স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামের বাইরে ভিভ রিচার্ডসের মূর্তি
স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামের বাইরে ভিভ রিচার্ডসের মূর্তি

ক্যারিবিয়ান ডায়েরি

কিংবদন্তিদের দ্বীপে নিনজা ‘টেকনিক’

তাঁকে এড়িয়ে চলার এক শ একটা কারণ অ্যান্টিগায় এই তিন দিন থেকেই আবিষ্কার করে ফেলেছি। তাঁর গাড়িতে উঠলে সেই গাড়ি পদে পদে থেমে যাবে। গোটা অ্যান্টিগায় যত মানুষ, সবাই যেন তাঁর পরিচিত! রাস্তায় যাঁকেই দেখবেন, গাড়ির গতি কমিয়ে হাত নাড়বেন, মৃদু হর্ন দেবেন। এই মৃদু হর্ন দেওয়াটা নাকি এখানে ‘হ্যালো’ বলার মতো।

তারপরও অ্যান্টিগায় ঘুরেফিরে আমার দেখা হয়ে যাচ্ছে নিনজা ট্যাক্সির এই ষাটোর্ধ্ব চালকের সঙ্গে, যাঁকে নাম জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘আমার নাম নিনজা–ই, নিনজা ট্যাক্সি। গোটা অ্যান্টিগায় আমাকে এই এক নামে সবাই চেনে। ইউ কল, আই হওল (তুমি ডাকবে, আমি তোমাকে নিয়ে চলে আসব)।’

ভিভ রিচার্ডসের বাড়ি সামনের দিকটা এ রকমই

৬ ফুটের বেশি লম্বা সুঠাম দেহের ‘নিনজা’র সঙ্গে প্রথম দেখা অ্যান্টিগার ভিসি বার্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। হোটেলে আসার জন্য ট্যাক্সি নেব, ট্যাক্সির কাউন্টার থেকে ধরিয়ে দিল নিনজাকে। পরদিন হোটেল থেকে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে যাব। হোটেলের রিসেপশনে বললাম ট্যাক্সি লাগবে। তারা ফোনে কাকে যেন বলল। একটু পর দেখি গেটের সামনে নিনজা এসে হাজির। সর্বশেষ কাল যখন সিদ্ধান্ত নিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাঠে যাওয়ার ট্যাক্সিটা নিজেই ঠিক করে নেব, এবারও কোত্থেকে সেই নিনজাই এসে আমার পাশে তাঁর মাইক্রোবাস থামিয়ে মৃদু হর্ন বাজালেন, নিনজা ‘টেকনিকে’ যার অর্থ ‘হ্যালো’।

কাজে যাওয়া–আসার পথে ট্যাক্সিওলা বারবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে গিয়ে মানুষকে ‘হ্যালো’, ‘হ্যালো’ বললে বিরক্তির উদ্রেক হতেই পারে। তবে নিনজার গাড়িতে চড়ার সুবিধাও অনেক। ছোট্ট অ্যান্টিগার কোথায় কী আছে, সেটা আপনাকে তিনি এক নিশ্বাসে বলে দেবেন। আর যদি আপনি এখানে স্বল্প সময়ের জন্য ক্রিকেট কাভার করতে আসেন, তাহলে নিনজা হয়ে উঠতে পারেন বড় এক ভরসার নাম।

গত তিন দিন নিনজার ট্যাক্সিতে ঘুরে যেটা সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে, পরশু মাঠে আসার পথে নিনজা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন অ্যান্টিগার আপার গ্যাম্বলার্স এলাকায় ভিভ রিচার্ডসের প্রথম বাড়িতে। প্রথম বাড়ি বলতে নিজের আয়ে কেনা প্রথম বাড়ি। রাস্তার পাশে টিন শেডের হলুদ রঙের একতলা দালান। এখানকার বাড়িগুলো যে রকম হয়, সামনে–পেছনে অনেক খোলা জায়গা। বাড়ির গেটে একটা ব্যাটের নকশা করা। ব্যাটের দুই পাশে বৃত্তের মধ্যে দুটি করে ইংরেজি অক্ষর, ‘ভি’ এবং ‘আর’—ভিভ রিচার্ডস।

স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামের বাইরের দৃশ্য

স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস এখন আর এ বাড়িতে থাকেন না। দ্বীপের আরেক দিকে নতুন বাড়িতে চলে গিয়ে নিজের প্রথম বাড়িটি দিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ঘরে হওয়া কন্যাসন্তানকে। বাড়িটি দেখানো শেষে ট্যাক্সি স্টার্ট দিয়ে নিনজা বলতে শুরু করলেন, ‘তুমি কি জানো, ভিভি রিচার্ডস ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবলটা বেশি ভালো খেলতেন? আর তাঁর ভাই মারভান রিচার্ডস ছিলেন ভিভ রিচার্ডসের চেয়ে ভালো ক্রিকেটার। পরে দুজনই তাঁদের খেলাটা বদলে ফেললেন। ভিভ হয়ে গেলেন পুরোপুরি ক্রিকেটের, মারভান খেলা শুরু করলেন ফুটবল। কী অদ্ভুত!’

দুবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট জেতা ভিভ রিচার্ডস সম্পর্কে তথ্যটা অবশ্য নতুন নয়। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি ক্রিকেট, ফুটবল—দুটোরই বিশ্বকাপে খেলেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১২১টি টেস্ট ও ১৮৭টি ওয়ানডে খেলা ক্রিকেট কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডস ১৯৭৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ছিলেন অ্যান্টিগা দলের সদস্য। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে অ্যান্টিগার হয়ে দুটি ম্যাচ খেলেছেন তাঁর ছোট ভাই মারভান রিচার্ডসও। আর তাঁদের বড় ভাই ডোনাল্ড রিচার্ডস ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার।

ভিভ রিচার্ডসের মতো অ্যান্টিগা জন্ম দিয়েছে আরও অনেক ক্রিকেট কিংবদন্তির। রিচি রিচার্ডসন, কার্টলি অ্যামব্রোস, স্যার অ্যান্ডি রবার্টস—সবাই অ্যান্টিগারই সন্তান। বাংলাদেশ–ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টে অবশ্য তাঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত দেখা পাওয়া গেছে শুধু অ্যামব্রোস আর রবার্টসের।

অ্যামব্রোস তো ধারাভাষ্যই দিচ্ছেন। রবার্টসের মূল নেশা ফিশিং বোট নিয়ে সমুদ্রবিহারে যাওয়া, তবে পেশায় তিনি এখন একজন কিউরেটরও। সিরিজ শুরুর আগে বাংলাদেশ দল যে কুলিজ ক্রিকেট মাঠে অনুশীলন করেছে, সেই মাঠের কিউরেটর তিনি। টেস্ট দেখতে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামেও আসছেন রবার্টস। তবে রিচি রিচার্ডসন আর ভিভ রিচার্ডস যেন দূর আকাশের তারা! নিনজা জানালেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারে যদি ভিভ ক্রিকেট মাঠে আসেন তো আসতে পারেন। নইলে তিনি এখন গলফ খেলেই বেশি সময় কাটান।

অ্যান্টিগার ক্রিকেট কিংবদন্তিদের বর্তমান অবস্থার অভিধানটা যাঁর পুরো মুখস্থ, সেই নিনজাও কিন্তু একসময় ক্রিকেট খেলেছেন। ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন তাঁর ছেলেও। কিন্তু ভিভ রিচার্ডসদের ‘কাজিন’ (এখানে সবাই সবার জ্ঞাতি ভাই) হয়েও যে তাঁর পরিবার থেকে বড় কোনো ক্রিকেটার উঠে এল না, তা নিয়ে আফসোসের শেষ নেই নিনজার। তাঁকে সবাই চেনেন, এটাই নিনজার একমাত্র তৃপ্তির জায়গা, ‘ওরা (অ্যান্টিগার ক্রিকেট কিংবদন্তিরা) সবাই আমাকে চেনেন। আর আমার চেয়ে অ্যান্টিগা কেউ বেশি চেনে না। আমি নিনজা—ইউ কল, আই হওল।’