এই যে এত দিন ইংল্যান্ডে আছেন, এতগুলো শহর ঘুরলেন, কোন শহরটা বেশি ভালো লাগল?
বিশ্বকাপ-যাযাবর হয়ে যাঁরা ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের এ শহর থেকে ও শহর চষে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের সবাইকেই কখনো না কখনো প্রশ্নটা শুনতে হচ্ছে। যাঁর ব্যস্ততা ভালো লাগে, নীরবতা পছন্দ নয়, তিনি হয়তো বলছেন লন্ডন, নটিংহামের কথা। যাঁর কোলাহল পছন্দ নয়, ভিড়ভাট্টা ভালো লাগে না, তিনি বলবেন টন্টন বা কার্ডিফ। কিন্তু মাশরাফি বিন মুর্তজা বললেন, ‘আমার কোনো শহরই ভালো লাগে না।’
বার্মিংহামে এসে কয়েক দিনের ছুটি পেয়ে সে জন্যই হয়তো স্ত্রী-পরিবার নিয়ে স্নোডন নামের এক ছোট্ট শহরে ঘুরতে চলে গেছেন মাশরাফি। দেখে এসেছেন ইংল্যান্ডের গ্রাম, পাহাড়ি ঝরনা। ইংল্যান্ডের গ্রাম কেমন হয়, সেটি দেখার খুব শখ ছিল মাশরাফি ও তাঁর স্ত্রীর। বাড়ির সামনে নরম রোদে বসে কোনো বুড়ো-বুড়ি দম্পতি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে গল্প করছেন—এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য নাকি তাঁদের চোখে আর কিছুই হয় না।
মাশরাফির এ রকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতির ব্যস্ততা যোগ হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন অবসরের আর সুযোগ নেই। বিশ্বকাপে এসে তো চারদিকে আরও লোকে লোকারণ্য। সাংবাদিকদের ভিড়। সেলফি–শিকারিদের ভিড়। ভক্তদের নানা রকম আবদার। আইসিসির নিরাপত্তাকর্মীদের পাহারা। কোলাহল থেকে সরে পরিবার নিয়ে একটু অবসর কাটানো বিদেশেও তাই বড় পাওয়া মাশরাফির জন্য।
বার্মিংহামে ভারত এবং পাকিস্তানের মানুষ বেশি। বাংলাদেশিও কম নয়। ২ জুলাই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে গ্যালারিতে কোন দেশের সমর্থকদের উপস্থিতি বেশি হবে, এ নিয়ে নাকি এখানকার বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের মধ্যে জোর প্রতিযোগিতা চলছে। মাশরাফির কাছে খবর আছে, ভারতীয় দর্শকদের মাঠে যাওয়া ঠেকাতে দারুণ এক ফন্দি এঁটেছেন বাংলাদেশিরা। তাঁরা নাকি দেড়-দুই গুণ দামের লোভ দেখিয়ে ভারতীয় সমর্থকদের কাছ থেকে যত পারা যায় টিকিট কিনে বাংলাদেশের লোকদের দিচ্ছেন। এভাবে যদি গ্যালারি দখলের যুদ্ধে ভারতকে হারানো যায়!
খেলায়ও ভারতকে হারাতে পারলে ভবিষ্যতে বার্মিংহামও হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের প্রিয় ভেন্যু। তবে বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলাদেশের যেসব খেলোয়াড়-সাংবাদিক এখানে এসেছেন, তাঁদের অনেকেরই এখন পর্যন্ত শহরটা পছন্দ হয়নি। ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরের তুলনায় সাজানো-গোছানো ভাবটা কম মনে হচ্ছে এখানে। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর হলে কী হবে, বার্মিংহাম কেমন কাঠখোট্টা। কাজ ছাড়া এই শহরের মানুষ আর কিছু বোঝে না।
বার্মিংহামে বাংলাদেশ দল আছে হায়াৎ রিজেন্সিতে। হোটেলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু খাল। খালের পাড় ধরে এগিয়ে একটা টানেলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া যায় সিটি সেন্টারে। মূলত বুলরিং শপিং সেন্টার আর গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল শপিং মল মিলিয়েই বার্মিংহাম সিটি সেন্টার। তবে গত দুই দিন সিটি সেন্টার এলাকা ঘুরে মনে হলো, কেনাকাটা যা–ই হোক না কেন, ওখানে এলে একবার খ্যাপা ষাঁড়ের সামনে মানুষ দাঁড়াবেই।
৬ টন ওজনের ব্রোঞ্জ দিয়ে বানানো একটা ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে সিটি সেন্টারের ঠিক মাঝখানে। সামনের এক পা তোলা, ঘাড়টা রাগতভাবে ঘোরানো, চোখে আক্রমণের হিংস্রতা। আকৃতিতে সত্যিকারের ষাঁড়ের দ্বিগুণ এই ষাঁড়ের কাগুজে নাম ‘দ্য গার্ডিয়ান’। সিটি সেন্টারে এসে খ্যাপা ষাঁড়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা রীতিমতো প্রথা হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার ছবি তুলতে এর পিঠেও চড়ে বসছেন। ইন্টারনেটে ‘দ্য গার্ডিয়ান’–এর খোঁজ করে জানা গেল, যুক্তরাজ্যের যেসব স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি ছবি তোলে, এটি তার মধ্যে তৃতীয়। এর আগে আছে শুধু পার্লামেন্ট হাউস এবং লন্ডন আই।
সিটি সেন্টারে খ্যাপা ষাঁড় কেন, সেটি ব্রোঞ্জের ওই ষাঁড়-মূর্তি দেখার পর থেকেই মনে উঁকি দিচ্ছিল। ইন্টারনেটে ঘেঁটে আর স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল তার সারমর্ম, সিটি সেন্টার এলাকাটি বহু বছর আগে ছিল ভুট্টার বাজার। এর ঠিক মাঝখানের ময়দানে হতো ষাঁড়ের লড়াই। খেপিয়ে তোলা ষাঁড়ের নাকে একপর্যায়ে লোহার রিং পরিয়ে বশে এনে সেটাকে জবাই করা হতো। সে ইতিহাসকে ধরে রাখতেই ২০০৩ সালে ওখানে বসানো হয় বিশালাকৃতির ব্রোঞ্জের ষাঁড়, যেটি এখন বার্মিংহামেরই ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে। বুলরিং শপিং মল নামকরণও সে কারণেই।
খ্যাপা ষাঁড়ের শহরে যখন এসেই পড়েছেন, ব্যবসা নগরী বার্মিংহামের কোলাহল থেকে দূরে গিয়েও নিশ্চয়ই লড়াইয়ের ঘ্রাণ নাকে লেগেছে মাশরাফির। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচটা তো শুধু বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপ ২০১৯ সেমিফাইনালের পথ পরিষ্কারেরই উপলক্ষ নয়, গত কয়েক বছরে হয়ে ওঠা উপমহাদেশের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ক্রিকেটযুদ্ধও।
বাংলাদেশ, ভারত কে কার নাকে রিং পরিয়ে প্রতিপক্ষকে মাটিতে নামায়, আপাতত সেটি দেখারই রোমাঞ্চকর অপেক্ষায় আছে খ্যাপা ষাঁড়ের শহর বার্মিংহাম।