>যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। প্রায়ই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আফগানিস্তান শিরোনাম হয় আত্মঘাতী বোমা হামলার খবরে। কিন্তু এই দেশটার মানুষের কাছে ক্রিকেট এখন জীবনীশক্তিই। দেরাদুনে আফগান ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন সৌম্য বন্দোপাধ্যায়
কথা বলা শুরু হয়েছে কি হয়নি, লুৎফুল্লাহ স্টানিকজাই হন হন করে এগিয়ে এসে বললেন, ‘নো কোয়েশ্চেনস অন ব্লাস্টস প্লিজ। ওনলি ক্রিকেট।’
স্তোক দিয়ে লুৎফুল্লাহকে আশ্বস্ত করতেই হলো। আফগান ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলার বন্দোবস্ত তাঁরই করে দেওয়া। ফোনে বলেছিলেন, ছটার মধ্যে স্টেডিয়ামে চলে আসতে। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে তিনি সব বন্দোবস্ত করে দেবেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ঠিক ছটায় আফগান দল একজন–দুজন করে গা গরমের জন্য মাঠে নামতে লাগলেন। একটু তফাতে লুৎফুল্লাহ তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা শেষে মোহাম্মদ নবী আমাকে বলে গেলেন অল্প সময়ের মধ্যেই আসছেন। এগিয়ে এলেন সামিউল্লাহ শেনওয়ারি ও শাপুর জাদরান। একটা দুটো মামুলি কথার পর দেশের অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ে কথাটা পেড়েছি কি পারিনি, কিছু একটা আন্দাজ করে লুৎফুল্লাহ এগিয়ে এসে ওই সাবধানবাণীটা শুনিয়ে গেলেন।
গেলেন বটে কিন্তু কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেন না। আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের মার্কেটিংয়ের দায়িত্ব তাঁর বলে কিছুদিন ধরে চরকি ঘোরা ঘুরতে হচ্ছে তাঁকে। তফাতে চলে গেলে শাপুর বললেন, ‘যদি বলি চিন্তা হয় না, তা হলে তা ঠিক বলা হবে না। আবার যদি বলি মাথায় ওই চিন্তা সব সময় ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটাও সত্যি নয়। দুশ্চিন্তা থাকেই। তবে এটাও ঠিক, কাবুলে যে জায়গায় আমরা থাকি, সেখানে নিরাপত্তা খুব বেশি।’
সামিউল্লাহ কথাটা অন্যভাবে পাড়লেন। ‘ভেবে কী করা যায় বলুন তো? পরিস্থিতি অনিশ্চিত ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ক্রিকেট তো আর থেমে থাকবে না। আমরা তাই ওই ভাবনাটা আমল না দিয়ে খেলে যাচ্ছি।’
কিন্তু সেটাও ভারী শক্ত। এই যেমন রশিদ খান। হাসিখুশি চঞ্চলতার মাঝেও একবুক কষ্ট তাঁর। গোটা একটা বছর কেটে গেছে, বাড়ি যেতে পারেননি। আফগানিস্তানের এই দলে তিনিই সুপারস্টার। তাঁকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাচ্ছে যাবতীয় আফগানি আশা। কিছুদিন আগে খবর পেয়েছেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু বিস্ফোরণের বলি হয়েছেন। এক ঝলকের জন্য এসে বলে গেলেন, আজকের ম্যাচটা জিতে গেলে এই সিরিজ আমাদের কাছে অতীত হয়ে যাবে। নজরে জ্বলজ্বল করবে শুধুই বেঙ্গালুরু। ভারতের বিরুদ্ধে আফগানদের প্রথম টেস্ট। বললেন, আমাদের প্রমাণ করতে হবে টি টোয়েন্টির মতো টেস্ট ম্যাচও আমরা সমান প্যাশন নিয়ে খেলি।
নবী এলেন খানিক পর। বাংলাদেশকে যাঁরা হারালেন, তাঁদের মধ্যে যে পাঁচজনের জায়গা টেস্ট টিমে পাকা, নবী তাঁদের অন্যতম। রশিদ ও মুজিব অন্য দুই স্পিনার। বাকি দুজন অধিনায়ক আসগর স্টানিকজাই ও উইকেটকিপার শাহজাদ। তেত্রিশ বছরের অলরাউন্ডার নবীর কাছে ভারত অনেক দিনের চেনা। তুলনায় অন্য দুই স্পিনার রশিদ ও মুজিবুর নবীন। দেশের অশান্ত অবস্থাকে তিনি আমলই দিলেন না। বললেন, ‘আমাদের দেশটা অনেক বড়। গোলমালের খবর যা আসে, তার বেশিটাই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। কাবুলে আত্মঘাতী হানা যে হয় না তা নয়। কিন্তু সে তো আরও বহু দেশেই হয়ে থাকে। পৃথিবীর কোনা জায়গাটা আজ পুরোপুরি নিরাপদ?’
কিন্তু এই অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার জন্যই তো আপনারা দেশে আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ আয়োজন পারছেন না? প্রশ্নটার উত্তর দিলেন অধিনায়ক আসগর। সেটা আংশিক সত্য। পূর্ণ সত্যের অন্য অংশ হলো অবকাঠামোর অভাব।
এই সময় আলোচনায় যোগ দিলেন লুৎফুল্লাহ। ক্রিকেট যে ক্রমশই আফগানদের জীবনীশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে কথা লুৎফুল্লাহর মতো অন্যরাও স্বীকার করলেন। ক্রিকেটই যে তাঁদের ধর্ম, সে কথাও অস্বীকার করলেন না কেউই। তবে সবাই এক মত, দেশের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে ক্রিকেট যেভাবে ডানা ছড়িয়েছে, উত্তর-পশ্চিমে ততটা নয়। তাঁদের দেশে ক্রিকেটটা এসেছে পাকিস্তানের হাত ধরেই।
লুৎফুল্লাহর স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের আর্থিক অবস্থা সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ। কিন্তু চেতনায় তারা অনেকটাই এগিয়ে। তাঁর কথায়, বোর্ড যদি ধনী হতো, গোটা দেশে অবকাঠামো তৈরি করা তা হলে সহজ হতো। আন্তর্জাতিক ম্যাচও তা হলে আয়োজন করা যেত।
আফগানদের মনে এখন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ঘুর ঘুর করছে। রশিদরা সেখানে তাঁদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে মুখিয়ে আছেন। সামিউল্লাহর কথায়, ‘আমরা যত জিতব, ততই মঙ্গল। কারণ, আমাদের দেশে যারা অশান্তি পাকায়, তারাও ক্রিকেটকে আঁকড়ে থাকতে ভালোবাসে। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য।’ শেষ কথাটা লুৎফুল্লাহর। ‘তালেবানদের শ্যেন-নজরে আজ ক্রিকেট নেই। এই না থাকাটা ক্রিকেটারদের প্রেরণা। যত আমরা জিতব, অশান্তি ততই কমবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’