স্যান্ডিমাউন্ট জায়গাটার নাম এমন কেন হলো কে জানে। পাহাড় কি কখনো বালু দিয়ে হয়? পাহাড়কে হতে হয় দৃঢ়। না হলে পাহাড়টা টিকবে কেন? কাল বাংলাদেশ দল স্যান্ডিমাউন্টের মাঠে অনুশীলন করল। নেটে দীর্ঘক্ষণ ঘাম ঝরালেন তামিম ইকবাল। দ্বিতীয় ম্যাচে মাঠেই নামা হয়নি; প্রথম ম্যাচে ৮০ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন। তবু মুখে হাসি নেই। আরও একটা সেঞ্চুরি যে ফেলে এসেছেন মাঠে। ব্যাটিং রেকর্ডে তামিম বাংলাদেশের বাকি সবার জন্যই পাহাড়; বালুর পাহাড় নয় অবশ্যই। তবে সেই পাহাড়ের উচ্চতা আরও বাড়তেই পারত।
এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৮ বার ৮০ থেকে ৯৯ রানের মধ্যে আউট হয়েছেন। নামের পাশে ২১টা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। ৮০ পেরোনো এতগুলো ইনিংস দুই অঙ্ক থেকে তিনে নিয়ে যেতে না-পারার কষ্ট তামিমকেও পোড়ায়। অঙ্ক মিলিয়ে তামিমও মনে করেন, নামের পাশে ৩৯ না হোক, আরও বেশি সেঞ্চুরি তো থাকতেই পারত!
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৪৫ ফিফটির বিপরীতে সেঞ্চুরি ১১টি। ক্লনটার্ফে যখন আউট হয়েছেন, তখনো ইনিংসের ১৩.২ ওভার বাকি। ঢের সময় ছিল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া তামিম এখন নিজেই নিজের সমালোচক, ‘ওই ১৮ বারের ১৫ বারই নিজের দোষে আউট হয়েছি। এমন কিছু করতে গেছি, যেটা করার দরকার ছিল না। গত ইনিংসে যেমন বল ছিল, তেমন শটও খেলেছি। দুর্ভাগ্য যে সোজা হাতে চলে গেছে, ভালো ক্যাচও ধরেছে। এভাবে যখন আউট হই, আফসোস থাকে না। তবে আফসোস তখনই হয়, যখন সেঞ্চুরিটা ফসকে যায়। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ম্যাচটা যদি শেষ করে আসতাম। আফসোস তো থাকবেই।’
ইনিংসের শুরুতে নামেন বলে সেঞ্চুরি করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি থাকে। অন্তত ওয়ানডেতে। রেকর্ডের দিক দিয়ে তো তামিম সতীর্থদের পথ দেখাচ্ছেন। তিন ধরনের ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি রান, সেঞ্চুরি তাঁর। টেস্ট-ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ফিফটিও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই তিন ধরনের ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করা ৯ ব্যাটসম্যানের একজন। তামিম ইকবালই এখন বাংলাদেশি ব্যাটিংয়ের পাহাড়চূড়া।
বেশ কিছুদিন ধরে পরিণত ব্যাটিংয়ে নতুন এক তামিমকে চেনাচ্ছেন। এখন আর ফিফটির পরই ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর বলে গুনে দেন না। বরং ফিফটিকে মাত্র ভিত্তি মনে করেন, এরপরই না হবে অট্টালিকা। কিন্তু এই নতুনের মধ্যেও পুরোনো সেই ছায়াটা থেকে যাচ্ছে। ভালো একটা ইনিংস খেলেও হতাশায় মাথা নাড়তে নাড়তে বের হয়ে আসা। দেয়ালটা ওঠে, দালান আর হয় না।
বড় ব্যাটসম্যানের বড় গুণ বলে ধরা হয় ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। বিরাট কোহলির ৪৯ ফিফটি আর ৪১টা সেঞ্চুরি ওয়ানডেতে। প্রায় অর্ধেকবারই ফিফটি পেরিয়ে সেটিকে সেঞ্চুরিতে নিয়ে যেতে পেরেছেন। রূপান্তর হার ৪৫.৫৬। হাশিম আমলার রূপান্তর হার ৪২.১৯ (২৭ সেঞ্চুরি ৩৭ ফিফটি)। দুই বছর আগেও কুইন্টন ডি ককের ফিফটির (৭) চেয়ে সেঞ্চুরিই (১০) বেশি ছিল। এখনো সেঞ্চুরি-ফিফটির সংখ্যা ১৪-২১; রূপান্তর হার চল্লিশের ওপরেই। আর ওয়ানডেতে তামিমের ৫৬টি পঞ্চাশ পেরোনো ইনিংস তিন অঙ্কে গেছে মাত্র ১১ বার। রূপান্তর হার ২০! যেটা আরও কমিয়ে দিয়েছে ক্লনটার্ফের ৮০।
আরও ৫ বছর খেলার লক্ষ্য ঠিক করেছেন। এভাবে সেঞ্চুরিগুলো হাতছাড়া না হলে নামের পাশে ৫০টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি থাকতেই পারত। এখন যে লক্ষ্য অনেক কঠিন হয়ে গেছে। সেঞ্চুরি সংখ্যায় ক্রিকেটের সেরা ১০ ব্যাটসম্যানের একজনের নাম হতো তামিম ইকবাল। এখন পর্যন্ত ৫০টি সেঞ্চুরির মাইলফলক পেরোতে পেরেছেন মাত্র ৮ জন। এখনো খেলে যাচ্ছেন এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি আছেন ক্রিস গেইল। কিন্তু ৪২ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করা গেইল বিশ্বকাপেই বিদায় নিতে চলেছেন। সেঞ্চুরির ফিফটি হয়তো তাঁরও ছোঁয়া হবে না। রস টেলর ও ডেভিড ওয়ার্নারের সেঞ্চুরি সংখ্যা যথাক্রমে ৩৮ ও ৩৫।
‘আফসোস করে লাভ নেই’ বলছেন বটে, কিন্তু এসব হিসাব কেবল দীর্ঘশ্বাসই বাড়ায় তামিমের, ‘যত সেঞ্চুরি সংখ্যা আছে, সেটা আরও সুন্দর দেখাত যদি মিস করা সেঞ্চুরির অর্ধেকও করতে পারতাম। যেটা চলে গেছে, চলে গেছে। আফসোস করে লাভ নেই। সামনে এটা ছুড়ে ফেলে আসতে চাই না। ভালো বলে শট খেলে আউট হলে আলাদা কথা। তবে সেঞ্চুরি আর ফেলে আসতে চাই না।’
দুইকে আমি তিন করি না—এ তামিমের নিজস্ব যাত্রাভঙ্গের কাব্য। যার লাইন তিনি আর বাড়াতে চান না।