টসের সাকিব স্পিনের সাকিব

সাকিব আল হাসান
সাকিব আল হাসান
>

চট্টগ্রাম টেস্টের পর মিরপুরেও টস জিতলেন সাকিব। যেটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার উপায় নেই। টসে তাঁর ‘দক্ষতা’ ব্যাটিং–বোলিং ফিল্ডিংয়ে দক্ষতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো। অধিনায়ক হিসেবে এটি তাঁর ১৩ নম্বর টেস্ট। এর ১১টিতেই টস জিতেছেন সাকিব!

দিন শেষে ৫৫ রানে অপরাজিত সাকিব আল হাসান। ম্যাচের প্রেক্ষাপটে, সিরিজের প্রেক্ষাপটে যেটির মূল্য অন্য অনেক ম্যাচের ৫৫ রানের চেয়ে বেশি। সিরিজে জেতা না-জেতার টেস্ট বলে কথা!


উইকেটের কথা মনে রাখলে মূল্যটা আরও বেশি। তবে ম্যাচ শুরুর আধঘণ্টা আগেই যা করেছেন সাকিব, তার তুলনায় অবশ্যই বেশি নয়।
প্রথম ইনিংসের ব্যাটিংই শেষ হয়নি। দ্বিতীয় ইনিংস তো পড়েই আছে। বোলিংয়েও কিছু না কিছু অবশ্যই করবেন। তবে সেসবের মূল্যও ম্যাচ শুরুর আধঘণ্টা আগে যা করেছেন, সেটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। তা কী করেছেন সাকিব? টস জিতেছেন।


তা টস জেতাটা কি আর কোনো কৃতিত্ব নাকি! বলেন কী, দেশের মাটিতে ‘ডিজাইনার পিচ’-এর যে ফর্মুলায় চলছে বাংলাদেশ, তাতে ‘টস জেতা মানে ম্যাচ জেতা’ কথাটার তো ‘ক্যাচ ফেলা মানে ম্যাচ ফেলা’র মতোই আপ্তবাক্য হয়ে ওঠার উপক্রম।

অধিনায়ক ব্যাটসম্যান হলে তাঁর কাছে দল রান চায়। বোলার হলে উইকেট। আর অধিনায়ক সাকিবের মতো অলরাউন্ডার হলে তো রান-উইকেট দুটিই। তবে বছর দুয়েক ধরে চট্টগ্রাম আর ঢাকার টেস্ট উইকেট যেমন বানানো হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ অধিনায়কের কাছে সবচেয়ে বড় চাওয়া হয়ে উঠছে এটি—রান করো বা না করো, উইকেট নাও বা না নাও, টসটা অবশ্যই জেতো ভাই। জিতে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করার দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচাও।


তা টস কি আর ইচ্ছা করলেই জেতা যায়! ওটা তো পুরোপুরিই ভাগ্যের ব্যাপার। নাকি কোনো টোটকা আছে! বাংলাদেশের প্রথম টেস্টজয়ী অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে ফোন করলাম। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘না রে ভাই, কোনো টোটকা নেই। ওই যে বলে না, “টেইল ইউ উইন, হেড ইউ লুজ”, ফালতু কথা। অনেকে বলে কয়েনের যেদিকে ছবি থাকে, সেই দিকটা ভারী থাকে। সেটি তাই ওপরে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এটাও ঠিক না। পুরোটাই ভাগ্য।’


ক্রিকেটের ক্যাপ্টেনসি নিয়ে রিচি বেনোর একটা কথা অমরত্ব পেয়ে গেছে—ক্যাপ্টেনসির ৯০ পার্সেন্টই লাক, ১০ পার্সেন্ট স্কিল। তবে দোহাই লাগে, ওই ১০ পার্সেন্ট ছাড়া ওটা চেষ্টা করতে যেয়ো না। অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তিতুল্য অধিনায়ক অবশ্য টসে জেতাটাকে পুরোপুরি ‘লাক’ বলে মানতে চাইতেন না। বরং উল্টো একটা কথাই বলেছিলেন, ‘একজন গ্রেট ক্যাপ্টেনের বড় পরিচায়ক হলো ঠিক সময়ে টস জিততে পারা।’


এই বিচারে সাকিব আল হাসান কিন্তু এখনই ‘গ্রেট ক্যাপ্টেন’-এর স্বীকৃতি পেয়ে যান। চট্টগ্রাম টেস্টের পর মিরপুরেও টস জিতলেন। যেটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার উপায় নেই। টসে তাঁর দক্ষতা (যদি শব্দটা এখানে ব্যবহার করা যায়) ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে দক্ষতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো। অধিনায়ক হিসেবে এটি তাঁর ১৩ নম্বর টেস্ট। এর ১১ টিতেই টস জিতেছেন সাকিব!


চট্টগ্রামেরটাও জরুরি ছিল। মিরপুরে হয়তো আরও বেশি। কারণ, স্পিননির্ভরতাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ এই টেস্টে নেমেছে অল-স্পিন অ্যাটাক নিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চতুর্থ ইনিংসে না পেলে এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ এই সিদ্ধান্ত আরও বড় প্রশ্নের ফণা তুলত। চট্টগ্রামেও চার স্পিনার খেলিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সেখানে সবেধন নীলমণি হয়ে একজন পেসার ছিলেন। তবে দুই ইনিংসে দুই-দুই করে মাত্র চার ওভারই বোলিং করার সুযোগ পেয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। মিরপুরে তাই তাঁকে ‘অহেতুক’ ফিল্ডিংয়ের কষ্ট দিতে চায়নি বাংলাদেশ। যত দূর জানা যাচ্ছে, এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তটা অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের।


চার পেসার নিয়ে অনেক দলই টেস্ট খেলেছে। তবে ‘পেস কোয়ার্টেট’ কথাটা বললে সবাই ধরেই নেন যে সর্বজয়ী ওই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা হচ্ছে। সূচনাটা অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং ও কলিন ক্রফটের হাত ধরে। পরে ক্রফটের জায়গা নেন ম্যালকম মার্শাল। ফাস্ট বোলার চতুষ্টয় নিয়ে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ব শাসন করেছে। লয়েডের কাছ থেকে যে মশাল হাতে পেয়ে নিভতে দেননি ভিভ রিচার্ডসও।


‘পেস কোয়ার্টেট’ শব্দবন্ধ যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের নামে পেটেন্ট করা থাকে, ‘স্পিন কোয়ার্টেট’ অবশ্যই ভারতের নামে। তবে এই মিরপুর টেস্টের পর বাংলাদেশও সেটির দাবিদার হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। বিষেন সিং বেদি, ভগবৎ চন্দ্রশেখর, এরাপল্লি প্রসন্ন ও শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবনকে নিয়ে গড়া ভারতের বিখ্যাত স্পিন কোয়ার্টেটের ২৩১ টেস্টে ৮৫৩ উইকেট। তবে চতুষ্টয়ের মধ্যে দুই অফ স্পিনার প্রসন্ন ও ভেঙ্কটরাঘবন ক্যারিয়ারজুড়েই নিজেদের মধ্যে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলেছেন। চারজনই একসঙ্গে খেলেছেন একটি মাত্র টেস্টেই। বিস্ময়করভাবে সেটি ভারতে নয়। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড সফরে বার্মিংহামের এজবাস্টনে। দুই টেস্টে চার স্পিনার খেলিয়ে বাংলাদেশ এক অর্থে তাই ছাড়িয়েই গেল ভারতীয় চতুষ্টয়কে।


একটা ফাঁক অবশ্য আছে। ভারতের ওই চারজনই ছিলেন নির্ভেজাল স্পিনার। যেখানে সাকিব আল হাসান ব্যাটসম্যান হিসেবেও অবলীলায় দলে আসতে পারেন। তবে একটা রেকর্ড বোধ হয় করেই ফেলেছে বাংলাদেশ। সৌম্য সরকার মিডিয়াম পেস বোলিং করেন, হয়তো এই টেস্টেও কয়েক ওভার করবেন। সেটিকে ধর্তব্যের মধ্যে না নিলে টেস্ট ইতিহাসে এটাই হয়তো পেসারহীন প্রথম একাদশ!


ভারতীয় স্পিন কোয়ার্টেটের ওই টেস্টের কথা ভাবছেন? সেটিতে ভেঙ্কটরামন সুব্রামানি নামে এক পেসার ছিলেন। প্রথম ইনিংসে তাঁর সঙ্গে বোলিং শুরু করেছিলেন বুধি কুন্দেরন। এমনিতে উইকেটকিপার, তবে সেই টেস্টে খেলেছিলেন ওপেনার হিসেবে। ৪ ওভার মিডিয়াম পেস বোলিংও করেন। ১৮ টেস্টের ক্যারিয়ারে সেই প্রথম, সেই শেষ।


পেসারহীন বাংলাদেশ দল দেখে ক্ষুব্ধ এক ক্রিকেট অনুরাগী খুদে বার্তা পাঠালেন, ‘এটি টেস্ট ক্রিকেটের অপমান। বাংলাদেশের পেসারদের উচিত, এর প্রতিবাদে অনশন করা।’


এটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাবে। তবে ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’-এর নামে এমন মাত্রা ছাড়ানো কাণ্ড ঘটতে থাকলে ভবিষ্যতে কী হবে, কে জানে! টস তুলে দিয়ে সফরকারী দলকে ব্যাটিং বা বোলিং বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়াতেই কি খোঁজা হবে সমাধান!