রক্ষণাত্মক কৌশল নিয়েই টেস্ট সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ দল। সেন্ট জর্জেস পার্কের ব্যাটিং উইকেটেও তাই দলে চার বিশেষজ্ঞ বোলার।
যেতে যেতে থেমে গেলেন চার্লস রেইনসফোর্ড। সেন্ট জর্জেস পার্ক স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, বাংলাদেশ কেন মাত্র চার বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে খেলছে?’ উত্তরটাও ধারাভাষ্যকার হয়ে যাওয়া সাবেক জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটারের অজানা নয় বলেই মনে হলো। ‘ব্যাটিং অর্ডার লম্বা করতে’ বলতেই ওপরে-নিচে মাথা নেড়ে রেইনসফোর্ড বুঝিয়ে দিলেন, তিনি নিজেও সেটা ধরতে পেরেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের শুরু থেকেই বাংলাদেশ দলের নীতি রক্ষণাত্মক। জয়ের চিন্তা পরে, আগে চেষ্টা করতে হবে ড্রয়ের সম্ভাবনা জাগানোর। সেটি করা গেলে সুযোগ বুঝে না হয় জয়ের জন্যও ঝাঁপানো যাবে। এই নীতি থাকলে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট নেওয়ার চেয়ে একটা দল ব্যাটিংয়েই বেশি সময় কাটাতে চাইবে স্বাভাবিক।
ডারবানের পর পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টেও বাংলাদেশের একাদশে সেই আকাঙ্ক্ষাই ফুটে উঠেছে। সাত বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের সঙ্গে চার বোলার। অবশ্য যেকোনো পরিস্থিতিতে দলকে ব্যাট হাতেও ভরসা দিতে পারা মিরাজকে ধরলে ব্যাটসম্যানের সংখ্যাটা আটই হয়ে যায়। দুই টেস্টের বোলিং আক্রমণে পার্থক্য শুধু সমন্বয়ে। ডারবানে ছিলেন তিন পেসার, এক স্পিনার। তাসকিন আহমেদ দেশে ফিরে যাওয়ায় এখানে পেসার খালেদ আহমেদ আর ইবাদত হোসেন। স্পিনে মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে যোগ হয়েছেন অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলাম।
দলে আরও দুই পেসার আবু জায়েদ ও শহীদুল ইসলাম থাকলেও এই সিরিজে তাঁদের খেলানোর চিন্তা টিম ম্যানেজমেন্টের কখনোই ছিল না। আর এ ধরনের উইকেটে পেসারদের মধ্যে যাঁর বল বেশি কার্যকর হতে পারত, সেই মোস্তাফিজুর রহমান তো টেস্ট ক্রিকেট থেকে অলিখিত নির্বাসনই নিয়েছেন। বর্তমানে আইপিএলে ব্যস্ত এই বাঁহাতি পেসারের নিজের যেমন টেস্ট খেলার প্রতি অনীহা, তেমনি বিসিবিও যেন নীতি নিয়েছে মোস্তাফিজকে শুধু সাদা বলের ক্রিকেটে খেলানোর। এক বছর ধরেই তাই টেস্টে মোস্তাফিজকে পাচ্ছে না বাংলাদেশ দল।
দক্ষিণ আফ্রিকার যে পেস-সহায়ক কন্ডিশনের কথা সবাই জানে, এবারও সে রকম থাকলে টেস্টে তাদের হারানোর চিন্তাটা আসলেই বাড়াবাড়ি মনে হতো। ড্রয়ের লক্ষ্যই তখন হতো স্বাভাবিক। কিন্তু এই সিরিজে বাংলাদেশ তেমন কন্ডিশনে টেস্ট খেলছে না যে কানের পাশ দিয়ে ধাই ধাই করে বল চালে যাবে, বাউন্সারে নত হবে ব্যাটসম্যানদের মাথা!
ডারবান টেস্টের উইকেট নিয়ে একটু ধোঁয়াশা থাকলেও সেটি যে ব্যাটিং-সহায়কই হবে, দলে দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ থাকার সুবাদে তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। সেন্ট জর্জেস পার্কের উইকেট নিয়ে তো সে রকম কোনো ধোঁয়াশাও ছিল না। শুরু থেকেই সবাই জানেন, এটি ব্যাটসম্যানদের উইকেট। পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টের প্রথম দিনে তা আরও পরিষ্কার। দিনের শুরুর দিকে রেইনসফোর্ডও তাই বলেছিলেন, ‘এই উইকেট কিন্তু ডারবানের উইকেটের চেয়েও বেশি ব্যাটিং-সহায়ক হবে।’ আর সেটি বুঝতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তাঁর মনে খোঁচাচ্ছিল—বাংলাদেশ কেন মাত্র চার বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে খেলছে!
শুধু ‘ব্যাটিং অর্ডার লম্বা করতে’ বলে আসলে রেইনসফোর্ডকে অসম্পূর্ণ উত্তরই দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে যোগ করা যেতে পারত, ‘ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাসের অভাবও এর একটা কারণ।’ খেলাটা যখন ব্যাটিং উইকেটে হবে, স্বাভাবিকভাবেই আপনি ধরে নেবেন, দলের সেরা ব্যাটসম্যানরা সেই উইকেটে বড় রান করবেন। ইনিংস লম্বা করতে ৭-৮ নম্বর ব্যাটসম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকা লাগবে না। বরং প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরাও যেহেতু উইকেট থেকে সুবিধা পাবেন, একজন ব্যাটসম্যান কম নিয়ে বোলিং লাইনআপটাই বেশি সমৃদ্ধ রাখা উচিত। তাতে বড় জুটি ভাঙতে অধিনায়কের হাতে পর্যাপ্ত বিকল্প থাকে। সেটি ছিল না বলেই প্রথম টেস্টে বল হাতে নিয়েছেন অধিনায়ক মুমিনুল হক; সেই টেস্টে এবং কালও বোলিং দিতে হয়েছে নাজমুল হোসেনকেও।
তবু রক্ষণাত্মক চিন্তা আর ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাসের অভাব মিলিয়ে একাদশ সাজাতে গিয়ে সবার আগে সম্ভাব্য ব্যাটিং বিপর্যয় সামলানোর কথাটাই মাথায় আসে টিম ম্যানেজমেন্টের। ব্যাটসম্যান বেশি থাকলে ওপরের দিকে বড় জুটি না হলেও পরের দিকে লজ্জা এড়ানোর একটা আশা থাকে। কিন্তু এই চিন্তাই-বা ডারবানে কী দিয়েছে বাংলাদেশকে?
দীর্ঘ ব্যাটিং লাইনআপ নিয়েও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ রানে অলআউট, শেষ দিনে ৫৫ মিনিটে পড়েছে শেষ ৭ উইকেট! টেস্টের পঞ্চম দিনেও ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিন না হয়ে পড়া উইকেটে ও রকম বিপর্যয়ের একটাই কারণ ছিল, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগা ব্যাটসম্যানদের অকারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়া। আবার এটাও ঠিক, ব্যাটিং অর্ডারটা লম্বা ছিল বলেই শুরুটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার পরও প্রথম ইনিংসের শেষ পর্যন্ত ২৯৫ করা গেছে।
কিন্তু তাতে বাংলাদেশের টেস্ট দর্শনটা কি বদলাচ্ছে? জয়ের চিন্তাটাই যে নেই সেখানে!