নাম ভুলে যাওয়া কেনিয়ার সেই ক্রিকেটারের মুখটি এখনো চোখে ভাসে। ভয়ংকর সাপের কিংবা বাঘের দেখা পাওয়ার মতো ভয়তাড়িত মুখে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেই মাঠের মধ্যিখানে দে ছুট। কী হলো, কী হলো! না, এমন কিছু না। ডিপ মিড উইকেট অঞ্চলের সীমানা–দড়ি ঘেঁষে একটা পটকা ফাটল বারুদগন্ধ ধোঁয়ায়। খেলা বন্ধ খানিকক্ষণ। কেনীয়দের বোঝাতে হলো যে ওটা নিতান্তই নির্দোষ আর নিষ্কলুষ ধোঁয়া। দর্শনানন্দের ধোঁয়া। বাংলাদেশের দর্শকের কাছে ক্রিকেট নেহাতই উৎসবের উপলক্ষ।
সে ১৯৯৫ সালের কথা। আইসিসি ট্রফিতে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া বাংলাদেশ ডেকে এনেছিল বড় দাগা দেওয়া কেনিয়াকে। ওটা সেই অর্থে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছিল না। দ্বিপক্ষীয় সিরিজটিকে বলা যেতে পারত উপ-আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, বড়জোর প্রায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। আর তাতেই কিনা মানুষের ঢল এবং অনিঃশেষ আগ্রহ!
সময়ের সঙ্গে এ দেশে ক্রিকেটের সামাজিক অবস্থান বদলেছে। নিম্নবিত্ত থেকে সেটির গায়ে এখন উচ্চমধ্যবিত্তের স্ট্যাটাস। উপ-আন্তর্জাতিক নয়, খাঁটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখতে দেখতে চোখ রীতিমতো ক্লান্ত। এ দেশে একটিমাত্র মাঠে মিনি বিশ্বকাপ হয়েছে, এক জোড়া যুব বিশ্বকাপ হয়েছে, হয়েছে বিশ্বকাপ, এক হালি এশিয়া কাপ আর কত দ্বিপক্ষীয়-ত্রিপক্ষীয় সিরিজ! মানুষের বদলে যাওয়া রুচিটা এখন নির্ভেজাল আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত। কিন্তু মাঠে যাওয়ার তাড়াটা থেকে গেছে প্রায় একই রকম। ক্রিকেটের নামে মানুষ এখনো পিল পিল করে ঢোকে স্টেডিয়ামে। মুখে রং। বুকের মধ্যে রং। মাথার ফেটিতে সমর্থনের রং। হাতের ঢোল–বাঁশিতে ঐক্যতান। শব্দবাজিতে বিভক্ত গ্যালারি।
ভেতরে–ভেতরে এখনকার সুক্ষ্ম বদল ওই গ্যালারিতেই।
খেলাটা আন্তর্জাতিক হলে বাংলাদেশ দল আগ্রহের নদীতে আগে খুব একটা ঢেউ তুলত না। এখন তোলে। সেই ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যায় গ্যালারি। সাকিব–মুশফিক–মাশরাফিদের বাংলাদেশের কাছে জয় এখন খুব চেনা শব্দ। চেনা ঘ্রাণ। ঘরের ছাদ ছুঁতে না পারলেও অনেক উঁচুতেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আজ না হোক কাল, বড় কোনো শিরোপা জয়ের আনন্দে তিন প্রহরের বিলটা দেখতে পাওয়ার আশা তাই জেগেই থাকে।
বাংলাদেশ হয়তো একটু এগিয়ে, তবে এই রং আর শব্দের সেলুলয়েডে অন্য দলগুলোরও প্রবল উপস্থিতি। ‘মাশ–কিন’ উদ্যাপনেই সম্ভবত গ্যালারি কল্লোলিত হয় বেশি। বোলার সাকিবের উত্তোলিত দুহাতের সফল আবেদন কিংবা পয়েন্ট দিয়ে উড়িয়ে মারা সৌম্যর ছক্কা দেখতে চকচক করে অনেক চোখ। তবে কোহলির কবজির মোচড়ে ঘোরানো চার দেখার অপেক্ষাও থাকে। নাচুনে ভঙ্গিতে আফ্রিদির বিস্ফোরক ছক্কাগুলোও হাততালির ঝড় তোলে গ্যালারিতে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের দর্শককুল এখানেই দেখিয়ে দেন তাঁদের বৈশ্বিক রূপ। নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমী হয়ে ওঠেন তাঁরা।
এ তো গেল স্টেডিয়ামের ভেতরের ছবি। বাইরেরটাও তো রঙে–রসে ভরা। সব বয়সী মানুষের বল্গাহীন স্রোত সেখানেও বসায় আনন্দের হাট। সেই আনন্দ নগরে ক্রিকেট মিলিয়ে দেয় যেন গোটা পৃথিবীকেই। ভিনদেশি ক্রিকেটার বা ক্রিকেট জনতা এসে হাত বাড়ালেই বন্ধু পেয়ে যান এখানে।
এই সেতুটি বেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সমাজের কাছে বাংলাদেশও হয়ে ওঠে এক পরম বন্ধু। নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থাকায় বিশ্বকাপের আয়োজন–স্বত্ব হারায় বিশ্বকাপের তিন আয়োজকের অন্যতম পাকিস্তান, তাদের ম্যাচগুলোর বেশির ভাগই দেওয়া হয় বাংলাদেশকে। নিরাপত্তা নিয়ে এক ক্রিকেট পরাশক্তির সব সংশয়কে একেবারে ‘নো–নেটওয়ার্ক’ করে দিয়ে অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ এ দেশেই আয়োজনে অবিচল থাকে আইসিসি।
এশিয়া কাপের কথা আর কী বলা যায়? বিশ্ব ক্রিকেটের একমাত্র মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার ঘরবসতিই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ভারতের আয়োজনে অনীহা। পাকিস্তান আয়োজন করতে পারে না। শ্রীলঙ্কা নিমরাজি। ব্যস, এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল টুর্নামেন্ট তুলে দেয় বাংলাদেশের হাতে। হয়ে গেল! এই করে করেই চার বছরের মধ্যে তৃতীয় এশিয়া কাপের আয়োজন বাংলাদেশে।
আর বাংলাদেশে কেমন হয় সেই আয়োজন? শুধুই জড় পদার্থের স্থাপনার মধ্যে মাঠের খেলার নিষ্প্রাণ অধিষ্ঠান নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অগুণন ক্রিকেটপ্রেমীর সবুজ আবেগ। সুষ্ঠু আয়োজনের দক্ষতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একেবারে রাজযোটক। যেমনটি বলা হয়েছে শুরুতেই।
বসন্তের উদাসী হাওয়ার রাতগুলোতে এবারও এশিয়া কাপ দোদুল দোলাবে মহাদেশীয় ক্রিকেটকে। সফল আয়োজনের মস্ত একখান সার্টিফিকেট পাবে বিসিবি। যেভাবে পেয়ে এসেছে এত দিন। লিখে রাখতে পারেন। কিন্তু কবে আসবে সেই ইচ্ছেটাকে আগেই শব্দে গেঁথে রাখার সময়? মাঠের খেলায় সেরার মুকুট জয়ের ইচ্ছে?
একটা সময় আয়োজকদের খিদেটাও তীব্র হয়। রঙিন আলোয় এশিয়া কাপের মঞ্চ তো সাজানো হলো অনেকবার। এবার নাহয় মুকুট পরার ইচ্ছে জাগুক আয়োজকদের!