কাল ফাইনালে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করছিল ঢাকা ডায়নামাইটস। পরিসংখ্যানটি তখন দেখানো হয় টিভি পর্দায়। এবার বিপিএলে শীর্ষ দশ বোলারের পরিসংখ্যান। ধারাভাষ্যকার ড্যানি মরিসন তা দেখে যেন চমকে উঠলেন, ‘ইটস ওয়ান্ডারফুল! মোস্ট অব দেম আর লোকাল।’
বিপিএল কিংবা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে প্রায়ই বাংলাদেশে আসার সুবাদে মরিসন এ দেশের ক্রিকেট ভালোই জানেন। এখানকার মাটিতে ঘূর্ণি ধরে বেশি কিংবা ধরানোর ব্যবস্থা করা হয়, আর তাই স্পিনারদের তুলনায় পেসাররা বরাবরই ‘একঘরে’। সেটি হোক ঘরোয়া লিগ কিংবা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। আর বিপিএলে তো স্পিনারদের দাপটই বেশি। আরেকটু খোলাসা করে বলা যায়, বিপিএলে ব্যাটে-বলে বরাবরই বিদেশিদের দাপটে যা একটু ভাগ বসিয়েছেন দেশি স্পিনারেরাই। কিন্তু এবার চিত্রটা পাল্টে দিয়েছেন দেশি বোলাররা। শীর্ষ দশ বোলারের মধ্যে আটজনই দেশি। এর মধ্যে শীর্ষ পাঁচে আবার বিদেশি কারও জায়গা হয়নি। মরিসন তো মরিসন, তালিকা এ দেশের যে কোনো ক্রিকেটপ্রেমীকেই মুগ্ধ করবে।
অবাক করা বিষয়, মরিসন নিজে পেসার হয়েও শীর্ষ দশে পেসারদের দাপট নিয়ে কিছু বলেননি। খেয়াল করলে নিশ্চয়ই কিছু একটা বলতেন। চোটজর্জর ক্যারিয়ার হলেও এক সময় নিউজিল্যান্ডের জার্সিতে সুইংয়ের পসরা বিছিয়েছেন এই কিউই। পেসাররা ভালো করলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর খুশি হওয়ার কথা। সেটি হোক এখানকার স্থানীয় কিংবা বিদেশি। তবে মরিসন যেহেতু স্থানীয় বোলাররা ভালো করায় বেশি খুশি, তাঁকে সন্তুষ্টির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে একটি পরিসংখ্যান—এবার বিপিএলে শীর্ষ দশ বোলারের মধ্যে দেশি পেসার সাতজন!
বলতে পারেন, এ তো নজিরবিহীন! তা বটে। বোলারদের জন্য বিপিএল মানেই তো স্পিনবান্ধব মন্থর উইকেট। যেখানে ব্যাটিং করাও মাঝে-মধ্যে বেশ কঠিন। এবার শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলোর কথাই ধরুন, বেশ কিছু লো-স্কোরিং ম্যাচ দেখেছে সবাই। আশার কথা, শেরেবাংলার কালো মাটির উইকেট কিংবা চট্টগ্রামের ব্যাটিং-বান্ধব উইকেট—পুরো বিপিএল জুড়ে যে কোনো বাইশ গজে ছন্দে ছিলেন পেসাররা। তাসকিন আহমেদের কথাই ধরুন। সিলেট সিক্সার্সের এই পেসার চোট পেয়ে ছিটকে পড়ার আগে ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। কাল ফাইনালে তাঁকে টপকে যান সাকিব। কিন্তু চোট পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাসকিনের বোলিং দেখে কে বলবে, এই পেসার কিছুদিন আগেও নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন।
দেশের পতাকা স্পিনারের হাতেই। ১৫ ম্যাচে ২৩ উইকেট নিয়ে সাকিব শীর্ষে। তাসকিন ১২ ম্যাচে ২২ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয়। তাঁর সমান ২২ উইকেট নিয়ে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থও দুজন পেসার—মাশরাফি বিন মুর্তজা (১৪ ম্যাচ) ও রুবেল হোসেন (১৫ ম্যাচ)। এরপর আছেন এক উঠতি পেস অলরাউন্ডার—মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন (১৩ ম্যাচে ২০ উইকেট)। অর্থাৎ শীর্ষ পাঁচের পুরোটাই দেশি ‘ফ্লেভার’।
সাকিব স্পিনারদের প্রতিনিধি হয়ে এবার যেমন বিপিএলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৩ উইকেট নিয়েছেন তেমনি তাসকিনও সর্বোচ্চ উইকেট নিয়েছেন পেসারদের প্রতিনিধি হয়ে। ২০১৬ বিপিএলে আবু হায়দার রনির ২১ উইকেটের মাইলফলক টপকে গেছেন তাসকিন। সে যাকগে, ক্রিকেটপ্রেমীরা খুশি হতে পারেন এই ভেবে, শীর্ষ পাঁচ বোলারের মধ্যে তিন পেসারকেই নিউজিল্যান্ডে পাচ্ছে বাংলাদেশ। বিপিএলে মন্থর উইকেটেই তাঁরা যখন ছন্দে, তখন নিউজিল্যান্ডের পেসবান্ধব উইকেটে নিশ্চয়ই আরও ভালো কিছু হবে—এমনটি ভাবতেই পারেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ব্যাপারটি ‘সোনায় সোহাগা’ হতো যদি তাসকিন চোটের কারণে নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে স্কোয়াড থেকে ছিটকে না পরতেন। যেমন একই কারণে ছিটকে পরলেন সাকিবও।
বোলিং বিভাগে এই দুই বড় লোকসান পুষিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু পেসারদের ওপর। সে ক্ষেত্রে মাশরাফি-রুবেলের মতো সিনিয়রদের সাহায্য করতে হবে উঠতিদের। সেই আশাও কিন্তু আছে। শীর্ষ দশে বাকি পাঁচ বোলারের মধ্যে দেশি পেসার আছেন তিনজন—আবু জায়েদ (১৩ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে সাতে), ফরহাদ রেজা (১৪ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে আটে) ও খালেদ আহমেদ (১৩ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে নয়ে)। এই তিন পেসারের মধ্যে আবু জায়েদ ও খালেদ ডাক পেয়েছেন নিউজিল্যান্ডগামী টেস্ট দলে। তরুণেরা ছন্দে থাকায় আশা তো করাই যায়।
পেসারদের নিয়ে হঠাৎ করেই আশার বুদ্বুদ ওঠার কারণও পরিসংখ্যান। ২০১২ সালে বিপিএল চালুর পর এ পর্যন্ত মাঠে গড়িয়েছে ছয়টি সংস্করণ। তার মধ্যে এবারই প্রথম শীর্ষ দশ বোলারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন সাত-সাতজন দেশি পেসার। শীর্ষ দশ বোলারে এত দেশি পেসারের আনাগোনা এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। ২০১২ বিপিএলের অভিষেক সংস্করণে তো শীর্ষ দশে দেশি কোনো পেসারেরই জায়গা হয়নি। পাঁচজন ছিলেন দেশি স্পিনার। বাকি পাঁচ বিদেশি।
পরের সংস্করণে (২০১৩) জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন শুধু রুবেল হোসেন। সেটিও একেবারে তলানিতে (১০ম)। আর ওপরের নয়জনের মধ্যে পাঁচজনই দেশি স্পিনার। পরের সংস্করণে (২০১৫) আবু হায়দার, আল-আমিন আর মোস্তাফিজ ভালো করায় চিত্রটি কিছুটা পাল্টায়। এই তিন পেসার উঠে আসেন শীর্ষ দশে। দেশি স্পিনারও ছিলেন তিনজন। অর্থাৎ পেসাররা তখনো টপকে যেতে পারেনি স্পিনারদের। অচলায়তন ভাঙল পরের মৌসুমে (২০১৬-১৭)। এবার শীর্ষ দশে উঠে এলেন পাঁচ দেশি পেসার। আর দেশি স্পিনারদের মধ্যে জায়গা পেলেন শুধু আরাফাত সানি। তালিকার দশে।
২০১৫ সংস্করণ থেকে পেসারদের এই জেগে ওঠার তাড়না কাজ করেছে গত সংস্করণেও। সেবার স্পিনারদের ৬-২ ব্যবধানে হারিয়ে দেন পেসাররা। মানে শীর্ষ দশে ছয় দেশি পেসারের বিপরীতে স্পিনার মাত্র দুজন। বাকি দুজন বিদেশি। আর এবার তো ব্যবধান ৭-১। শীর্ষ দশে দুজন বিদেশিকে রেখে একচ্ছত্র দাপট চলেছে দেশি পেসারদের। একমাত্র স্পিনার হিসেবে শুধু সাকিবকে মাথার মুকুট করে রেখে দেশের পেসাররা যেন বলতে চেয়েছেন—ঠিক আছে স্পিন এখনো মোক্ষধাম, কিন্তু কে বলে দেশি পেসাররা পারে না!
পেসারদের আধিপত্যকে আরেকটু খোলাসা করে বুঝিয়ে দেবে আরও একটি পরিসংখ্যান। এই শীর্ষ দশে সেরা বোলিং গড় তাসকিনের (১৪.৪৫)। সেরা স্ট্রাইক রেটও তাসকিনের (১০.১)। আর ইকোনমি রেটে দেশের সেরা মাশরাফি (৭.০৩)। এক ইনিংসে দুবার করে ৪ উইকেট নেওয়া দুই বোলারও দেশি পেসার—রুবেল ও তাসকিন। এক ইনিংসে সেরা বোলিং ফিগারও কামরুল ইসলামের (৪/১০)।
বিপিএলে এবার শীর্ষ দশ বোলার:
খেলোয়াড় | ম্যাচ | উইকেটসংখ্যা | সেরা বোলিং(ইনিংসে) | গড় | স্ট্রাইক রেট |
সাকিব আল হাসান | ১৫ | ২৩ | ৪/১৬ | ১৭.৬৫ | ১৪.৬ |
তাসকিন আহমেদ | ১২ | ২২ | ৪/২৮ | ১৪.৪৫ | ১০.১ |
মাশরাফি বিন মুর্তজা | ১৪ | ২২ | ৪/১১ | ১৭.৫৯ | ১৫.০ |
রুবেল হোসেন | ১৫ | ২২ | ৪/২৩ | ১৮.৫০ | ১৪.৩ |
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন | ১৩ | ২০ | ৪/২২ | ১৭.৮০ | ১৩.৮ |
সুনীল নারাইন | ১৫ | ১৮ | ৪/১৫ | ১৯.৭৭ | ১৮.৬ |
আবু জায়েদ | ১৩ | ১৮ | ৩/২৫ | ২৩.০৫ | ১৬.৩ |
ফরহাদ রেজা | ১৪ | ১৭ | ৪/৩২ | ১৯.০৭ | ১৩.৫ |
খালেদ আহমেদ | ১৩ | ১৭ | ৩/২০ | ২২.২৩ | ১৭.১ |
ওয়াহাব রিয়াজ | ১০ | ১৬ | ৩/১৪ | ১৫.৭৫ | ১২.২ |