দম আটকানো রাত, জোড়া উইকেট এবং দীর্ঘশ্বাস

ব্রাফেটের হৃদয়ভাঙা ছবি। একাই দলকে জেতানোর খুব কাছে নিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হেরেছেন। ছবি: এএফপি
ব্রাফেটের হৃদয়ভাঙা ছবি। একাই দলকে জেতানোর খুব কাছে নিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হেরেছেন। ছবি: এএফপি
>

বিশ্বকাপে কাল দুটি ম্যাচই ভীষণ রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে। বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে কালকের রাতটা হতে পারে বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সেরা রাত

বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ কেমন যেন পানসে হতে বসেছিল। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে চমকের শুরুটা করল শ্রীলঙ্কা। কাল দুটি ম্যাচের ফলে অবশ্য কোনো চমক নেই। অপেক্ষাকৃত ভালো দুটি দলই জিতেছে। কিন্তু ম্যাচ দুটি দেখে থাকলে বলতে হবে, এমন রাত যেন বারবার আসে!

অবশ্য পুরোপুরি রাত বলা যায় না। বাংলাদেশ সময়ে ভারত-আফগানিস্তান ম্যাচ গড়িয়েছে বিকালে। সন্ধ্যায় নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এ দুটি ম্যাচের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা নাটক, উত্তেজনা, রোমাঞ্চের রেণুগুলো যে রাতেই (বাংলাদেশ সময়) বেশি উড়েছে। অনেকের কাছেই চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সেরা রাত উপহার দিয়েছে কালকের দুটি ম্যাচ।

ভারতের কাছে আফগানিস্তানের পাত্তাই পাওয়ার কথা না। কিন্তু সেই ভারতকেই স্পিন ফাঁসে আটকে (২২৪/৮) অবিশ্বাস্য কিছু ঘটানোর ইঙ্গিত দিয়েছিল আফগানরা। তাড়া করতে নেমে জয়ের পথেই ছিল দলটি। ওদিকে ভারতের বোলাররাও যেকোনো মূল্যে কোনো অঘটন ঘটতে না দেওয়ার চেষ্টায় সর্বস্ব উজাড় করে বল করেছেন ‘ডেথ ওভার’-এ। ম্যাচের ভাগ্য তাই দুলেছে পেন্ডুলামের মতো। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়িয়েছে শেষ ওভার পর্যন্ত আর শেষ ওভারে মোহাম্মদ শামি উপহার দিয়েছেন চলতি বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক, সঙ্গে ভারতের জয়ও। সত্যিই রোমাঞ্চকর। ভারত জিতে যেমন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে তেমনি আফগানরা হারলেও মাথা উঁচুই থাকবে।

সাউদাম্পটনের স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচ শেষে অনেকে চোখে রেখেছেন ম্যানচেস্টারে। ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে, নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করেছেন কেন উইলিয়ামসন। জিততে হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ২৯২। ভারত-আফগানিস্তান ম্যাচ শেষে টিভিতে ম্যানচেস্টারের ম্যাচে তাকালে মনে থাকার কথা তখন ক্রিস গেইল ও শিমরন হেটমায়ার ব্যাট করছিলেন। লক্ষ্যটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাগালেই ছিল। মোটামুটি লো-স্কোরিং ম্যাচের উত্তেজনা শেষে তখন হাই-স্কোরিং ম্যাচে গেইল-হেটমায়ারের মার মার কাট কাট ব্যাটিং দেখার অপেক্ষা।

কিন্তু ২৩ থেকে ২৪ ওভারের মধ্যে হেটমায়ার, জেসন হোল্ডার ও গেইলকে তুলে নিয়ে রোমাঞ্চ ছড়ানোর ইঙ্গিত দিলেন কিউই বোলাররা। শেষ পর্যন্ত তা নেমে আসল ১৮ বলে ৩৩ রানের সমীকরণে। ১১তম ব্যাটসম্যান ওশানে টমাসকে নিয়ে ব্যাট করছিলেন কার্লোস ব্রাফেট। মূল রোমাঞ্চের শুরুটা হলো ঠিক এখান থেকেই। যেন মোচড়ের পর মোচড়সমৃদ্ধ কোনো সিনেমার চিত্রনাট্য! ৪৮তম ওভারে ম্যাট হেনরিকে টানা তিন ছক্কাসহ মোট ২৫ রান তুলে নেন ব্রাফেট। হার প্রায় নিশ্চিত হয়ে ম্যাচ ঘুরে তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাগালে। কিন্তু নাটকের শেষ অঙ্ক তখনো বাকি। কে জানত, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য অপেক্ষা করছে ‘ট্র্যাজেডি’ আর ব্রাফেটকে দেখে দর্শকদের মনে হবে সেই প্রবাদটি ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু (পড়ুন হার)’।

শেষ ওভারে হ্যাটট্রিক করে ভারতকে জিতিয়েছেন শামি। ছবি: এএফপি

১২ বলে দরকার ছিল ৮ রান। ৪৯তম ওভারের প্রথম পাঁচ বল থেকে ২ রান তুলে নিলেন ব্রাফেট। আর শেষ বলে ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন লং অনে। হারতে হারতে জিততে বসা ম্যাচ এভাবেই কিউইদের হাতে তুলে দিলেন ব্রাফেট। চরম হতাশায় তিনি হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন উইকেটেই। ওদিকে গ্যালারিতে কিংবা টিভি সেটের সামনে দর্শকদের স্নায়ুচাপ নেওয়ার আর কিছু বাকি ছিল কি না, কে জানে! তবে ব্রাফেটের জন্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন অনেকেই।

এ দুটি ম্যাচ মিলিয়ে কাল একটি চমকপ্রদ ব্যাপার কয়েকবার দেখা গেছে। একই ওভারে জোড়া উইকেট। মনে করে বলুন তো, কাল কতবার এমন ঘটেছে? সাতবার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি কাল দুটি ম্যাচ মিলিয়ে এক ওভারে অন্তত দুই উইকেট পতনের ঘটনা ঘটেছে মোট সাতবার! ভারতের ইনিংসে শেষ ওভারে ফিরেছেন শামি ও যাদব। এরপর আফগানিস্তানের ইনিংসে একই ঘটনা ঘটেছে দুবার। ২৯তম ওভারে রহমত শাহ ও হাশমতউল্লাহ শহীদিকে তুলে নিয়েছেন যশপ্রীত বুমরা। আর শেষ ওভারে শামির সেই হ্যাটট্রিক। অর্থাৎ ভারত-আফগানিস্তান ম্যাচে তিনবার দেখা গেছে এক ওভারে অন্তত দুই উইকেট পতনের ঘটনা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচে তা দেখা গেল চারবার। নিউজিল্যান্ডের ইনিংসে প্রথম ওভারেই ফিরেছেন গাপটিল-মানরো। আর শেষ ওভারে ফিরেছেন স্যান্টনার-নিশাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসে ২৩তম ওভারে হেটমায়ার-হোল্ডারকে তুলে নেন লকি ফার্গুসন। এরপর ২৭তম ওভারে এভিন লুইস-অ্যাশলে নার্সকে ফিরিয়েছেন ট্রেন্ট বোল্ট। ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ম্যাচে এক ওভারে এতবার জোড়া উইকেট পড়েছে কি না, তা সত্যিই গবেষণার বিষয়।

তবে এ কথা সত্যি, কালকের রাতটা ছিল বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত সেরা রাত।