উইকেটের সেই ডাকাবুকো ভাবটা নেই। বরং সুবোধ বালকটির মতো শান্ত-সুস্থির। সংবাদ সম্মেলনে হজরতউল্লাহ জাজাইয়ের পেট থেকে কথা বের করতে শীতের বিকেলেও বেশ ঘাম ঝরাতে হলো সাংবাদিকদের। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান থেকে আরও অনেক ক্রিকেটারের উঠে আসার রোমাঞ্চকর গল্পের হদিস চেয়েও হতাশ হতে হলো। জাজাইয়ের যেন বলার মতো কোনো গল্পই নেই!
গল্পের সুলুক সন্ধান করতেই হচ্ছে সাংবাদিকদের। বিশ্বের সবচেয়ে হাড়-কিপ্পন টি-টোয়েন্টি লিগের সুখ্যাতি পেতে চলা বিপিএলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তিনিই। দুই ম্যাচে প্রায় পৌনে দুই শ স্ট্রাইক রেটে ১৩৫ রান তুলে ফেলেছেন। সমান ম্যাচে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রবি বোপারার রান (৮৪) সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের অনেক আসনের ফলকে মনে করে দেয়। ১২টি ছক্কা মেরেছেন, এবারের আসরে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছক্কা যেখানে ৪টি।
ঢাকার সবচেয়ে বড় ডায়নামাইটস এখন পর্যন্ত জাজাই-ই। অনেকেরই তাই কৌতূহল, কে এই জাজাই।
আফগানিস্তানের আরও এক উঠতি বিস্ময় জাজাই কিন্তু ক্রিকেটের হালফিল খবর রাখনেওলাদের কাছে একেবারেই অচেনা নন। বরং ২০ বছর বয়সী এই ৬ ফুটি ব্যাটসম্যান এরই মধ্যে বেশ কিছু কীর্তিতে নিজের নাম জড়িয়ে ফেলেছেন ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের সঙ্গে। এক ওভারে ছয় ছক্কার কীর্তিটা খুব বেশি পুরোনোও নয়। এই তো গত অক্টোবরে, আফগান প্রিমিয়ার লিগে। সেই ম্যাচে অন্য দলের হয়ে খেলেছেন ক্রিস গেইল।
গেইলের ১২ বলে ফিফটির রেকর্ডটা জাজাই ছুঁয়ে ফেলেন গেইলকে সাক্ষী রেখেই। টি-টোয়েন্টির দ্রুততম ফিফটির এই রেকর্ডটা আর আছে যুবরাজ সিংয়ের। যুবরাজের এক ওভারে ছয় ছক্কার কীর্তিটাও সেই সূত্রে মনে পড়ে যাওয়ার কথা অনেকের।
হজরতউল্লাহ জাজাইয়ের নাম সেদিনই ঢুকে গেছে স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স, রবি শাস্ত্রী, হার্শেল গিবস, যুবরাজ, মিসবাহ-উল-হক আর রবীন্দ্র জাদেজার তালিকায়। ক্রিকেটের বিভিন্ন ফরম্যাটে এই ক্রিকেটাররা ওভারে ছয় ছক্কা মেরে ইতিহাসে নিজেদের নাম অমর করে রেখেছেন। প্রথম আফগান হিসেবে সেই কীর্তি হয়ে গেছে জাজাইয়ের। আগস্টে ওয়ানডে অভিষেকের দুই মাসের মধ্যে ওভারে ছয় ছক্কার এই কীর্তি!
২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হলেও জাজাই আসলে তাঁর ৫ ম্যাচের চারটিই খেলেছেন গত আগস্টের সেই আয়ারল্যান্ড সফরে। সেবার ওয়ানডে সিরিজে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও দুই টি-টোয়েন্টিতে ৭৪ ও ৮২ রানের দুটি ইনিংস খেলে একাই আইরিশদের হারিয়ে দিয়েছিলেন। আফগানরা জিতেছিল সিরিজ।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটাই যে তাঁর সবচেয়ে বেশি পছন্দ, সে বলে না দিলেও চলছে। মন খুলেই যদি মারা না যায়, ব্যাট হাতে নেমে আর কী লাভ! এই হলো তাঁর দর্শন। জাজাইয়ের ব্যাটিং আরও ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে এই তথ্যে। ১৭টি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৪ ছক্কা আছে তাঁর। সেখানে স্ট্রাইক রেট ৯৩.১২। ক্রিকেটের এই একটাই ফরম্যাটে তাঁর স্ট্রাইক রেট এক শর নিচে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ১৭৪ রানের ১৩৮-ই নিয়েছেন চার আর ছক্কা থেকে; এই তথ্য তাই এখন আর তেমন বিস্ময়কর লাগছে না।
ক্যারিয়ার আসলে মাত্রই শুরু হলো। এখনো সামনে দীর্ঘ পথ। তবে গত আফগান প্রিমিয়ার লিগেই ৪৪ বলে সেঞ্চুরি হাঁকানো জাজাই নিজের নামটা যাচাই করে নিয়েছেন এবারের বিপিএলের শুরুতে। রাজশাহী কিংসের বিপক্ষে তাঁর ৭৮ এসেছিল ৪১ বলে। আজ ৩৬ বলে করেছেন ৫৭। তবু পরিপূর্ণ তৃপ্ত মনে হচ্ছে না। কারণ? উইকেট যে পছন্দ হচ্ছে না তাঁর। এই উইকেটে টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং করা যায় নাকি!
তা যে যায় না, তা এখন পর্যন্ত বিপিএলের ১২ ইনিংসের ১১টিতেই বোঝা গেছে কম-বেশি। আর মিরপুরের টি-টোয়েন্টি অনুপযোগী উইকেটেই যখন তাঁর ব্যাটে ১৭৫.৩২ স্ট্রাইক রেটের ঝড়, তখন বোঝাই যাচ্ছে, উইকেটটা ব্যাটিং সহায়ক হলে কতবার বল কুড়িয়ে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব নিতে হবে গ্যালারির দর্শকদেরই!
রশিদ-মুজিবদের মতো বোলার উপহার দিয়ে আফগানিস্তান এরই মধ্যে আলাদাভাবে নজর কেড়েছে ক্রিকেট বিশ্বের। মোহাম্মদ নবীর মতো অলরাউন্ডারও আছে। তবে বিচ্ছিন্ন স্ফুলিঙ্গ ব্যাটে ধারাবাহিকভাবে ব্যাটে ঝড় তোলা একজন ব্যাটসম্যানের শূন্যতা ভীষণ অনুভূত হচ্ছিল আফগান ক্রিকেটে। এবার মনে হয় সেটিও পূরণ হয়ে গেল।
জাজাই নামের একটা অর্থ যে সৃষ্টিকর্তার উপহার, এই নামকরণকেও এখন খুব সার্থক মনে হচ্ছে!