দুঃস্বপ্নের মঞ্চেই এবার সাফল্যের চিত্রনাট্য সাজাল বাংলাদেশ
দুঃস্বপ্নের মঞ্চেই এবার সাফল্যের চিত্রনাট্য সাজাল বাংলাদেশ

দক্ষিণ আফ্রিকা দুঃস্বপ্নের, দক্ষিণ আফ্রিকা আনন্দের, গর্বেরও

সুযোগ পেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট কোন অধ্যায়টি মুছে ফেলতে চাইবে?

ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বলবে, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের কথা। দুঃস্বপ্নের এক অধ্যায় ছিল সেটি। কানাডার কাছে ঈদের আগের রাতে লজ্জাজনক এক হার দিয়ে শুরু। এরপর একের পর এক মুখ লুকানোর মতো পারফরম্যান্স। চামিন্দা ভাসের হাতে ‘খুন’, কেনিয়ার কাছে হার, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে উড়ে যাওয়া। বৃষ্টির কল্যাণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে এক পয়েন্ট তুলে নেওয়াটাই ছিল সেই বিশ্বকাপের ‘অর্জন’। বৃষ্টি সাহায্যের হাত না বাড়ালে সেই ম্যাচেও বিব্রতই হতে হতো খালেদ মাসুদের বাংলাদেশকে। লজ্জার সেই ইতিহাসের মঞ্চ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

‘দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সাফল্য অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকাতেই

সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতা এ দেশের ক্রিকেটের অস্তিত্ব ধরেই টান দিয়েছিল। টেস্ট মর্যাদাটা আমাদের জন্য বিরাট ভারী এক বোঝা কি না, এমন আলোচনাও শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ তো বলেই ফেলেছিলেন, টেস্ট মর্যাদা না পেলে হয়তো ২০০৩ বিশ্বকাপ খেলতে হতো না বাংলাদেশকে। কানাডা ও কেনিয়ার কাছে হারের লজ্জাও নিতে হতো না গোটা জাতিকে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের ব্যর্থতা তুলেছিল সমালোচনার তীব্র ঝড়। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে একটা তদন্ত কমিটিই গঠন করতে হয়েছিল অভাবনীয় সেই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানের জন্য।

২০০৩ বিশ্বকাপে ওয়ান্ডারার্সে কেনিয়ার কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ

দক্ষিণ আফ্রিকা অবশ্য দুঃস্বপ্ন ২০০৩ বিশ্বকাপের আগে থেকেই। ২০০২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা সফরটিও লজ্জার। টেস্ট বলুন কিংবা ওয়ানডে, সিরিজের প্রতিটি ম্যাচ দেখেই লজ্জায় অবনত হয়েছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। বাংলাদেশের খেলার অবস্থা দেখে রীতিমতো হাসাহাসি হয়েছিল বিশ্ব গণমাধ্যমে।

অতীতের চর্বিত–চর্বণের কারণ অবশ্যই গতকাল রাতের গৌরবের গল্প। দুই দশকের মাথায় এসে সেই দক্ষিণ আফ্রিকাই কেমন অসহায় আত্মসমর্পণ করল তামিম–সাকিব–মুশফিক–তাসকিনদের বাংলাদেশের কাছে। যে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল কখনো কোনো সংস্করণে জয়ের দেখা পায়নি, সেখানেই সিরিজ জয়, তা–ও কী দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে। কী অবলীলায়! দুঃস্বপ্নের দক্ষিণ আফ্রিকা কয়েক দিনের মধ্যেই পরিণত হলো আনন্দ আর গৌরবের পীঠস্থানে। ইতিহাস গড়ার অধ্যায়ে। এমন একটা দিনে অতীতের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০২ সালের সফর আর ২০০৩ বিশ্বকাপের পর আরও তিনবার গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এর দুবার দ্বিপক্ষীয় সফরে (২০০৮ ও ২০১৭) আর একবার প্রথম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে (২০০৭)। দ্বিপক্ষীয় সফরগুলোও ভুলে যাওয়ার মতোই। তবে ২০০২ সালের সঙ্গে পরের দুটি সফরের পার্থক্য ছিল এই যে সেগুলোয় একেবারেই অসহায় ছিল না বাংলাদেশ দল। লড়াইয়ের কিছু উদাহরণও ছিল। যেটি ছিল না, সেটি হচ্ছে সাফল্য। ২০০৭ সালের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অবশ্য বাংলাদেশ শুরু করেছিল জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েই।

২০০৩ সালে পিটারমারিসবার্গে বাংলাদেশের বিপক্ষে চামিন্ডা ভাসের সেই হ্যাটট্রিক।

অথচ, টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার আগে এই দক্ষিণ আফ্রিকাই কিন্তু বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিল আনন্দের এক উপলক্ষ। এই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দুনিয়ার সামনে গেয়েছিল নিজেদের সম্ভাবনার আবাহনী গান। ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্লেট শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকা একটি জাতি, একটি দেশ সেই শিরোপায় নিজেদের দুর্দান্ত ভবিষ্যৎই দেখতে পেয়েছিল।

আর ২০২০ তো কদিন আগেরই কথা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সেবার অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের এখন পর্যন্ত সেরা বৈশ্বিক সাফল্য। আকবর আলীদের সেই সাফল্যের পথ ধরেই কি শুরু হয়েছিল নতুন দিনের পথচলা?

সেটি হোক বা না হোক, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বিজয়কেতন উড়িয়ে এবার তামিম ইকবালের দলই নতুন দিনের শুরুটা করেছেন। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ২–১ ব্যবধানে জয়কে তো অধিনায়কই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলছেন। ভাবতে ভালো লাগছে, যে দেশে বাংলাদেশের ক্রিকেট একসময় লজ্জার মুখোমুখি হয়েছে, সে দেশেই এখন সাফল্য পাচ্ছে দল।

নতুন দিনের শুরু? হতেই পারে!