ঢাকা টেস্টে খেলবেন, প্রবীণ জয়াবিক্রমা যখন তা জেনেছেন, তখন কি তাঁর মধ্যে আলাদা এক উত্তেজনা কাজ করেনি? মিরপুরে স্পিনারদের রাজত্বের কথা যদি জানা থাকে জয়াবিক্রমার, তাহলে তো মিরপুরে বল হাতে নামতে ব্যাকুল না হয়ে তিনি পারেন না! মিরপুরে খেলার কথা শুনলেই যে স্পিনারদের জিবে জল চলে আসার কথা!
যেসব মাঠে শেষ ১০ বছরে (বাংলাদেশ–শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর আগে) অন্তত ১০টি টেস্ট খেলা হয়েছে, তাদের মধ্যে স্পিনারদের গড় ত্রিশের নিচে ছিল একমাত্র মিরপুরেই। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এই সময়ে ১৪ ম্যাচে ২৮.৮৬ গড়ে ২৮৬টি উইকেট গেছে স্পিনারদের পকেটে। শেষ ১০ বছরে স্পিনাররা মিরপুরের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন আর একটি মাঠেই। শ্রীলঙ্কার গলে ১৮ ম্যাচে ৪০৮ উইকেট স্পিনারদের, তবে গড়টা ৩০.২০। তবে এ দুটি মাঠেই শুধু স্পিনারদের স্ট্রাইক রেট ৬০–এর নিচে ছিল। গল কিংবা মিরপুর, এই দুই স্টেডিয়ামেই যে স্পিনারদের সময়টা উপভোগ্য হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই তাই!
জয়াবিক্রমার অভিষেক বাংলাদেশের সঙ্গেই। গত বছর পাল্লেকেলেতে অভিষেকেই ১১ উইকেট পেয়ে যান জয়াবিক্রমা। প্রথম ইনিংসে ৬ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলা পরের দুটি টেস্টই হয় গলে। সেই দুই ম্যাচে ৭ উইকেট নেওয়া জয়াবিক্রমা এ বছর ভারতের বিপক্ষে বেঙ্গালুরু টেস্টে পান ৭ উইকেট। চার টেস্টে ২৫ উইকেট নিয়েই বাংলাদেশে আসা জয়াবিক্রমা বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম খেললেন মিরপুর । কিন্তু স্পিনবান্ধব সেই মিরপুরেই জয়াবিক্রমার ‘শেষ হলেই বাঁচি’ অবস্থা।
সেখানে লঙ্কান স্পিনারদের মনে রাখার মতো এক অভিজ্ঞতাই হয়েছে। সাফল্যের কথা যেমন মনে থাকে, এমন ‘অন্য রকম’ অভিজ্ঞতার কথাও তো চাইলেই ভোলা যায় না। লঙ্কান স্পিনাররা প্রথম ইনিংসে ৫৮ ওভার বল করেও কোনো উইকেটের দেখা পাননি। মিরপুরে এমন ঘটনা যে অস্বাভাবিক, তা না বললেও চলছে! কারণ ইনিংসে বিশ ওভারের বেশি বল করেও মিরপুরে উইকেটশূন্য থাকার ঘটনা আর আছেই তো মাত্র দুটি।
তার মধ্যে একটিতে দুর্ভাগ্য দেখা দিয়েছিল বাংলাদেশি স্পিনারদেরই। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক টেস্টে বাংলাদেশের স্পিনাররা ৩৪ ওভার বল করেও উইকেট পাননি। ২০১৮ সালে আরেক টেস্টে দুর্ভোগের শিকার জিম্বাবুয়ের স্পিনাররা। ৮৩ ওভার বোলিং করেও উইকেটশূন্য ছিলেন তাঁরা।
মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কান স্পিনারদের কোন উইকেট না পাওয়ার ঘটনাটা যে এক মহাবিস্ময়ই, সেটি বুঝতে হলে ফিরে যেতে হয় ৩৭ বছর আগে। সেই ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে শ্রীলঙ্কান স্পিনাররা ৫৬ ওভার বল করেও ছিলেন উইকেটশূন্য। এরপর এই প্রথম, এশিয়ার মাটিতে ইনিংসে ৪০ ওভারের বেশি বল করেও উইকেটশূন্য থাকলেন লঙ্কান স্পিনাররা।
এশিয়ার বাইরে সাধারণত স্পিনারদের সময়টা সুখকর হয় না তেমনটা। তবে সেখানেও এমন পরিস্থিতির সঙ্গে খুব একটা পরিচিতি ঘটেনি লঙ্কান স্পিনারদের। এশিয়ার বাইরে ইনিংসে ৪০ ওভারের বেশি বল করেও যে তাদের উইকেটশূন্য থাকার ঘটনা মাত্র তিনবার। তার একটি রমেশ-জয়াবিক্রমাদের কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে দেওয়ার কাজটাও করতে পারে।
রমেশ মেন্ডিস, প্রবীণ জয়াবিক্রমা, ধনাঞ্জয়া ডি সিলভাদের চেয়েও বেশি উইকেটবিহীন খাটুনি যে গেছে আরও কয়েক লঙ্কানের। ৬৪ ওভার বল করেও একটি উইকেটের দেখা মেলেনি। ১৯৯১ সালে ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল দুই সিলভা, অশোকা ও অরবিন্দের।
পেসারদের দিকে খুব একটা সুনজরে তাকায় না মিরপুর, তা তো জানাই। কিছু পরিসংখ্যানেও সেটা স্পষ্ট। শেষ ১০ বছরে (বাংলাদেশ–শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর আগে) যেসব মাঠে কমপক্ষে ১০টি টেস্ট হয়েছে, তাতে পেসাররা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন উইকেট পেয়েছেন মিরপুরেই। এই সময়টায় মিরপুরে হওয়া ১৪ টেস্টে পেসারদের ১৩৩ উইকেট। স্পিনাররা উইকেটবিহীন একের পর এক ওভার করে যাচ্ছেন, আর পেসাররা একের পর এক উইকেট আদায় করে নিচ্ছেন—মিরপুর স্টেডিয়ামে দুটিই বিরল দৃশ্যের মাঝেই পড়ে তাই। মিরপুরে যা দেখা গেছে লঙ্কান বোলারদের কল্যাণেই।
কাসুন রাজিতা ও আসিতা ফার্নান্ডো, মিরপুরে স্পিনারদের করুণকালে এই দুই পেসার মিলে প্রথম ইনিংসে নিয়েছেন ৯ উইকেট। তাঁদের ছাড়া মিরপুরে পেসারদের এক ইনিংসে নয় কিংবা তার বেশি উইকেট নেওয়ার ঘটনা সাকল্যে আছে একটিই। সেটি ২০০৮ সালে, বাংলাদেশের ইনিংসের সব কটি উইকেটই গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকান পেসারদের ঝুলিতে।
দ্বিতীয় ইনিংসেও রাজিতা ও আসিতা মিলে নিয়েছেন ৮ উইকেট। স্পিনের বদলে পেসে নাকাল হবে বাংলাদেশ, এমনটা হয়তো যেমন ভাবেনি বাংলাদেশ, তেমনি শ্রীলঙ্কাও না! দ্বিতীয় ইনিংসেও লঙ্কান স্পিনারদের হতাশা কেটে যায়নি। মিরপুর টেস্টে দুর্দশার শিকার তো আসলে রমেশ মেন্ডিস! সিরিজই শেষ করতে বসেছিলেন উইকেটবিহীন, শেষমেশ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের অষ্টম উইকেটটা পেয়েছেন। সে কারণে একটা রেকর্ড হতে হতেও হয়নি!
লঙ্কান স্পিনারদের সর্বোচ্চ ৭১ ওভার বল করে উইকেটবিহীন টেস্ট পার করে দেওয়ার রেকর্ড আছে। ঢাকা টেস্টে রমেশ-জয়াবিক্রমারা এর চেয়েও বেশি বল করে ফেলেছিলেন উইকেট ছাড়া। এরপর রমেশ ফিরিয়ে দেন মোসাদ্দেককে। ওই উইকেটটাই মিরপুর টেস্টে স্পিনারদের ৮৪ ওভার থেকে আসা একমাত্র উইকেট! যা লজ্জার এক রেকর্ডের হাত থেকে তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।
অবশ্য লঙ্কান স্পিনারদের ওমন দুঃসময়েও উজ্জ্বল পেসার ও ব্যাটসম্যানদের কারণে ঠিকই হাসি নিয়ে ফেরার সুযোগ হয়েছে লঙ্কানদের। তবে মিরপুরে এক ইনিংসে ৩৮ ওভার বল করে যাবেন, আরেক ইনিংসে ১৩ ওভার, অথচ একটি উইকেট মিলবে না—মিরপুর টেস্ট শুরুর আগে নিশ্চিত জয়াবিক্রমার কষ্টকল্পনাতেও ছিল না এমন কিছু।