ম্যাচের বিরতিতে কী খেয়ে থাকেন ক্রিকেটাররা?
ম্যাচের বিরতিতে কী খেয়ে থাকেন ক্রিকেটাররা?

ক্রিকেটারদের ভোজ এবং ভিভ রিচার্ডসের দীর্ঘ সন্ধ্যা

আশির দশকে ইংল্যান্ডের হয়ে ৬টি টেস্ট ও ৩৪টি ওয়ানডে খেলা ভিক মার্কস খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট নিয়েই লেখালেখি করেছেন ইংল্যান্ডের অবজারভার ও গার্ডিয়ান পত্রিকায়। তাঁর ‘লেট কাটস: মিউসিংস অন ক্রিকেট’ বইয়ে ক্রিকেটের লাঞ্চ ও ডিনার নিয়ে মজার একটি অধ্যায় লিখেছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত সেই অধ্যায়টির চুম্বক অংশের ভাষান্তর পাঠকদের জন্য—

ক্রিকেটাররা ও ক্রিকেট লেখকেরা সব সময় নেপোলিয়নের সেই বিখ্যাত কথাটা মেনে চলেন। পাকস্থলী ঠিক তো সব ঠিক। অন্তত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে–পরে মিলিয়ে তিন দশক ক্রিকেট খেলা নটিংহ্যাম্পশায়ার ব্যাটসম্যান জর্জ গান তেমনই দাবি করেছেন।

জর্জ গানের সময়ে সাধারণত খেলা শুরু হতো সাড়ে ১১টায়, দেড়টায় লাঞ্চ। কখনো কখনো অবশ্য এই নিয়মের ব্যতিক্রমও হতো। ১২টায় শুরু হয়ে লাঞ্চ ২টায়।

এমনই এক ব্যতিক্রমী দিনে ব্যাটিং করতে করতে হঠাৎ লাঞ্চের আধা ঘণ্টা আগেই ব্যাটটা বগলদাবা করে গান ড্রেসিং রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। বার্তাটা পরিষ্কার ছিল, ‘খেলা যখনই শুরু হোক, জর্জ গান সব সময় দেড়টাতেই মধ্যাহ্নভোজ করেন।’

এমন না যে ডাইনিং রুমে যাওয়ার পর গান কিংবা অন্য ক্রিকেটারদের পিরি পিরি ব্রেডেড টফু দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। লাঞ্চে এত ভারী খাওয়াদাওয়া থাকে নাকি!

কাউন্টির ম্যাচগুলোতে চা–বিরতিটা হতো খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে। অবসর কাটাতে গিয়ে সবুজ বাগানে বসে বিকেলের আহারের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটাকে মেলানো যাবে না। স্ট্রবেরি, আর ক্রিম লাগানো কোনো বেকড খাবার। সেগুলো খেয়ে সবাই সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আম্পায়াররাও মাঠে ফেরার তাড়া দিতেন না।

শচীন টেন্ডুলকারদের খাবার বাছাই করেই খেতে হতো।

একটু পেশাদার ড্রেসিং রুমে আবার অগ্রাধিকারটা বদলে যেত। বিশেষ করে ধূমপায়ীদের জন্য। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই এক কাপ চা, গোটা কয়েক স্যান্ডউইচ, দুটি সিগারেট শেষ করতে হবে। সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনা, দলের কৌশল ঠিক করা—এসবের সময় কোথায়! অবশ্য আপনার দল যদি ব্যাটিংয়ে থাকে, তাহলে একটু রয়েরসে খাওয়া যেত। তবে এখানেও একটা কথা আছে। প্রায়ই দেখা যেত মাঠে প্রতিপক্ষের ভয়ংকর বোলারদের সাহসের সঙ্গে খেলে আসা দুই ব্যাটসম্যান ড্রেসিং রুমের এসে দেখেছেন স্যান্ডউইচের ট্রে পুরো ফাঁকা!

টিম ডিনার হলে অবশ্য কথা আলাদা। তাড়াহুড়োর বা খাওয়া কম পড়ার ব্যাপার নেই সেখানে। তবে সেটা তো হতো বিশেষ বিশেষ সময়ে। আশির দশকে একটা নিয়ম ছিল। ইংল্যান্ড দলে কোনো নতুন খেলোয়াড় এলে টেস্ট ম্যাচের আগের রাতে টিম ডিনারে সে নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যানের পাশে বসবে। ১৯৮২ সালে হেডিংলিতে টেস্ট অভিষেকের আগে আমি যেমন বসেছিলাম পিটার মের পাশে। দুঃখজনক হলো, সেদিন রাতে তিনি আমাকে কী বলছিলেন, আমার মনে নেই। কী সুযোগটাই নষ্ট হয়েছে। আমার কথা বলছি আর কী!

ডিনার শেষে নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান এবং অধিনায়ক কিছু বলতেন। বাকিরা সবাই সভ্য হয়ে বসে বসে সেটা শুনতাম এবং বক্তৃতা শেষ হলে ইয়ান বোথাম যথারীতি বারে গিয়ে এক-দুই পেগ মদ্যপানের চাপাচাপি করত সবাইকে। ম্যাচের আগে সবাই যাতে রিলাক্স থাকতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে চাইত সে।

ডিনারের পর অনেক ক্রিকেটার বক্তৃতা দিতেন, সেটা শোনা মাঝেমধ্যে খুব একটা আরামদায়ক হতো না। আবার কখনো কখনো ডিনারটাই হতো বক্তৃতার মতো দুঃসহ।

সমারসেটে টিম ডিনার সব সময় হতো না। ওখানে ব্যাপারটার মধ্যে একটা আভিজাত্য ছিল। শুধু লর্ডসের ফাইনালের আগেই টিম ডিনার হতো এবং হইচইও হতো। খেলোয়াড়েরা চাইতেন ক্লাবের এই আতিথ্য চুটিয়ে উপভোগ করতে। মাঝেমধ্যে সেখানে কৌশল নিয়েও কথাবার্তা হতো। ওটাই একমাত্র সময়, যখন আমরা প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করতাম এবং যথারীতি ইয়ান বোথাম আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলত, ‘ওদের নিয়ে চিন্তার দরকার নেই। ওদের আমি দেখব।’ অথবা সে মাঝেমধ্যে জ্ঞান দিয়ে বলত, ‘অমুক আর অমুককে বাউন্সার দিও না, লাভ হবে না।’ যে উপদেশ সে নিজের প্রথম স্পেলের শুরু থেকে নিজেই ভুলে যেত।

ডিনারের পর অনেক ক্রিকেটার বক্তৃতা দিতেন, সেটা শোনা মাঝেমধ্যে খুব একটা আরামদায়ক হতো না। আবার কখনো কখনো ডিনারটাই হতো বক্তৃতার মতো দুঃসহ।
অনেকে বলেন, ডেভনের শোব্রোকে একটা ছোট্ট গ্রামে আশির দশকে একটা বার্ষিক ক্রিকেট ডিনারে ভিভ রিচার্ডস গিয়েছিলেন।

কীভাবে ভিভ সেখানে গেলেন, সেটা অনুমান করা খুব কঠিন। হয়তো তাঁর অবসরের কোনো একটা বছরে হবে। নইলে ভিভের পক্ষে এ রকম ইভেন্টের জন্য সময় বের করা মুশকিলই ছিল। ভক্তদের সঙ্গে ভিভ ছিলেন খুবই সৌজন্যমূলক, তবে জোয়েল গার্নারের মতো তিনি ওদের সঙ্গে মিশতেন খুব কম। গার্নার তো মাঠে ঢোকার সময়ও ওর পেছনে লম্বা লাইন লেগে থাকত।

মানুষের সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না ভিভ রিচার্ডস।
অবশেষে লাজুক সভাপতির মনে হলো, এই নীরবতা তাঁরই ভাঙা উচিত। ভিভের দিকে তাকিয়ে ডেভনের আঞ্চলিক উচ্চারণে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তাহলে ক্রিকেট খেলেন, নাকি?’

ভিভ একটু দূরত্ব রাখতে পছন্দ করতেন। মাঝেমধ্যে অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জাও পেতেন। এরপরও তিনি ডেভনের শোব্রোকে সেই ছোট্ট গ্রামে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রধান টেবিলে বসেছিলেন।

ভিভের পাশেই ছিল ক্লাবের অশীতিপর সভাপতি, যিনি আরেক লাজুক মানুষ। সভাপতি সাহেব ক্রিকেট খুব একটা বুঝতেন না, এরপরও তিনিই ছিলেন গ্রামের ওই ক্রিকেট ক্লাবের প্রধান। কারণ, তিনি ছিলেন কৃষক এবং শোব্রোকের ক্রিকেটাররা যে মাঠে খেলতেন, সেটার মালিক।

ডিনার শুরু হলো। ভিভ কোনো কথা বলছেন না, লাজুক সভাপতিও না। আলাপচারিতাহীন একটা ডিনার শেষ হচ্ছে, যেটা আসলে দুজনের কাছেই অস্বস্তিকর লাগছিল।

অবশেষে লাজুক সভাপতির মনে হলো, এই নীরবতা তাঁরই ভাঙা উচিত। ভিভের দিকে তাকিয়ে ডেভনের আঞ্চলিক উচ্চারণে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তাহলে ক্রিকেট খেলেন, নাকি?’

ভিভের উত্তর কী ছিল জানা যায়নি। তবে অনুমান করা যায়, ওটা ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের জন্য দীর্ঘ এক সন্ধ্যাই ছিল।