>সুইমিংপুলের পাশের রেস্তোরাঁয় স্ত্রী উম্মে আহমেদ আর মেয়ে আলায়নাকে নিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন সাকিব আল হাসান। সাক্ষাৎকারটা দিলেন খেতে খেতেই। তাঁকে পাওয়া গেল পুরোপুরি অন্য মেজাজে—রীতিমতো অকপট! অনেক কিছুরই বিশদ ব্যাখ্যা দিলেন। কিন্তু এড়িয়ে গেলেন কেবল একটিই—বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের করা মন্তব্য নিয়ে কিছু বলতে চান না বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক।
প্রশ্ন: ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ বাজেভাবে হারের পর প্রথম ওয়ানডেতে ছন্দ খুঁজে পেল বাংলাদেশ দল। এত সংক্ষিপ্ত সময়ে নিজেদের আবার গুছিয়ে নেওয়াটা কীভাবে সম্ভব হলো?
সাকিব আল হাসান: (হাসি) মনে হয় না এত সংক্ষিপ্ত সময়ে বদলানোর কিছু আছে। এখানে সংস্করণ একটা ব্যাপার। আমরা ওয়ানডেতে বেশি ভালো খেলি। টেস্ট গড়পড়তা দেশের মাঠে ভালোই খেলি। ভালো খেলি না দেশের বাইরে। গত পাঁচ-দশ বছরে আমাদের ক্রিকেট ইতিহাস এমনই। আমরা দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজ জিতেছি এই ওয়েস্ট ইন্ডিজে, যখন ওদের দলটা পুরো পাল্টে গেল। নতুন একটা দল এল। সেটার সঙ্গে টেস্ট জিতেছি দুটি। আরেকটা জিতেছি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। এই ১৮ বছরে তো আর বলার মতো টেস্ট জিতিনি দেশের বাইরে। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টে যেভাবে খেলেছি, আশা ছিল এর চেয়ে ভালো করব। সেটা হয়নি। যে ধরনের কন্ডিশন আমরা পেয়েছি, সে কন্ডিশনে আমরা কখনোই অভ্যস্ত নই। আপনি বিশ্বের যে দেশেই যান, ওয়ানডে বা সীমিত ওভারের ক্রিকেটে উইকেট ভালো থাকে। যে দল ভালো খেলে, তারাই জেতে। সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে ভারত ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকে হারাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ভারতে এসে ভারতকে হারিয়ে যাচ্ছে। ভারত নিউজিল্যান্ডকে হারাচ্ছে। এখন সীমিত ওভারের ক্রিকেট এমনই। এটাই পার্থক্য। এটা ছাড়া আর কিছু দেখছি না। ওয়ানডেতে আমরা ধারাবাহিক, সেটাও একটা কারণ।
প্রশ্ন: কন্ডিশনের কথা বলছিলেন, কিন্তু কদিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে শ্রীলঙ্কা তো টেস্ট সিরিজ ড্র করে গেল। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্যটা কোথায়?
সাকিব: শ্রীলঙ্কার ভালো কিছু ফাস্ট বোলার আছে। তাদের তিন-চারজন খুবই ভালো বোলার আছে। আমাদের যদি ওই মানের ফাস্ট বোলার থাকত, তাহলে মনে হয় আরও ভালো করতাম। আমাদের ব্যাটসম্যানরা সেভাবে ভালো করতে পারেনি। একটা ইনিংসেও ২০০ রান করতে পারিনি। যে কন্ডিশনই হোক, এটা আমাদের জন্য হতাশার। এ জায়গাগুলোয় আমাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে। সামনে যখন দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজ খেলতে যাব, আরও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: এই প্রস্তুতির আদর্শ জায়গা তো ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। কিন্তু সেখানে খেলার ব্যাপারে জাতীয় দলের অনেকেরই আগ্রহ দেখা যায় না। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সমস্যাটা আসলে কোথায়?
সাকিব: ঘাটতি আসলে...ভারতের মতো দল এত দিন ধরে খেলছে, তারাও এখন বাইরে গেলে অনেক সংগ্রাম করে। হ্যাঁ, ভারত জেতেও অনেক ম্যাচ। তাদের এত ভালো মানের খেলোয়াড় আছে, যে কারণে ওরা মাঝেমধ্যে ভালো করে ফেলে (বিদেশে)। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে একটা (টেস্ট) জিতেছে। এর আগে যখন ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছে, চার টেস্ট সিরিজের একটা জিতেছে। ওদের ফাস্ট বোলিং আক্রমণও দেখেন, এত দিন খেলার পর এতটুকু উন্নতি হয়েছে। ওরা আমাদের চেয়ে অন্তত ১০০ বছর আগে খেলা শুরু করেছে। তাহলে (হাসি)?
প্রশ্ন: টেস্টে উন্নতি করতে হলে বাংলাদেশকে আসলে কী করতে হবে?
সাকিব: দেশের মাঠে একটা উপায় তো আছেই। যেখানে আমরা বেশির ভাগই সফল। উপমহাদেশের বাইরে যদি টেস্টে উন্নতি করতে হয়, আমাদের সব দিকেই উন্নতি করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলি, ওয়েস্ট ইন্ডিজে দলে যারা গায়ানা থেকে আসে, তারা স্পিন একটু ভালো খেলে। যারা বারবাডোজ বা জ্যামাইকার, তারা ফাস্ট বোলিং ভালো খেলে। স্পিনে তারা দুর্বল। এই শক্তি বা দুর্বলতা হচ্ছে জন্মগত। চাইলে হঠাৎ কিছুতে শক্তিশালী বা দুর্বল হওয়া সম্ভব নয়। তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে উন্নতি করা সম্ভব। একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। চেষ্টা তো করতেই হবে। আমি যেটা বললাম, বিদেশে কঠিন কন্ডিশনে খেলার আগে প্রস্তুতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলাদাভাবে কোন খেলোয়াড়কে কী করতে হবে, সেটা ভালোভাবে বুঝতে হবে। তাদের নিজেদের ওপর দায়িত্বটা অনেক বেশি। এখানে সবারই দায়িত্ব আছে। খেলোয়াড়-বোর্ড সবার। যার যার জায়গা থেকে কাজগুলো ঠিকঠাক করলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: টেস্ট সিরিজে বাজে খেলার পর অনেক সমালোচনা হয়েছে দেশে...
সাকিব: জানি না কী সমালোচনা হয়েছে!
প্রশ্ন: অ্যান্টিগা টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪৩ রানে অলআউট হওয়াটা তো হজম করা কঠিন...
সাকিব: অপ্রত্যাশিত বিষয়ই তো। সাধারণত আমাদের এমন হয় না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্ম বলা হয় আপনাদের। সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর মতো ব্যাটসম্যান থাকতে কীভাবে একটা দল ৪৩ রানে অলআউট হয়?
সাকিব: আগেই বলেছি, টেস্টে আমাদের ফল অবশ্যই হতাশার। ১ রানে হারা যা,১০০ রানে হারাও তা। আরও ভালো খেলার সুযোগ ছিল আমাদের। জানি না কেন এমন হলো...হয়তো ওই ৪৩ রানে অলআউট হওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ানোর সাহসটা পাইনি!
প্রশ্ন: সাহস পাননি মানে! মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, সেটা থেকে বের হতে পারেননি?
সাকিব: এটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল যে আসলে আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি কি না। দলের কে কীভাবে চিন্তা করে, বলতে পারব না। আপনার ভাবনায় কী আছে, সেটা তো আমি বলতে পারব না।
প্রশ্ন: এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যে ম্যাচটা জিতেছেন, সে প্রসঙ্গে আসি। আপনি এবং তামিম ইকবাল সেদিন খুব ধীরলয়ে এগিয়েছেন। একে অপরের সঙ্গে কী আলোচনা করে এগিয়েছেন তখন?
সাকিব: আমরা যখন ব্যাটিং করি, কে কীভাবে খেলব, কেউ কাকে বোঝায় বলে মনে হয় না। বোঝালেও সেটা যে কাজে দেয়, তাও মনে হয় না। হ্যাঁ, যদি মনে হয় একজন জীবনের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলছে, তাকে কিছু বলা যেতে পারে। আমরা দুজনই এত বেশি খেলেছি একসঙ্গে, বলার তেমন কিছু নেই। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি কখন কীভাবে খেলতে হবে।
প্রশ্ন: আপনারা নিশ্চয়ই ঠিক করে নিয়েছিলেন, কত স্কোর গড়তে পারলে জেতার সম্ভাবনা থাকবে?
সাকিব: আমি ওভাবে লক্ষ্য ঠিক করি না। তবে এটা ঠিক মুশফিক ভাইয়ের ওই ইনিংসটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা যেভাবে ব্যাটিং করছিলাম, সেভাবে এগোলে হয়তো ২৪০-২৫০ হতো। মুশফিক ভাইয়ের কারণে সেটা ২৮০ পর্যন্ত গেছে। জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এই ইনিংসটা।
প্রশ্ন: আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারলে তো আপনারও সেঞ্চুরি হতে পারত...
সাকিব: সেঞ্চুরি মিস করলাম নিজের জন্য নাকি দলের জন্য? একটা মানুষই দুই রকম চিন্তা করে। আরেকটু ধৈর্য ধরে খেললে মানুষ বলবে সেঞ্চুরি হতো। আবার সেভাবে খেললে (ধৈর্য) বলবে দলের ভালো স্কোর এনে দিতে আরও দ্রুত রান করার দরকার ছিল। একেকজন একেকভাবে মন্তব্য করবে, এ নিয়ে কিছু নাই-বা বলি।
প্রশ্ন: ওয়েস্ট ইন্ডিজে আপনার কিছু ভালো স্মৃতি আছে। ২০০৭ বিশ্বকাপ, ২০০৯...এবার ওয়ানডে জিতলেন। পুরোনো স্মৃতি ক্যারিবীয় সফরে ভালো করতে কতটা অনুপ্রাণিত করে?
সাকিব: ওভাবে চিন্তা করি না। তবে ২০০৭ বিশ্বকাপটা সব সময়ই মনে থাকে। সেটা ছিল আমার প্রথম বিশ্বকাপ। অন্য রকম অভিজ্ঞতা ছিল আমার জন্য। একটা ১৯ বছরের ছেলে এমন জায়গায় বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে, ওটা সব সময়ই বিশেষ কিছু। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এলে বিশ্বকাপের কথা বেশি মনে পড়ে।
প্রশ্ন: গায়ানার মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড়ের খেলা বেশি ভালো লাগে? আপনার কথাই বেশি বলেছে তারা।
সাকিব: সেটাই তো স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু কি বলেছে (হাসি)?
প্রশ্ন: আপনি ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) খেলেন, সে জন্যই কি?
সাকিব: আইপিএলও ভূমিকা রাখে। এখানে অনেকেই আইপিএল দেখে।
প্রশ্ন: ওয়ানডে সিরিজটা জিততে কতটা আশাবাদী?
সাকিব: এখন জেতা উচিত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে। আমাদের আরও বেশি মনোযোগী থাকতে হবে।
প্রশ্ন: মাশরাফি বিন মুর্তজা যোগ দেওয়ার পরই দল সাফল্য পেল। দলের চেহারা বদলে দিতে তাঁর বিশেষ কোনো উদ্যোগ ছিল?
সাকিব: সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন মাশরাফি ভাই। এটা সব সময়ই যে কাজে দেয়, সেটা বলা যেমন ভুল, আবার একেবারে কাজে দেয় না, সেটা বলাও ভুল। তিনি সবাইকে উৎসাহিত করতে পারেন, উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, উজ্জীবিত করতে পারেন। সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে পারেন। এটাই তাঁকে সহায়তা করে।
প্রশ্ন: ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর দিয়ে আপনার টেস্ট অধিনায়কত্বের দ্বিতীয় পর্ব শুরু। দল দুই টেস্ট খারাপ করতেই আপনার অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটা নিয়ে কতটা বিচলিত?
সাকিব: আমাকে এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে, আমি কি চেয়ে নিয়েছি? যখন বোর্ড মনে করবে আরেকজন আমার চেয়ে ভালো, তাকে দিয়ে দেবে। এটা আমার কোনো ব্যাপার নয়। বোর্ড আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে, আমি সেটা ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছি। আমার কাজ হচ্ছে খেলোয়াড় হিসেবে ভালো খেলা, দলের জয়ে অবদান রাখা।
প্রশ্ন: বিসিবি সভাপতি বলেছেন, টেস্ট খেলার প্রতি আপনার আগ্রহ নেই। এ নিয়ে কী বলবেন?
সাকিব: (অনেকক্ষণ চুপ থেকে) এ বিষয়টি বাদ দিন।