অনেক আগে ‘দায়ী কে’ নামে একটা বাংলা সিনেমা হয়েছিল। পত্রিকার পাতায় দেখা সিনেমার বিজ্ঞাপনটা এখনো চোখে ভাসে। ভাসিয়ে রেখেছে আসলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বাস্তবতা। ‘দায়ী কে’ যে এখানে চিরকালীন এক প্রশ্ন!
বাংলাদেশ দল যখন খুব খারাপ খেলে হারে, আমরা খুঁজতে থাকি ‘দায়ী কে’? বাংলাদেশ দল যখন ভালো খেলে হেরে যায়, আমরা খুঁজতে থাকি ‘দায়ী কে’? বাংলাদেশ দল যখন টানা হারের মধ্যে থাকে, কৌতূহলী মন প্রশ্ন করে, ‘দায়ী কে?’ বাংলাদেশ দল যখন জয়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ একটা ম্যাচ হেরে যায়, তখনো আমরা প্রশ্ন করি, ‘দায়ী কে?’
প্রশ্ন করার আগে আমরা বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের শেষ সীমাটার কথা ভুলে যাই। ভুলে যাই বাংলাদেশের ক্রিকেট–সংস্কৃতি আর সুযোগ-সুবিধার কথা। এটাও আমরা তখন মনে আনি না যে যাদের বিপক্ষে হেরে যাওয়ার পর ‘দায়ী কে’ খোঁজা হচ্ছে, সেই প্রতিপক্ষ কতটা প্রবল, ক্রিকেটীয় ও শারীরিক সামর্থ্যে বাংলাদেশ আসলে তাদের কতটা সমকক্ষ হতে পেরেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এবার বাংলাদেশ দল যে রকম সময় কাটাচ্ছে, সে রকম সময় আগের ২০ বছরে এ দেশে এসে কাটেনি। বাংলাদেশ এবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দাপট দেখিয়ে এ দেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে। ডারবানের প্রথম টেস্টের প্রথম চার দিন চোখে চোখ রেখে খেলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিটা এবারই এসেছে তরুণ মাহমুদুল হাসানের ব্যাট থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকান পেসারদের চেয়েও ভালো বোলিং করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের পেসাররা। তবু যেন ‘দায়ী কে’ প্রশ্ন থেকে মুক্তি নেই ক্রিকেটারদের।
ডারবান টেস্টে টসে জিতে বাংলাদেশ কেন আগে ব্যাটিং নিল না, সেই প্রশ্ন শুরু থেকেই। দলের দক্ষিণ আফ্রিকান কোচিং স্টাফরা যখন বলেছেন কিংসমিডে আগে ব্যাটিং করা উচিত, তখন তো তা–ই করা উচিত ছিল! কিন্তু টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার পক্ষে অধিনায়ক মুমিনুল হকের যুক্তি ছিল, অচেনা এই উইকেটে যেহেতু তাঁরা আগে কখনো খেলেননি, উইকেট বুঝতে প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকাকেই ব্যাটিংয়ে পাঠানো উচিত বলে মনে করেছেন।
প্রথম কথাটা যেমন ঠিক, শেষের চিন্তাটিতেও ভুল কী আছে? হয়তো একটু রক্ষণাত্মক চিন্তাই ছিল কিন্তু অচেনা উইকেটে আগে ব্যাটিং নিয়েও যদি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তেন ব্যাটসম্যানরা, তখনো কি ‘দায়ী কে’, ‘দায়ী কে’ বলে শোরগোল উঠত না?
এবার আসুন টেস্টের শেষ দিনে বাংলাদেশ কেন ৫৫ মিনিটের মধ্যে ৭ উইকেট হারাল, সে প্রসঙ্গে। ব্যাটসম্যানরা সেদিন সকালে যেভাবে আউট হয়েছেন, সেটি তো পঞ্চম দিনের উইকেটের কারণে নয়! কেশব মহারাজ ৭ উইকেট পেয়েছেন, সাইমন হারমার আর মহারাজ মিলেই বাংলাদেশের ১০ উইকেট নিয়েছেন, সেটিও তো উইকেট থেকে অনেক বেশি সুবিধা পেয়ে নয়!
কিছুটা আতঙ্ক আর কিছুটা আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণেই সেদিন নিজেদের উইকেটগুলো দিয়ে এসেছেন ব্যাটসম্যানরা, যে অঘটন আগে ব্যাটিং করলে প্রথম ইনিংসেও ঘটে যেতে পারত। কারণ, ওই উইকেটে আগে ব্যাটিং করার জন্য ব্যাটসম্যানরা মানসিকভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না। ডমিঙ্গো-ডোনাল্ড যতই কিংসমিডে আগে ব্যাট করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, মাঠে গিয়ে খেলতে তো হতো ব্যাটসম্যানদেরই!
প্রশ্ন হতে পারে, এই পর্যায়ে গিয়ে এত আতঙ্ক আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগবেন কেন ব্যাটসম্যানরা? ভুগবেন কারণ তাঁরা কেউই ওই ‘দায়ী কে’ প্রশ্নের উত্তরের ঘরে নিজের নাম দেখতে চান না। ক্রিকেট একটা খেলা কিন্তু সেটার সাফল্য-ব্যর্থতা কোনোটাকেই আমরা খেলোয়াড়ি মানসিকতায় নিতে শিখিনি। আফগানিস্তানকে হারালে তাই আমাদের উল্লাসের সীমা থাকে না। আমরা মেনে নিতে পারি না দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেটে উন্নত দলের কাছে হারও।
বাংলাদেশের অপরিপক্ব ক্রিকেট–সংস্কৃতি ক্রিকেটারদের মানসিক অবয়বটাই এমন করে দিচ্ছে যে অবচেতনে বেশির ভাগ ক্রিকেটারের চিন্তায় ‘আত্মরক্ষা’র কথাই আগে আসে। আগে নিজে বাঁচো, তারপর অন্যকে বাঁচাও, দলকে জেতাও। ঝুঁকি নিয়ে কিছু করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া মানেই হাজারটা প্রশ্নের মধ্যে পড়ে যাওয়া।
সেসব প্রশ্নে বেশির ভাগ সময় ক্রিকেটীয় যুক্তি অনুপস্থিত থেকে যায়, সেগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে আবেগের বাষ্পে। অবশ্য যে দেশের ক্রিকেট চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘সেন্টিমেন্ট’ বুঝে, সেখানে এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা। ভুল হোক, ঠিক হোক, ফেসবুকই এখন নির্ধারণ করে দিচ্ছে দেশের ক্রিকেট কোন দিকে চলবে, ক্রিকেটের কোন বিষয়টা নিয়ে আলোচনার মাঠ সরগরম করে তুলতে হবে।
তাতে অনেক সময় খেলোয়াড়েরা ব্যক্তিগত আক্রমণেরও শিকার হয়ে যান। ক্রিকেটের নীতিনির্ধারকেরাও কিছু করা বা বলার আগে ১০০ বার ভাবেন, ফেসবুকে সেটার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। ক্রিকেটারদের মনোজগতে তাই এখন সারাক্ষণই এই এক আতঙ্ক। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ উল্টাপাল্টা বললে তার বিরুদ্ধে আইনগতভাবে কী করা যায়, খেলোয়াড়দের আড্ডায় বেশ গুরুগম্ভীর আলোচনাই হয় সেটি নিয়ে।
অথচ যাদের বিরুদ্ধে একটা টেস্ট শেষ দিনে গিয়ে হেরে যাওয়ায় এত কথা, সেই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট কিন্তু এমন নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশটির ইতিহাস ১৩৩ বছরের পুরোনো। বাংলাদেশের কাছে ওয়ানডে সিরিজ হারায় তাদের ক্রিকেটারদেরও সমালোচনা হয়েছে কিন্তু সেসব ক্রিকেটীয় যুক্তিতর্ক বাদ দিয়ে নয়। দিন শেষে তারা মেনে নিয়েছে, ক্রিকেট একটা খেলা আর খেলায় এ রকম হতেই পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকার তুলনায় বাংলাদেশের ক্রিকেট ঐতিহ্য বলতে গেলে এই সেই দিনের। আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগ আর টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অবস্থান শত বছরের ব্যবধান পূরণ করা গেলে তো হয়েই গিয়েছিল!
টেস্ট সিরিজের আগে ডারবানের চ্যাটসওয়ার্থ ক্রিকেট ওভালে অনুশীলন করেছে বাংলাদেশ দল। ক্লাব মাঠ, অথচ খেলার জন্য এ রকম একটা ভালো মাঠও নেই বাংলাদেশে। এবার তো বিসিবির পরিচালকেরাও দেখে গেছেন এখানকার ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলোতে অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা কত আধুনিক।
এখানে একটা রাজ্য দলের মাঠও যে রকম স্বয়ংসম্পূর্ণ, সে রকম মাঠ বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখনো স্বপ্ন। আর ক্লাব বা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট ক্রিকেটারদের সব দিক দিয়েই যে রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়, ঢাকার ক্লাবগুলোর জন্য সেটা স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু। অথচ দেশের ক্রিকেট চালাতে যাঁরা বিসিবিতে আছেন, ক্লাব এবং বিভাগীয় পর্যায়ে ক্রিকেটের উন্নতি আনার দায়িত্বটা তাঁদেরই।
ক্রিকেটে উন্নত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার এতটাই ব্যবধান, বাংলাদেশ দল যে কখনো কখনো অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের মতো দলগুলোকে হারিয়ে দেয়, সেটাকেই বরং অবাস্তব মনে হয়। পায়ের নিচের ভিতটাই এখনো শক্ত হয়নি অথচ ক্রিকেটাররা ম্যাচ জিতছেন। আমাদের স্বপ্নের সীমা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তারপর কখনো যখন বাস্তবতার শক্ত জমিনে পড়ে সে স্বপ্ন ভেঙে যায়, আমরা প্রশ্ন করি, ‘দায়ী কে?’
অথচ একটা দেশের ক্রিকেট কতটা ভালো, সেটি পরিমাপ করার মানদণ্ডগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে এগিয়ে মাঠের ক্রিকেটই। এক এই জায়গাতেই আমরা পেরেছি বিশ্বের সব দলকে হারাতে। ক্রিকেটের অন্য কোন ক্ষেত্রে সেটি পেরেছে বাংলাদেশ?
এই না পারার জন্য ‘দায়ী কে’, সেই প্রশ্নের উত্তর কি কেউ দেবেন?