে গিয়েই একেবারেই এলোমেলো প্রোটিয়ারা। তবে ল্যান্স ক্লুজনার একাই খেলে দলকে প্রায় জিতিয়েই দিচ্ছিলেন। কিন্তু সেই ক্লুজনারই অসম্পূর্ণ রাখলেন গল্পটা। এলোমেলো করে বসলেন শেষ ওভারে। চার বলে দরকার মাত্র এক রান। স্ট্রাইকে ক্লুজনারই। একটি রান নিতে গিয়েই দেখলেন তাঁর সর্বশেষ সঙ্গী অ্যালান ডোনাল্ড মূর্তি বনে গিয়েছেন। মার্ক ওয়াহ বল ধরে তা ছুড়ে দেন বোলার ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের কাছে। ততক্ষণে ক্লুজনার আর ডোনাল্ড এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেছেন। বোলার ফ্লেমিং আস্তে করে উইকেটকিপার অ্যাডামস গিলক্রিস্টকে দিলে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের শেষ চার থেকে নিশ্চিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়। ম্যাচটি যদিও টাই হয়েছিল। কিন্তু নেট রান রেটে অস্ট্রেলিয়া চলে যায় ফাইনালে।

গিবস উঠে যেতেই ২০০২ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভেঙে পড়ল দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। ছবি: এএফপি

২০০২ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, শ্রীলঙ্কা
ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে হেরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। বীরেন্দর শেবাগ ও যুবরাজ সিংয়ের ফিফটি আর রাহুল দ্রাবিড়ের ৪৯ রানে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ২৬১ রানের মোটামুটি চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ে ভারত। ২৬১ রানের লক্ষ্যে একপর্যায়ে ৩৬ ওভারে ১ উইকেটে ১৯২ রান তুলে ফেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এই পর্যায়ে কলম্বোর প্রচণ্ড গরমে পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হন দুর্দান্ত খেলতে থাকা গিবস (১১৬)। মাঠ থেকে উঠে যেতে হয় তাঁর। ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে দলেরও। শেষ পর্যন্ত ১০ রানে হারতে হয় তাদের।

ডাক ওয়ার্থ লুইস পদ্ধতির হিসাবেই ভুল করেছিলেন শন পোলক। ছবি: এএফপি

২০০৩ বিশ্বকাপ, দক্ষিণ আফ্রিকা
নিজেদের দেশের মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিদায় নিতে হয়েছিল গ্রুপ পর্যায় থেকেই। কীভাবে তারা বিদায় নিয়েছিল সেটি কোনো দিন ভুলতে পারবেন না ক্রিকেটপ্রেমীরা। অধিনায়ক শন পোলক ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতির হিসাব ভুল করেছিলেন। সেই ভুল ছিল অমার্জনীয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বৃষ্টি-বিঘ্নিত ম্যাচে ডাক ওয়ার্থ লুইসের হিসাবে প্রোটিয়াদের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৪৫ ওভারে ২৩০। কিন্তু পোলক মাঠে বার্তা পাঠান ৪৫ ওভারে লাগবে ২২৯ রান। মুরালিধরনকে ছক্কা মেরে দলকে ২২৯ রানে পৌঁছে দেন মার্ক বাউচার। জয় হাতের মুঠোয় এসে গেছে ভেবে মুরালির শেষ বলটি ‘ব্লক’ করেন বাউচার। ডারবানের গ্যালারিতে তখন শুরু হয়ে গেছে উদ্‌যাপন। কিন্তু এমন সমই ভাঙে ভুলটা। লক্ষ্য তো ছিল ২৩০, ২২৯ নয়। আফসোসে পোড়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না পোলকদের। অথচ শেষ বলটিতে ইচ্ছা করেই রান নেননি বাউচার।

দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্যবিপর্যয়ের গল্পটা এখানেই থামিয়ে দেওয়া যাক। কারণ, পরের গল্পগুলোও যে একই রকম। ২০০৪ ও ২০০৬ চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০১১ ও ২০১৫ বিশ্বকাপ—একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি। সেই কাহিনি যে এখন অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছে একঘেঁয়ে। ক্লিশে।