দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মার্চে টেস্ট সিরিজ খেলার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হওয়ার পর এখন আর কোনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজ শুধু দুই দলের ব্যাপার নয়, এতে জড়িয়ে থাকে আরও অনেকগুলো বিষয়। এ সিরিজ জিতলেই অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়ে যেত। লর্ডসে জুনে হবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। সে ম্যাচে বিজয়ী দলই আগামী কিছুদিন টেস্টের সেরা দলের মুকুট পরবে।
এমন এক অর্জনের সামনে দাঁড়িয়েও সিরিজ পিছিয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ এমন এক সিরিজ একটি বোর্ডের একক সিদ্ধান্তেই এভাবে বাতিল হয়ে যাওয়ায় রীতিমতো খেপে উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড (সিএসএ)। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তারা। এ নিয়ে তারা চিঠি দিয়েছে আইসিসি ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) কাছে। সিএর এমন সিদ্ধান্ত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, এমনটা মনে হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার।
দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকের পদে আছেন গ্রায়েম স্মিথ। অস্ট্রেলিয়ার এমন সিদ্ধান্ত এবং বর্তমান ক্রিকেটে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক। এটাও বলে দিয়েছেন, যদি তিন দলের ‘মোড়লগিরি’ চলতে থাকে, তবে কিছুদিন পর আর ‘মোড়লগিরি’ সহ্য করার মতো কোনো দল টিকে থাকবে না ক্রিকেটে।
অস্ট্রেলিয়াকে জৈব সুরক্ষাবলয় নিয়ে বারবার নিশ্চিত করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এমনকি তিন সপ্তাহের জৈব সুরক্ষাবলয় চাওয়ার অনুরোধও মেনে নিয়েছিল সিএসএ। তবু সন্তুষ্ট হয়নি অস্ট্রেলিয়া। মহাগুরুত্বপূর্ণ এই সিরিজটাই পিছিয়ে দিয়েছে। ওদিকে ভবিষ্যৎ ক্রিকেট সূচি এতটাই ভর্তি করে রেখেছে যে পিছিয়ে দেওয়া সে সিরিজ কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। এর আগে ইংল্যান্ডও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাঝপথে ফিরেছে। এভাবে ক্রিকেটের পরাশক্তি দুই দলের সিরিজ হাতছাড়া করে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে সিএসএ।
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাঠানো ফাঁস হয়ে যাওয়া চিঠিতে সেই ক্ষতির কিছুটা পূরণ করতে বলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
এরই মধ্যে এভাবে অস্ট্রেলিয়ার একক সিদ্ধান্তে সিরিজ পিছিয়ে দেওয়া নিয়ে আইসিসির কাছে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে সিএসএ। ইংল্যান্ড, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া অন্যদের সঙ্গে সিরিজ খেলতে খুব একটা আগ্রহী নয়। বরং নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সিরিজ খেলতে ব্যস্ত। ইংল্যান্ডের ভারত সফরের পর বিরাট কোহলিরা আবার ইংল্যান্ডে যাবেন। এরপর ইংল্যান্ড আবার অস্ট্রেলিয়া যাবে অ্যাশেজ খেলতে।
ক্রিকেট বিশ্বের সিংহভাগ অর্থ এ তিন দেশই এনে দেয়। সে অর্থ নিজেদের কাছে রেখে দেওয়ার জন্য ‘তিন মোড়ল’ নীতির জন্ম দেওয়ার চেষ্টাটা আটকানো গেলেও বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছে এই তিন দল। তারা এখন নিজেদের মধ্যেই বেশি ম্যাচ খেলছে। ওদিকে অর্থ সংস্থান নিয়ে ভেবে মাথা কুটে মরছে অন্য বোর্ডগুলো।
এভাবে অন্য সব দলকে আর্থিকভাবে দুর্বল করার ফল ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন গ্রায়েম স্মিথ। সবচেয়ে বেশি টেস্টে অধিনায়কত্ব করা সাবেক ক্রিকেটার স্বীকার করে নিয়েছেন, সফর বাতিল করায় এমনিতেই অস্ট্রেলিয়ার ওপর কতটা রেগে আছেন তাঁরা। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড ও দ্য এজের প্রশ্নের জবাবে স্মিথ বলেছেন, ‘আমার ধারণা, এখন দুই বোর্ডের মধ্যে সম্পর্ক খুবই দুর্বল। আমাদের বোর্ডের পক্ষ থেকে যোগাযোগ ও মিটিং করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা, আইসিসির এখন দৃঢ় নেতৃত্ব দেখানো প্রয়োজন। কোভিড-১৯ বোর্ডগুলোর কী আছে আর কী নেই, সেটা পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিয়েছে এবং ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কীভাবে সামলানো হবে, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে।’
আইসিসি নিজের আয় বাড়াতে গিয়ে যে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটায় যে অন্য বোর্ডগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে, এ নিয়ে নিশ্চিত স্মিথ এবং এখনই যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ সফরসূচি অনেক দলই মানবে না বলে মনে করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক, ‘আট বছরে আইসিসির সম্ভাব্য আটটি টুর্নামেন্ট, আরও বড় পরিসরের আইপিএল এবং ইংল্যান্ড, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার নিজেদের মধ্যে এত ম্যাচ মিলিয়ে এফটিপি সামলানো খুবই কঠিন হয়ে উঠবে। অন্য সদস্যদেশগুলোর এটা সম্পন্ন করা খুবই কঠিন হয়ে উঠবে। যখন এমন কিছু ঘটে, তখন বোঝা যায় আমাদের মতো দেশ এবং অন্য সদস্যরা ভালো কিছু চাচ্ছি। দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক করতে হলে আলোচনা দরকার।’
নিজেদের মাঠে দুটি সিরিজ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরই দক্ষিণ আফ্রিকা টের পেয়েছে ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট শক্তিকেই যদি আর্থিকভাবে বড় তিন দল উপেক্ষা করে, সে ক্ষেত্রে অন্য দলগুলোর সঙ্গে তাদের আচরণটা কেমন হতে পারে, সেটাও বোধগম্য। এমন অবস্থায় আইসিসিকে কঠোর হতে বলছেন স্মিথ। তাঁর ধারণা, এমনটা চলতে থাকলে একদিন ক্রিকেটে এ তিন দেশ ছাড়া অন্য কোনো দল না-ও থাকতে পারে।
আর্থিক দুর্দশা একটা উদীয়মান শক্তিকে কীভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে, সেটা কেনিয়ার ক্ষেত্রে সবাই দেখেছেন। জিম্বাবুয়েও আর্থিক দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে না পেরে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।
স্মিথের ধারণা, এভাবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড যদি স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যায়, তবে বাকি সব দলই কেনিয়া-জিম্বাবুয়ের ভাগ্য বরণ করবে, ‘খেলাটায় এখন নেতৃত্ব দরকার। একে বুঝতে হবে বর্তমান জটিল পরিস্থিতির গুরুত্ব। আমার মনে হয় না বিশ্ব ক্রিকেট ১০ বছর পর শুধু তিন দলকেই একে অন্যের সঙ্গে খেলতে দেখতে চায়। এটা হলে খেলাটার কোনো লাভ হবে? কোনো লাভ হবে না। এতে যা হবে, টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর গুরুত্ব বাড়বে এবং এ লিগগুলো দিন দিন আকারে আরও বড় হবে এবং একদিন সদস্যদেশগুলোর জন্য কিছুই থাকবে না। আইসিসির নেতৃত্ব যদি এখন এ নিয়ে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এমনটাই হবে। কোভিডের কারণে এ সমস্যাগুলো আরও বড় হয়ে উঠেছে, আরও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আমার মনে হয় কিছু কিছু সমস্যায় আইসিসি নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে।’