আইসিসির শাস্তি ঘোষণার পর সাকিব আল হাসান সন্ধ্যায় বিসিবিতে এলেন তাঁর সাদা বিএমডব্লুতে চড়ে। পরনে সাদা স্ট্রাইপের শার্ট। সাদার সঙ্গে যাঁর এত সখ্য, সেই তিনি নিজের ক্যারিয়ারটা রাখতে পারেননি নিষ্কলুষ। তাঁর শ্বেত-শুভ্র খেলোয়াড়ি জীবনে কত বড় এক কালি লাগল আজ!
দীপক আগারওয়াল নামের এক জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন সাকিব। তাঁর প্রস্তাবে তিনি রাজি হননি। জুয়াড়ির চাওয়া অনুযায়ী দলের ভেতরের কোনো তথ্য দেননি। ম্যাচও পাতাননি। তবুও তাঁর অপরাধ, কেন বিষয়টি আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে (আকসু) সাকিব জানাননি। ঘটনা হঠাৎ ঘটেনি। ঘটেছে ধীরে ধীরে।
ঘটনার শুরু ২০১৭ সালের নভেম্বরে, যেটি চলতে থাকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। দুটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, একটি আইপিএলের ম্যাচ—তিন-তিনটি ম্যাচের আগে জুয়াড়ি দীপকের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপে নানা কথাবার্তা চালাচালি হয়েছে দুজনের। নিজেও একটা সময় আবিষ্কার করেছেন, এই দীপক পাকা জুয়াড়ি। তবুও কেন চুপ থাকলেন?
আইসিসির দুর্নীতি দমনের আইন তো খুব ভালো করেই জানেন সাকিব। আইসিসির বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি বিরোধী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এমনকি ১০-১১ বছর আগেও যখন জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন, আকসুকে জানাতে দুবার ভাবেননি। অথচ পরিণত সাকিব, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক যুগের বেশি সময় কাটিয়ে দেওয়ার পরও বিষয়টি আকসুকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি! তাও এমন একজন জুয়াড়ির প্রস্তাব, যিনি আইসিসির কালো তালিকাভুক্ত!
বুদ্ধিমত্তায় বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ক্রিকেটার হচ্ছেন সাকিব, এটিতে দ্বিমত করার মানুষ খুবই কম আছে। তাঁর চাপ সামলানোর ক্ষমতা সব সময়ই মুগ্ধ করে। সস্তা আবেগে ভেসে যান না। কাউকে তোষণ করে চলেন না। ভীষণ সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, যেকোনো বিষয়ে অকপট। দ্বিধায় ভোগেন খুবই কম। যেটা ভাবেন দুম করে সেটিই করে ফেলেন। সাকিব হচ্ছেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক ক্রিকেটার। নিজের প্রতিভা, পরিশ্রম, চেষ্টা আর সামর্থ্যরে সফল প্রয়োগে গত ১৩ বছরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হিসেবে। সেই সাকিব কীভাবে এই ভুলটা করলেন?
এটা ঠিক নিজের কাজের প্রতি তাঁর সততা, নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি কখনোই। ফিক্সিংয়ের অপরাধে ৫ বছর নিষিদ্ধ হয়ে থাকা মোহাম্মদ আশরাফুলকে যে কজন ক্রিকেটার কখনোই আর বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে দেখতে চান না, সাকিব তাঁদের একজন। ম্যাচ পাতানো বা দুর্নীতিকে তিনি এতটাই ঘৃণা করেন! এ কারণেই হয়তো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন সাকিব।
সেই সাকিব একজন জুয়াড়ির প্রস্তাব পেয়ে দিনের পর দিন চুপ থেকেছেন। এসিইউকে কিছুই জানাননি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সাকিব চলেছেন ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাবে। নিজের ওপর তাঁর অগাধ আস্থা, আত্মবিশ্বাস আর সততা থেকে মনে করেছেন, তিনি ভুল কিছু করছেন না। কিন্তু এটিই তাঁকে ডুবিয়েছে। হয়তো ভেবেছেন, জুয়াড়িকে যখন গুরুত্ব দিচ্ছি না, কিছুই হবে না। হয়তো ভেবেছেন এটা গুরুত্ব দেওয়ার মতোও কিছু না। অথবা যাঁর মাধ্যমে জুয়াড়ি আগারওয়াল সাকিবের নম্বরটা পেয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি বাংলাদেশ অলরাউন্ডারের কাছে এতটাই পরিচিত ছিলেন তাতে হয়তো ভেবেছিলেন ক্ষতিকর কিছু হবে না। কিন্তু এতেই যে বড় ক্ষতি হয়ে গেল!
তারকা খেলোয়াড়দের সঙ্গে নানা পেশা, নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। সখ্য হয়। সাকিবও ব্যতিক্রম নন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা অনেকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা নিবিড় হওয়ায় নিজেকে ভীষণ ক্ষমতাবান ভাবাও অমূলক নয়। আর সেই ভাবনা থেকে যেকোনো সমস্যা সামলে নেওয়ার চিন্তাটা উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু এই বিষয়টি যে সামলানো অনেক কঠিন হবে, সাকিবের তো সেটিও অজানা নয়।
ভুল মানুষই করে। যতই স্মার্ট, তীক্ষ্ণবুদ্ধির হন না কেন; রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে সাকিবও ভুল করেছেন। সমস্যাটা হচ্ছে, খেলোয়াড়ের নাম সাকিব আল হাসান। তাঁর এই ভুলে শুধু সাকিব নন, ভুগতে হবে যে পুরো বাংলাদেশ ক্রিকেটকেই!
আরও পড়ুন:
ম্যাচ না পাতিয়েও কেন শাস্তি পেলেন সাকিব
সাকিবকে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারতীয় জুয়াড়ি
সাকিবের ওপর রাগই হয়েছে বিসিবি সভাপতির
নিজের ভুলে দুঃখিত সাকিব
সাকিবের দায় স্বীকার, দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা
সাকিব আরও শক্ত হয়েই ফিরবেন, বলছেন শিশির
দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা এড়াতে যা করতে হবে সাকিবকে