সেই তারা, কোথায় তাঁরা

তাঁকে দিয়েই তামিমকে চিনত সবাই

জাতীয় দলের অধ্যায়টা অসম্পূর্ণই থেকে গেল নাফিসের। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় দলের অধ্যায়টা অসম্পূর্ণই থেকে গেল নাফিসের। ছবি: প্রথম আলো

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনের সকাল। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ক্যাপ্টেনস বক্সে নাফিস ইকবাল। সঙ্গে ছয় বছর বয়সী ছেলে নামির। দুজনের দৃষ্টি একজনের দিকে—তামিম ইকবাল। বাংলাদেশ দলের বাঁহাতি ওপেনার তখন ইনিংস নির্মাণে ব্যস্ত।
তামিমের খেলা দেখতেই স্টেডিয়ামে আসা নাফিসের। একটা সময় নাফিস যখন বাংলাদেশের হয়ে খেলতেন, তামিম ছিলেন দর্শক। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যানদের একজন হিসেবে ভাবা হচ্ছিল তাঁকে। সেটার প্রমাণও দিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু সেই চলতি পথেই হঠাৎ হারিয়ে গেলেন। ভূমিকা বদলে এখন তিনি ভাইয়ের খেলার নিয়মিত দর্শক।
‘নাফিসের ভাই আসছে’, শুরুতে এটাই ছিল তামিমের পরিচয়। কালক্রমে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের প্রায় সবগুলো রেকর্ড নিজের নামের পাশে লিখিয়ে ফেলা সেই তামিমের পরিচয়েই এখন পরিচিত হন নাফিস। অবশ্য এ নিয়ে আক্ষেপ নেই। বরং ছোট ভাইয়ের কীর্তিতে গৌরবান্বিত হন, অসম্পূর্ণ স্বপ্নটা পূরণ হওয়ার তৃপ্তি খুঁজে পান। যদিও ক্রিকেট-রোমান্টিকদের কাছে তামিমের চেয়ে নাফিসই অনেক বেশি ‘ক্ল্যাসিক’।
তবে সার্থক বড় ভাইয়ের মতো নাফিস সব বাহবা দিয়ে দিলেন তামিমকেই, ‘তামিম শুরু থেকেই প্রতিভাবান। জাতীয় দলে যখন ছিলাম, টিমমেটদের বলতাম, আমার ভাই আসছে। ও তখন অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলত। যেখানেই খেলত, একাই জিতিয়ে দিত। ওর স্ট্রোক খেলার সামর্থ্য ছোট থেকেই। ও আমার থেকে এগিয়েই ছিল।’
ঠিক ‘সাবেক’ তাঁকে বলা যাবে না। খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সেটা সীমাবদ্ধ কেবল ঘরোয়া ক্রিকেটের চৌহদ্দিতেই। নাফিস নিজেই বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন, ‘এখন জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া অনেক কঠিন। তবুও চেষ্টা করব টানা কয়েকটা মৌসুম ভালো খেলা। দেখা যাক কী হয়...।’ বহু দিন ধরে একটা স্বপ্ন লালন করছেন। কোনো একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচে হলেও দুই ভাই একসঙ্গে ওপেন করবেন। সেই স্বপ্নটাই এখনো তাড়িয়ে নিচ্ছে তাঁকে।
কিন্তু এমনকি হওয়ার কথা ছিল? নাফিস কি ফিরে তাকাবেন এক যুগ আগে বিকেএসপির সেই বিকেলটায়?
২০০৩ সালের অক্টোবর। বিকেএসপিতে সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের দেখা দিলেন সাহসী-সুন্দর নাফিস। অসহ্য গরমে ইংলিশরা এমনিতেই ঘামছিল। আসল তেজ হয়ে ঘামটা আরও বাড়ালেন নাফিস। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ‘এ’ করল ২৪২। এক নাফিসেরই ১১৮। সে ম্যাচটা আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে ফেরে যতটা না নাফিসের অসাধারণ ইনিংসের কারণে, তার চেয়ে বেশি ইংলিশ স্পিনারদের নিয়ে তাঁর বিস্ফোরক মন্তব্যে।

সংবাদ সম্মেলনে সেদিন ইংল্যান্ডের দুই স্পিনার অ্যাশলি জাইলস ও গ্যারেথ ব্যাটিকে ‘অর্ডিনারি’ সনদ দিয়ে ইংলিশ সাংবাদিকদের চোখ কপালে তুলে দিলেন। টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক লিখেছিলেন, “জাইলস ওই ‘অর্ডিনারি’ কথাটা এর আগে অনেকবার শুনেছেন। তবে মাত্র স্কুল পেরোনো ১৮ বছর বয়সী কারও মুখে শুনলেন এই প্রথম।”
জাতীয় দলে ঢোকার আগেই শোরগোল ফেলে দেওয়া নাফিসকে নিয়ে স্বপ্নের সীমানাটা আরও বড় হলো ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকা টেস্টে ১২১ রানের সেই ইনিংসটা খেলার পর। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ ও সিরিজ জয়ে তাঁর বিরাট ভূমিকা। বাংলাদেশ পেয়ে গেছে দুর্দান্ত এক ওপেনার—এমন স্তুতির ভার বেশি দিন বইতে পারলেন না। ২০০৫ সালের ১৮ জুন কার্ডিফে ওই অস্ট্রেলিয়া-বধ কাব্যই নাফিসের শেষ ওয়ানডে স্মৃতি। টেস্ট অধ্যায়টা শেষ হলো আরও এক বছর পরে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
স্বপ্নযাত্রা থেমে যাওয়ার পেছনে বছর আটেক আগের চোটকেই দায়ী করেন নাফিস, ‘নিজের কিছুটা দুর্ভাগ্য তো ছিলই। বাজে একটা চোটে এক-দেড় বছর ক্রিকেটই খেলতে পারিনি। ওটাই একটা বড় গ্যাপ তৈরি করে দিল। চোটের ওই সময়টা বড্ড কষ্টের। জাতীয় দলে নিজের জায়গা হারানো কতটা কষ্টের, বোঝানো কঠিন।’
নাফিসের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার যখন থমকে দাঁড়াল, ছোট ভাই তামিমের শুরু তখনই। দুই ভাইয়ের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর বিন্দুতে একটি দারুণ মিল—দুজনের টেস্ট অভিষেক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এমন আরও বহু মিল খুঁজে পাওয়া যেত, যদি একই সঙ্গে জাতীয় দলে খেলতেন। দুজনই ওপেনার। ডান হাতি-বাঁ হাতির দারুণ সমন্বয় গড়ে উঠতে পারত। ‘পারত’ অতীতবাচক পদ। নাফিস এখনো তাকিয়ে ভবিষ্যতের দিকে, ‘এখনো ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছি। অনেকে বলেন, দুই ভাইকে ওপেনিংয়ে দেখতে চাই। কখনো কখনো ভালোই লাগে শুনতে। আবার অনেক সময় খারাপ লাগে চাওয়াটা পূরণ করতে না পারায়। তবুও স্বপ্নটা এখনো জমিয়ে রেখেছি।’

ছেলে নামিরকে নিয়ে তামিমের খেলা দে​খতে স্টেডিয়ামে নাফিস। ছবি: প্রথম ​আলো

ক্রিকেটে আগের মতো ব্যস্ততা নেই। ব্যস্ততা বাড়ছে সংসারে আর ব্যবসায়। চট্টগ্রাম শহরের ইস্পাহানি মোড়ে হাইওয়ে প্লাজায় বন্ধুদের নিয়ে গত এপ্রিলে চালু করেছেন রেস্তোরাঁ ‘দম ফুঁক’। রেস্তোরাঁ নিয়ে বড় পরিকল্পনা তাঁর। পূর্ব নাসিরাবাদের ইভস সেন্টারে বন্ধুদের সঙ্গে খুলেছেন আরেকটি রেস্তোরাঁ। তবে কি ব্যবসায়ের দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন? নাফিসের জবাব, ‘এখনো ব্যবসায়ে পূর্ণ মনোযোগ দিইনি। আরও পাঁচ বছর ক্রিকেট খেলতে চাই, তারপর দেখা যাবে।’
তা না হয় খেললেন। কিন্তু ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ শুরুটা এমন সাদামাটাভাবে শেষ হওয়ার আক্ষেপ কি বুকের ভেতর মোচড় দেবে না? খান পরিবারের দ্বিতীয় টেস্ট ক্রিকেটার উত্তর দিলেন না। মৃদু হাসলেন। কোনো কোনো হাসিকে কেন জানি বড় বিষণ্ন লাগে!

আরও পড়ুন: