সেই তারা, কোথায় তাঁরা

'দুর্বিনীত' আফতাব এখন শান্ত এক শিক্ষক

শিষ্যদের নিয়ে ব্যস্ত গুরু আফতাব। ছবি: জুয়েল শীল
শিষ্যদের নিয়ে ব্যস্ত গুরু আফতাব। ছবি: জুয়েল শীল

বসার ঘরে ঢুকতেই অভ্যর্থনা জানাল ছোট্ট পুতুলের মতো এক শিশু। কিছুক্ষণ পরে যোগ দিল আরও একজন। মিষ্টি হেসে আফতাব আহমেদ দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পাঁচ বছরের বয়সী বড় কন্যা সামান্থা চৌধুরী, চার বছর বয়সী ছোট কন্যা সামারা চৌধুরী। চোখে তৃপ্তির আভা ফুটিয়ে বললেন, ‘আমার যাবতীয় ভাবনা এ দুজনকে ঘিরে। বাইরে আড্ডা কম দিই। ওদের সঙ্গেই সময় কেটে যায়।’

সন্তানদের বাইরেও আফতাবের আরেকটি জগৎ আছে—ক্রিকেট। যার সঙ্গে নাড়িপোঁতা সম্পর্ক শৈশব থেকেই। তবে ভূমিকা বদলেছে। গত বছর আগস্টে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন। এ বছর এপ্রিলে চট্টগ্রামে চালু করেছেন নিজের নামে একাডেমি। শিষ্যদের নিয়ে সপ্তাহে তিন দিন অনুশীলন করান বিভিন্ন মাঠে। সেই আফতাব, প্রতিপক্ষের নামি ফাস্ট বোলারদেরও ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে ব্যাট চালানোর দুঃসাহসী আফতাব এখন অনেকটাই শান্ত। সুস্থির। শিক্ষকসুলভ একটা গাম্ভীর্যও যেন এসেছে। সেই গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিয়েছে একমুখ দাড়িগোঁফ।
নিজের স্বপ্নটা পূরণ করতে পারেননি। সম্ভাবনা সবটুকু ডানাও মেলে দেয়নি। অতৃপ্ত সেই স্বপ্নের বীজ বুনে দিচ্ছেন শিষ্যদের মনের জমিনে। বললেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে আগের মতো প্রতিভা উঠে আসছে না। এখন কেবল তামিম খেলছে। পরে কে আসছে চট্টগ্রাম থেকে? বলার মতো কেউ নেই। চট্টগ্রামের জন্য এটা লজ্জার। ভালো খেলোয়াড় তুলে নিয়ে আসাটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।’
বাংলাদেশ দলে এখন দুর্বিনীত সাহসী ক্রিকেটার অনেক। প্রতিপক্ষ যেই হোক, বাংলাদেশ কাউকে ডরায় না। প্রতিটি খেলোয়াড়ের চোখে প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয়। এক সময় বাংলাদেশ দলে এ প্রত্যয় দেখা যেত দু-একজনের মধ্যেই। আফতাব তাঁদেরই একজন। আফতাব বলতেই ভেসে উঠবে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে শেষ ওভারে গিলেস্পিকে দুর্দান্ত এক পুলে ছক্কা মারা। ওই ম্যাচের নায়ক সেঞ্চুরিয়ান আশরাফুল হলেও ম্যাচ শেষে আফতাবকে কাঁধে তুলেই আনন্দে মেতেছিল মাঠে ঢুকে পড়া উল্লসিত জনতা। কার্ডিফের সেই ম্যাচই ছিল আজকের বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অন্যতম ভিত্তি।
আফতাব বলতেই চোখে ভেসে উঠবে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও। জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪৯ বলে অপরাজিত ৬২ রানের ইনিংস। শুরুর দিকে আফতাব চমকে দিয়েছিলেন বল হাতেও। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ উইকেট, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এক ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি। ক্যারিয়ারের ঊষালগ্নেই উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আফতাবের চোখে এখনো দুরন্ত সেই দিনগুলো, ‘খুব মনে পড়ে সে সব দিনের কথা। সব সময় চেষ্টা করেছি ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার। যখন মাঠে নামতাম, ভাবতাম সব ভয় সাজঘরে ফেলে এসেছি। উইকেটে যতক্ষণ থেকেছি, চাপমুক্ত হয়ে খেলেছি। কারণ, চাপ নিয়ে খেললে ৪০ শতাংশ খেলা নষ্ট হয়ে যায়। ভয়ডরহীন খেললে ৯০ শতাংশ ভালো খেলার সম্ভাবনা থাকে। এখন বাংলাদেশ ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে বলেই সাফল্য পাচ্ছে।’
‘মুক্ত করো ভয়’—এই বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন শিষ্যদের মধ্যেও, ‘আমার একাডেমির ছেলেদেরও শেখাই, যখন উইকেটে যাবে, চাপ ভুলে যাবে। কী হবে? সর্বোচ্চ আউট হবে। এর বেশি কিছু নয়। কাজেই যতক্ষণ ব্যাট কর, মনেপ্রাণে সেটা উপভোগ কর।’

দুই মেয়েকে নিয়েই আফতাবের সব ভাবনা। ছবি: প্রথম আলো

তাঁর দিনগুলোয় বাংলাদেশ সাফল্য পেয়েছে কালেভদ্রে। তবুও কিছু স্মরণীয় মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আফতাবের নাম। কোন মুহূর্ত সবচেয়ে বেশি দোলা দেয় মনে? আনন্দের রেখা চিকচিক করে ওঠে আফতাবের চোখেমুখে, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কার্ডিফের ওই ম্যাচটা এগিয়ে রাখব। গিলেস্পির বলে সেই ছক্কা অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। তখন ভেবেছিলাম, জিততে পারব কি পারব না। অস্ট্রেলিয়া মহাশক্তিশালী দল, তখন বিশ্বের এক নম্বর। গিলেস্পির প্রথম বলেই দুম করে মেরে দিলাম ছক্কা! ২০০৬-এ বগুড়ায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে অলক কাপালির সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেটে ৫১ রানের জুটি গড়েছিলাম। এখনো সেই ম্যাচের কথা মনে পড়লে গায়ে কাটা দেয়। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয়ের কথাও বলতে হবে। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৬৭ রান করেছিলাম। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষের ম্যাচটাও মনে পড়ে। আশরাফুল ওদের ইনিংসের শেষ দিকে এক ওভারে ২৪ রান দিয়ে দেওয়ার পর মনে হয়েছিল পারব না! তারপর আশরাফুলের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ১০৯ রানের জুটি গড়লাম। ম্যাচও জিতলাম।’
কত সব স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে! ক্যারিয়ারটা দীর্ঘ হলে বলার মতো এমন গল্প নিশ্চয় আরও জমা হতো স্মৃতির ভাঁড়ারে। অকপটেই স্বীকার করলেন, ‘আক্ষেপ তো হয়ই। আমারও কিছু দোষ ছিল। ঘুমকাতুরে বলে একটা কথা লেগে গেয়েছিল গায়ে...।’ আফতাব আনমনে আওড়ে যান, চকিতে চোয়ালে দেখা দেয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, ‘চাইব, আমার একাডেমির ছেলেদের ক্ষেত্রে যেন এমন না হয়।’
নিজের জীবনটাকে তিন ভাগে ভাগ করেন আফতাব। জাতীয় দলে খেলার আগে, খেলার সময় আর খেলা ছাড়ার পর। তবে প্রতিটি জীবনই উপভোগ করেছেন মনভরে, ‘ছেলেবেলায় ভীষণ দস্যিপনা করেছি। সেটা অন্যরকম উপভোগ্য ছিল। বাংলাদেশ দলে খেলার সময় রঙিন জীবন। গাড়ি, গ্ল্যামার। খুব স্টাইলিশ ছিলাম তখন। এখন আবার আরেক জীবন। ধর্ম-কর্মে খুব মনোযোগী। অনেকে বলেন, জাতীয় দলে নেই বলেই ধর্মে-কর্মে মন দিয়েছি। আসলে তা নয়। সব মিলিয়ে সংসার, ধর্ম, একাডেমি—এই হচ্ছে এখনকার জীবন। এ জীবনেই আমি খুশি।’
বিদায় নেওয়ার আগে স্মারক উপহার হিসেবে দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের একটি জার্সি। ওটাই ছিল বাংলাদেশের হয়ে আফতাবের শেষ খেলা।
ওপরে জলভরন্ত আকাশ, হাতে লাল-সবুজ জার্সি। পেছনে পড়ে থাকে জার্সির মালিকের অসমাপ্ত এক ক্যারিয়ারের গল্প। অসমাপ্ত বৃত্ত পূরণ হবে সেদিনই, যেদিন আফতাবেরই কোনো শিষ্য নাম লেখাবে জাতীয় দলে। তাঁর ব্যাটিং দেখে অতীতচারী কোনো দর্শকের মনে হবে, ‘আরে, ছেলেটা আফতাবের মতো না!’