মানকাড আউট করে কোনো বোলার প্রশংসিত হননি, বরং না করে অনেকে নায়কের মর্যাদা পেয়েছেন। আইপিএলে অশ্বিন যখন বাটলারকে মানকাড আউট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন, বিপরীতে ওয়ালশ-রফিক-গেইলরা অনেক আগেই ক্রিকেটীয় চেতনার পতাকা উড়িয়েছেন
কাল আইপিএলে রবিচন্দ্রন অশ্বিন যেভাবে জস বাটলারকে ‘মানকাড’ আউট করেছেন, এ নিয়ে হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা। ক্রিকেটীয় চেতনায় আঘাত দিয়েছেন, এ যুক্তিতে অনেকে ভারতীয় এই স্পিনারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। কিন্তু অশ্বিনের যুক্তি, তিনি নিয়মের মধ্যে থেকেই আউট করেছেন। নিয়ম যদি থেকে থাকে তবে এখানে ক্রিকেটীয় চেতনার কথা আসছে কেন? অশ্বিন কাল বাটলারকে মানকাড আউট করার সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন মাত্র। তাঁর কাছে তখন ক্রিকেটীয় চেতনা নয়, যেকোনো মূল্যে দলের জয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ক্রিকেটে মানকাড আউটের উদাহরণ নেহাত কম নয়। ১৯৪৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলীয় ওপেনার বিল ব্রাউনকে এভাবে আউট করে সেই যে রেকর্ডের পাতায় নাম লিখেছেন ভিনু মানকড় (তাঁর নামেই আউটটার নামকরণ), পরে এ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে আরও অনেকের নাম। এ অধ্যায়ে সর্বশেষ সংযোজন অশ্বিন। কিন্তু অশ্বিনদের বিপরীত উদাহরণও কম নেই! অনেকে মানকাডেড করার সুযোগ পেয়েও করেননি। তাঁদের কাছে ক্রিকেটীয় চেতনাটাই বড় হয়ে উঠেছে। ক্রিকেটীয় চেতনা বড় করে দেখতে গিয়ে দলকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। তাতে কী, ক্রিকেট ইতিহাস তাঁদের নায়কের মর্যাদা দিয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী মানকাড আউট বৈধ। বৈধ যেহেতু, ১৯৮৭ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সেলিম জাফরকে চাইলে মানকাড আউট করতে পারতেন কোর্টনি ওয়ালশ। পাকিস্তানের শেষ বলে দরকার ছিল ২ রান। হাতে ছিল মাত্র ১ উইকেট। ওয়ালশ শেষ বলটি করতে এসে দেখেন ননস্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান সেলিম ক্রিজ ছেড়ে অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছেন। ওয়ালশ চাইলেই জাফরকে আউট করে দিতে পারতেন। কিন্তু ক্রিকেটীয় ভব্যতায় আউট না করে বরং সাবধান করে দেন। পাকিস্তান পরে ২ রান নিয়ে জিতে যায় ম্যাচটা। এ পরাজয়ের খেসারত ভালোভাবেই দিতে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে উঠতে ব্যর্থ হয় তারা। ক্রিকেটীয় চেতনা তুলে ধরায় পরে ওয়ালশকে পুরস্কার পর্যন্ত দিয়েছে পাকিস্তান সরকার।
পাকিস্তানের ভাগ্যই বোধ হয় এমন। ২০০৩ সালের মুলতান টেস্টে একেবারে জয়ের প্রান্তে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হারতে হয় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিরদুঃখ হয়ে থাকা সেই টেস্টে ইনজামাম-উল-হকের অসাধারণ পারফরম্যান্স, রশিদ লতিফের ক্যাচ-কাণ্ড বা অশোকা ডি সিলভার বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পরও জয়ের সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের। মোহাম্মাদ রফিক সুযোগ পেয়েও উমর গুলকে মানকাড না করে শুধু সাবধান করে দেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যায় ১ উইকেটে! মুলতান টেস্ট হারলেও ওই ঘটনায় রফিক ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন।
মানকাড করার সুযোগ পেয়েছিলেন ক্রিস গেইলও। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্যান্ডিতে ইংল্যান্ড ইনিংসের ১৪তম ওভারের শুরুতে এউইন মরগানকে মানকাড করার সুযোগ পান ক্রিস গেইল। মরগান তখন অপরাজিত ১০ রানে। গেইল আউট না করে বরং বেশ মজা করে সতর্ক করেন ইংলিশ ব্যাটসম্যানকে। ৩৬ বলে অপরাজিত ৭১ রান করে এই মরগান শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ম্যাচটা ক্যারিবীয়রা জেতে ১৫ রানে।
বছর দুয়েক আগে মানকাড আইনে কিছু সংশোধন করা হয়। আগে নন স্ট্রাইক ব্যাটসম্যানকে একবার সতর্ক করতে হতো যেন দ্বিতীয়বার ক্রিজ থেকে বেরিয়ে না যান। নতুন আইনে সতর্ক করার কোনো দরকার নেই। বোলার বল ছোড়ার সময় যদি দেখতে পান ব্যাটসম্যান বেরিয়ে যাচ্ছেন চাইলেই রানআউট করতে পারেন। কাল বাটলারকে যেটি করেছেন অশ্বিন। অশ্বিনের চোখে যেটি ‘ঠিক কাজ’, অনেকের চোখে সেটিই ভীষণ ‘অখেলোয়াড়সুলভ’ আচরণ।
এই অশ্বিনই ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত সিবি সিরিজে শ্রীলঙ্কার লাহিরু থিরিমান্নেকে মানকাড করেছিলেন। তখন মাঠে আম্পায়ারদের অনুরোধে ও শচীন টেন্ডুলকারের পরামর্শে আউটটি ফিরিয়ে নেন ওই ম্যাচে ভারতের অধিনায়ক বীরেন্দর শেবাগ। এখানে অশ্বিনের কোনো মাহাত্ম্য নেই অবশ্য, সেটির কৃতিত্ব শেবাগের পাওনা।
সেই ম্যাচেও অবশ্য ভারতকে খেসারত দিতে হয়েছিল। থিরিমান্নে আরও ৬ ওভার উইকেটে থেকে ৬২ বলে সমান রান করে আউট হন। শ্রীলঙ্কার পক্ষে ইনিংসের সর্বোচ্চ রান এসেছিল তাঁর ব্যাটেই। ভারত ম্যাচটি পরে ৫১ রানে হেরে যায়। ভারত সেবার ফাইনালে যেতে ব্যর্থও হয়েছিল।