বাবর আজমের ব্যাটিং–সৌন্দর্য যে কাউকে টিভি পর্দায় আটকে রাখার মতো। পাকিস্তানি অধিনায়কের কাভার ড্রাইভের তুল্য শট এই পাওয়ার ক্রিকেটের দিনে খুব কমই দেখা যায়। বিশ্ব ক্রিকেটে এত দিন সেরা চার ব্যাটসম্যানের একটি এলিট ক্লাব ছিল। বিরাট কোহলি, স্টিভ স্মিথ, কেইন উইলিয়ামসন ও জো রুটদের সঙ্গে গত কিছুদিন বাবর আজমের নামও যোগ হয়ে ক্লাবটা এখন পাঁচজনের। পাকিস্তান দলের ব্যাটিং গত কিছুদিন যেভাবে প্রায় একাই সামলাচ্ছেন, তাতে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপায়ও নেই।
পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটাররা তাই বাবরকে নিয়ে মেতেছেন। মাঠের ক্রিকেটে তো আর ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার উপায় নেই, তাই কথার লড়াইয়ে নামার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। কখনো বলেছেন, কোহলির কাছাকাছি মানের ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন বাবর, কখনো দুজনকে এক পাল্লাতেই মেপেছেন তাঁরা। তবে শোয়েব আখতারের মতো কেউ কেউ এ দুজনের মধ্যে তুলনা করার চেষ্টায় আপত্তি তুলেছেন। ভারতের তুলনায় পাকিস্তান ম্যাচ কম খেলে বলে এবং দুজন নিয়মিত মুখোমুখি হতে না পারায় তুলনা টানাটা অন্যায় বলেই মনে করেন শোয়েব।
কিন্তু এই ফাস্ট বোলারের যা অন্যায় মনে হয়েছে, সেটা আরেক সাবেক পাকিস্তানি পেসারের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে। কোহলির সঙ্গে বাবরের শুধু তুলনাই করেননি, রীতিমতো এমন এক প্রস্তাব দিয়েছেন, যা শুনে ভারতীয় সমর্থকেরা খেপে উঠতে পারেন। কোহলিকে বলেছেন বাবরের ব্যাটিং দেখে শিখতে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক যুগ পার করে দিয়েছেন বিরাট কোহলি। ওদিকে তাঁর অর্ধেক সময় ধরে পাকিস্তানের হয়ে খেলছেন বাবর। পরিসংখ্যানে দুজনের মধ্যে তুলনা টানা তাই কঠিন। বাবরের রান যেখানে সব সংস্করণ মিলিয়েই আট হাজারের কম, কোহলির ওয়ানডে রানই ১২ হাজারের বেশি। এক দিক থেকে শুধু দুজনের মধ্যে তুলনা টানা সম্ভব হতে পারে; সেটা তাঁদের ব্যাটিং গড়। সে দিক থেকে কোহলির চেয়ে এখনো বেশ পিছিয়ে পাকিস্তানের অধিনায়ক।
তিন সংস্করণেই কোহলির গড় এখন পঞ্চাশের ওপরে। টেস্টে কোহলির গড় দিন দিন বাড়ছে। অধিনায়কত্ব পাওয়ার আগে পঞ্চাশের নিচের গড়কে ৫২.৩৭-এ তুলে নিয়েছেন। ওদিকে বাবরের গড় ৪৪.২২। টি-টোয়েন্টিতেও বেশ এগিয়ে কোহলি।
বাবরের (৪৭.১৩) চেয়ে ইনিংসপ্রতি ৫ রান বেশি কোহলির (৫২.৬৫)। কদিন আগে ওয়ানডেতে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ১৩ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া বাবর ওয়ানডেতেই যা একটু পাল্লা দিচ্ছেন কোহলির সঙ্গে। তবে এখানেও দুজনের ব্যবধান ২-এর বেশি। অনেক দিন ধরে তিন অঙ্কের দেখা না পাওয়া কোহলি ওয়ানডেতে ইনিংসপ্রতি ৫৯.০৭ করে রান তোলেন। বাবরও ছুটছেন ৫৬.৮৩-র দুর্দান্ত গতিতে।
সাবেক পাকিস্তানি পেসার আকিব জাভেদের চোখে এসব পরিসংখ্যান খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাঁর ধারণা, টেকনিকের দিক থেকে কোহলির বেশ ঘাটতি আছে। আর এদিক থেকে বাবর আজম বেশ এগিয়ে আছেন। বাবরের প্রশংসা করতে গিয়ে তাই কোহলিতে আর তৃপ্তি হচ্ছে না তাঁর। একেবারে আধুনিক ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের শেষ কথা শচীন টেন্ডুলকারের দিকেই হাত বাড়িয়েছেন আকিব।
‘বাবর আজমের চেয়ে বিরাট কোহলির হাতে শট বেশি আছে। কিন্তু ওর একটা দুর্বলতা আছে। যখন বল সুইং করে, তখন অফ স্টাম্পে সে আটকে পড়ে। ইংল্যান্ডে জেমস অ্যান্ডারসনের বিপক্ষে যেমন হয়েছিল। বাবরের দিকে তাকালে আপনি এমন কোনো দুর্বলতা খুঁজে পাবেন না। শচীন টেন্ডুলকারের মতোই কোনো দুর্বলতা নেই ওর’—ক্রিকেট প্যাশনের সঙ্গে কথোপকথনে বলেছেন আকিব।
ইংল্যান্ডেই প্রথম কোহলির কোনো দুর্বলতার দেখা মিলেছিল। ২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফর নিয়ে কম সমালোচনা শুনতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া কোহলি নিজের টেকনিক নিয়ে কাজ করেছেন। নিজের দুর্বলতা নিয়ে কাজ করেছেন। এবং এরই ফল পেয়েছেন ২০১৮ সালে। সেবার ইংল্যান্ড সফরে তিনটি ফিফটি ও দুই সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। আরও দুটি ইনিংস ছিল প্রায় পঞ্চাশছোঁয়া। ২০১৮ সফরে ৫৯৩ রান করা কোহলির নিজেকে ভালো করার তাগিদ থেকে বাবরকে শিক্ষা নিতেও বলেছেন আকিব।
ফিটনেসকে সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন কোহলি। নিজেকে নিখুঁত করার চেষ্টায় ফিটনেসকেই অস্ত্র মেনেছেন ভারতের অধিনায়ক। বাবরকে এদিকটায় খেয়াল রাখতে বলছেন আকিব। কিন্তু শুধু বাবরই কোহলির কাছ থেকে শিখবেন, তা নয়। কোহলিকে আকিব বলেছেন বাবরের কাছ থেকে ব্যাটিং শিখতে, ‘বাবর টেকনিকের দিক থেকে বেশি (কোহলির তুলনায়) নিরাপদ। সে যদি কোহলির ফিটনেসের কাজ অনুসরণ করে, তাহলে সে আরও ভালো ব্যাটসম্যান হবে। আর কোহলি নিজের টেকনিকে উন্নতি করতে পারবে যদি সে বাবরের ব্যাটিং দেখে। তাহলেই আর উইকেটের সামনে আটকে যাবে না (সুইং বলে)।’
আরেকটা জায়গায়ও বাবরের প্রশংসা করেছেন আকিব জাভেদ। একসময় মোহাম্মদ ইউসুফ, ইউনিস খান, ইনজামাম-উল-হকদের একসঙ্গে খেলতে দেখা পাকিস্তান দল কিছুদিন ধরে ভরসা রাখার মতো ব্যাটসম্যান বলতে শুধু বাবরকেই পাচ্ছে। আকিব জাভেদের ধারণা, ইউনিস খান ও মিসবাহ-উল-হকের মতো দুজন ব্যাটসম্যানের একসঙ্গে অবসর নিয়ে চলে যাওয়ার ধাক্কাটা বাবর আজমের কারণেই সামলে নিতে পেরেছে পাকিস্তান, ‘গত দুই বা তিন বছরে পাকিস্তান ক্রিকেটের পঞ্চাশ ভাগই বাবর আজম। আমি কখনো ভাবিনি সে এতটা ধারাবাহিক হতে পারবে। কিংবা ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে বিরাট কোহলিকে ছাড়িয়ে যাবে। পাকিস্তানের সৌভাগ্য, দল যখন বিপদে পড়েছিল তখনই ওর আবির্ভাব হয়েছে এবং দলকে প্রায় একাই টিকিয়ে রেখেছে। অধিনায়কত্বও ওর ফর্মে প্রভাব ফেলেনি।’
পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে আকিব যা বলেছেন, তাতে ভুল ধরার কিছু নেই। কিন্তু তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে কোহলি-টেন্ডুলকারকে টেনে আনা অথবা বাবরের কাছ থেকে কোহলিকে টেকনিকের দীক্ষা নিতে বলাটা ভারতের সমর্থকগোষ্ঠী মনে হয় না মেনে নিতে পারবেন।