শাহরিয়ার নাফীস
শাহরিয়ার নাফীস

টি–টোয়েন্টির রসায়ন আমরাও জানি

বাংলাদেশের প্রথম টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক তিনি। দেখেছেন টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের একাল–সেকাল।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মৌসুম যেহেতু, টি–টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে অনেক স্মৃতিই মনে উঁকি দিচ্ছে। বিশেষ করে মনে পড়ছে এই সংস্করণের ক্রিকেটে আমার শুরুর কথা। ২০০৬ সালের স্মৃতি।

সেবার বাংলাদেশে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে এসেছিল জিম্বাবুয়ে দল। মূল সিরিজের আগে দুই বোর্ড মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, সিরিজে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচও হবে। আর সেই ম্যাচটিই হয়ে যায় বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। খুলনায় সে ম্যাচটা আমরা বেশ স্বচ্ছন্দেই জিতে যাই। সৌভাগ্যবশত আমিই ছিলাম নিজেদের প্রথম টি–টোয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক।

তখন অবশ্য টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ব্যাপারে আমাদের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। এটা নিয়ে আমাদের খুব উৎসাহও ছিল না। সত্যি বলতে কি, টি-টোয়েন্টিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ সংস্করণই মনে হতো না তখন। দর্শক মাঠে টানার জন্য ভালো। ক্রিকেট–বাণিজ্যের জন্য ভালো। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমিও ২০ ওভারের খেলাকে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। তবে এখন বুঝি, আমার চিন্তাটা ভুল ছিল। টি-টোয়েন্টি যে এত অল্প সময়ে এত জনপ্রিয় হয়ে যাবে, ক্রিকেটের মূলস্রোতে চলে আসবে, এটা আমি তখন বুঝতে পারিনি।

প্রথম ম্যাচটির দিকে যদি ফিরে তাকান, দেখবেন দলে তেমন কোনো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিল না। অভিজ্ঞদের মধ্যে শুধু মনে হয় রফিক (মোহাম্মদ রফিক) ভাই ছিলেন। সুমন (হাবিবুল বাশার) ভাই ওয়ানডে দলের অধিনায়ক ছিলেন, আমি ছিলাম সহ–অধিনায়ক। যেহেতু অভিজ্ঞরা ছিলেন না, আর আমি তখন ওয়ানডের সহ–অধিনায়ক, সে কারণেই টি–টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক করা হয়। আর তাতে আমিও ইতিহাসের অংশ হয়ে যাই। ম্যাচটা আমরা খুব করে জিততে চাচ্ছিলাম। টি–টোয়েন্টিতে প্রথম ম্যাচটা শুরু করতে চাচ্ছিলাম জয় দিয়ে। শেষ পর্যন্ত আমাদের আশা পূরণ হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই দলের সবার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা ছিল ওই ম্যাচ। কারণ, এর আগে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটেও খুব বেশি টি-টোয়েন্টি খেলিনি। আমার যত দূর মনে পড়ে, ২০০৪-০৫ সালের দিকে একবার প্রিমিয়ার লিগ হয়নি। তখন করপোরেট লিগ হয়েছিল টি-টোয়েন্টি সংস্করণে। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি খেলার আগে ওই একবারই আমরা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি খেলেছিলাম। তবে আমাদের একটা ধারণা ছিল যে যেহেতু ২০ ওভারের খেলা, আমাদের মেরে খেলতে হবে। ২০ ওভারে ১৪০-১৫০ রান করতে হবে।

টি-টোয়েন্টি বলেই বিসিবি সেবার খুব তরুণ একটি দল বেছে নিয়েছিল। হাই পারফরম্যান্স দল থেকে অনেকেই এসেছিল টি–টোয়েন্টি দলে। অভিজ্ঞ বলতে আমরাই ছিলাম, কিন্তু আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে আমরাও ছিলাম নতুন। আমি, মাশরাফি, রাজ্জাক, আফতাব ভাই ছিলেন। রফিক ভাইয়ের কথা তো আগেই বলেছি।

একদম নতুন সংস্করণ হওয়ায় খেলাটা বুঝতেই অনেক সময় লেগেছে। এখনকার মতো বিশ্লেষণ, অনুশীলন তখন ছিল না। তবে একটা সাধারণ ধারণা ছিল যে বলের চেয়ে বেশি রান করতে হবে। যদি ১০ বল খেলি, আমাকে অন্তত ১৫ রান করতে হবে। ১২০ বলের খেলা, আমাদের ১২০–এর চেয়ে বেশি রান করতেই হবে—এটাই ছিল ভাবনা। পরে যত সময় গেছে, টি-টোয়েন্টির ধারণা ততই বদলেছে।

সেই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ দলের টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং এখন অনেকটাই ভালো হয়েছে। আমাদের প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি আসে ২০১৩ সালে। ২০২১ সালে এসে টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির সংখ্যা ১০ ছাড়িয়ে গেছে। অনেকেরই একাধিক টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি আছে। সেদিক থেকে এটা বলাই যায় যে আমরা ব্যাটিংয়ে উন্নতি করছি। টপ অর্ডার অনেক উন্নতি করেছে। কিন্তু মিডল ও লোয়ার মিডল অর্ডারে বড় শট খেলার ব্যাটসম্যানের অভাব সব সময়ই ছিল।

তবে আমার মনে হয়, আমাদের টি-টোয়েন্টি ভাবনায় একটু বদল আনা দরকার। যেমন আমরা সব সময় সফল দলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ দলের তুলনা করি। সবাই মনে করে টি–টোয়েন্টি মানেই ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট। তরুণেরাই এখানে ভালো করবে। কিন্তু এই সংস্করণে অনেক দক্ষতারও প্রয়োজন। ক্রিস গেইল টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান। তিনি কিন্তু এক শ টেস্ট খেলা ক্রিকেটার, দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরির মালিক। যদি একটা খেলা টানা পাঁচ দিন চাপের মুখে ভালো খেলতে পারেন, তাহলে ওই খেলাটা ২০ ওভারেও আপনি অনেক ভালো খেলতে পারবেন।

টি–টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বোলিং নিয়ে আশাবাদী শাহরিয়ার নাফীস

সেদিক থেকে আমরা খুবই তরুণ একটা দল। টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের ইতিহাস মাত্র ২০ বছরের। এ কারণে আমরা যতটা না সফল হব ধরে নিয়েছিলাম, ততটা হতে পারিনি। যেদিন আমরা টেস্ট ক্রিকেটে ভালো অবস্থানে থাকব, সেদিন টি-টোয়েন্টিতেও দারুণ একটা দলে পরিণত হব। সফল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারদের বেশির ভাগই টেস্টেও ভালো ক্রিকেটার। আমাদের ক্রিকেটীয় ইতিহাস যত সমৃদ্ধ হবে, ততই আমরা টি-টোয়েন্টিটাও ভালো খেলব।

আশা করি সেটার শুরু এই টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেই হবে। এবার দলটা যে জয়ের অভ্যাস নিয়ে যাচ্ছে, এটাই আমাকে আশাবাদী করছে। এর আগে আমরা মূল পর্বে ভালো কিছু করিনি। কিন্তু এবার আমরা বেশ ছন্দ নিয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছি। আমরা এখন প্রতিযোগিতা করার মতো অবস্থায় আছি। আমাদের বোলিং খুবই ভালো। কে কখন, কোন কন্ডিশনে খেলবে—এসব ক্ষেত্রে আমাদের ধারণা খুব পরিষ্কার। ছোট সংস্করণে সফল হতে বোলিংয়ে যা যা থাকা দরকার, তা আমাদের এখন আছে।

বিশ্বকাপে আমি বাংলাদেশের বোলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকব। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর হাতে এবার অনেক বৈচিত্র্য আছে। মোস্তাফিজের মতো বিশ্বসেরা বোলার আছে বাংলাদেশ দলে। সাকিব আল হাসানের বাঁহাতি স্পিনার আছে। দলে অফ স্পিনার আছে। যদি গতির প্রয়োজন হয় তো তাসকিন আছে। এ ছাড়া পেসার যাঁরা আছেন, প্রত্যেকেই একজন আরেকজন থেকে ভিন্ন, বোলিং বৈচিত্র্যময়। বিশ্বকাপে এই বোলিং আক্রমণই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।

সবশেষে বলব, ২০০৬ সালে আমরা টি–টোয়েন্টি খেলতে নেমেছিলাম অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমানোর মতো। এখন পরিস্থিতি সে রকম নয়। টি–টোয়েন্টির রসায়ন এখন আমরাও জানি। মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্বকাপের দিকে আমি তাই আশা নিয়েই তাকিয়ে থাকব।