প্রথম ফাইনাল জিতল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। রোমাঞ্চকর সেই জয় একদম কাছ থেকে দেখেছেন আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় এই টুর্নামেন্টে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া প্রথম আলোর ক্রীড়া সাংবাদিক রাজীব হাসান। জানিয়েছেন সেই মুহূর্তের কথা।
মাশরাফিও যে নখ কামড়ান, জানা ছিল না! বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্ব নন, সাংসদও নন, মাশরাফিকে তখন দেখাচ্ছিল টিভির শোরুমের স্বচ্ছ কাচের বাইরের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর দশটা কিশোর সমর্থকের মতোই! আমাদের নিজস্ব সুপারম্যান, তাঁরও সে কী টেনশন!
ততক্ষণে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা প্রায় সবাই ড্রেসিংরুমের আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। কিন্তু ক্রিকেটাররা সেই ঠান্ডাই বেছে নিলেন। উত্তেজনার নিজস্ব একটা উত্তাপ আছে। তার কাছে হার মেনেছে ডাবলিনের ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা!
৩ ওভারে ২৭ রান লাগে। তিন নং সাতাশ! নামতায় সহজ, ব্যাটে কঠিন। কঠিন, আবার কঠিনও নয়। টি-টোয়েন্টির ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ জমানায় এ আবার কোনো রান নাকি! একটা ওভারে ঝড় তুললেই তা হয়ে যায়। আবার ওই একটা ওভারে রান তুলতে না পারলেই সর্বনাশ। এ বড় দারুণ বাজি, যে পারে তারে কই বড় বাজিকর! বাংলাদেশের হয়ে বাজিকরটা কে হবেন? স্ট্রাইকিং প্রান্তে মোসাদ্দেক, সাকিব পুরো ফিট থাকলে এই ম্যাচে যাঁর খেলাই হতো না।
তাঁবুমতন প্রেসবক্সের অসুবিধাই এত দিন পেয়ে এসেছি। এদিন পেলাম সুবিধা। সামনের দিকে উদোম প্রেসবক্সের কারণেই তো একই সঙ্গে উইকেট আর ড্রেসিংরুম—দুটোই নজরে রাখার সৌভাগ্য হচ্ছিল। বল করতে আসছেন ফাবিয়েন অ্যালেন। প্রস্তুত মোসাদ্দেক। স্ট্যান্স নিতে গিয়ে ব্যাটটা হালকা নাচালেনও। গদার মতো!
বাংলাদেশের বাকি সব খেলোয়াড় ড্রেসিংরুমের পাশে উঠানমতো দেখতে ফাঁকা জায়গাটায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে। সবাইকে অভয় দিয়ে নিজেই পেছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।
মাশরাফির টেনশনের কারণটা বোঝা যাচ্ছিল। ফাইনাল শব্দটা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এর আগে ছয়-ছয়টি ফাইনালে বাংলাদেশ পারেনি। পারেনি বলেই সেটি হয়ে উঠেছে একটা মানসিক বাধা। শিরোপা জেতার চেয়ে এই মানসিক বাধাটা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলার জন্যই বেশি ব্যাকুল অধিনায়ক।
অ্যালেন বল করলেন। মোসাদ্দেক শেষ মুহূর্তে সরে আসছেন দেখে ইচ্ছে করেই লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে বলটা ফেললেন ক্যারিবীয় স্পিনার। উদ্দেশ্য মোসাদ্দেকের ভারসাম্য নষ্ট করা। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়, মোসাদ্দেক ওরই মধ্যে যেন সুপারসনিক গতিতে কত কিছু করে ফেললেন! স্ট্যান্স বদলালেন, ব্যাটের গ্রিপ অদল-বদল হলো, ডানহাতি মোসাদ্দেক হয়ে গেলেন বাঁহাতি, লাফিয়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে অ্যালেনের বলে পয়েন্টকে স্কয়ার লেগ বানিয়ে মেরে দিলেন ছক্কা!
ওই একটা শটে কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস থাকল, বোকা অক্ষরের সাধ্য নেই বোঝায়! ওই একটা শটেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল! নাকি ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ঢের আগে, সৌম্যের নিজের নামের আভিধানিক অর্থটাকে উল্টে দিয়ে রুদ্ররূপে হাজির হওয়াতেই!
সত্যি বলতে কি, মোসাদ্দেকের ওই শটের পর ওভারের বাকি ৫টা বল আর দেখাই হলো না। এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, ওই ওভারের বাকি ৫ বল সত্যিই আমি দেখিনি। দেখার উপায়ই আসলে ছিল না।
বাংলাদেশের চেয়ে আয়ারল্যান্ড সময়ে ৫ ঘণ্টায় পিছিয়ে। ছাপা পত্রিকার ডেডলাইনের সঙ্গে সফরের পুরোটা সময় পাল্লা দিতে হয়েছে। ফাইনালের দিন বৃষ্টি কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলেছিল সব দিক দিয়েই। বৃষ্টিবাধায় ৫ ঘণ্টার মতো বন্ধ ছিল খেলা। আয়ারল্যান্ডে আধা মাসের সফরে ওই দিনটার আবহাওয়া ছিল সবচেয়ে প্রতিকূল। ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাতের আঙুলের ডগা যেন কি–বোর্ডে বসতেই চাইছিল না। এর সঙ্গে ম্যাচের ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা তো আছেই। পেশাদার সাংবাদিকের খোলসের ভেতরে কেই–বা এই দলের সমর্থক নয়! এই দল জিতলে আর দশটা সমর্থকের মতোই তো আবেগ ছুঁয়ে যায়। কিন্তু এই পেশার যন্ত্রণাটাই হলো, রেললাইনে গর্দান পেতে রাখা অবস্থাতেও আপনাকে লিখে যেতে হবে! অফিস যে তাড়া দিচ্ছে, যা লিখেছেন, সেটাই দিয়ে দেন!
মোসাদ্দেকের ওই সুইচ হিটের ছক্কার পরও বাংলাদেশের দরকার ১৭ বলে ২১। ম্যাচ বাংলাদেশ হারতেও পারে। কিন্তু অফিসের তাড়া, নাকি মোসাদ্দেকের ওই সুইচ হিটের প্রবল আত্মবিশ্বাসের ঢেউ প্রেসবক্সেও এসে আন্দোলিত করে গিয়েছিল—এখন আর বলতে পারব না। ১৭ বল বাকি থাকতেই ম্যাচ রিপোর্ট লেখা শুরু করে দিয়েছি। বাংলাদেশ জিতেছে ধরে নিয়েই। ইন্ট্রোর জায়গাটা ফাঁকা রেখে বাকিটা লেখা শুরু। বাংলাদেশের উদ্যাপন ধরে সূচনা লিখব, পরিকল্পনা এমনই।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, বাংলাদেশের দরকার মাত্র ২ রান! ম্যাচ রিপোর্টের এক প্যারাও তখনো লেখা হয়নি! এক ওভারেই ২৫ তুলে মোসাদ্দেক ‘সর্বনাশ’ করে দিয়েছেন! ওয়েস্ট ইন্ডিজের শুধু নয়, বেচারা সাংবাদিকদেরও। অনেকেরই তখনো ইন্ট্রোই লেখা হয়নি। কেউ মাত্র একটা আবেগপ্রবণ শিরোনাম লিখেছেন কি লেখেননি! ওই একটা ওভার সর্বনাশ করে দিয়ে গেল অন্যভাবে। ম্যাচ ঘিরে যত উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, ওই ওভার দপ করে সেটা নিভিয়ে দিল। বাংলাদেশের উদ্যাপন যেমনটা হবে বলে অনুমান করেছিলাম, অনেকে তো আগ বাড়িয়ে মুঠোফোনের ক্যামেরা পর্যন্ত তাক করে রেখেছিল, সব ভেস্তে গেল। কেউ দৌড়ে মাঠে ঢুকল না। স্টাম্প নিয়ে কাড়াকাড়ি পর্যন্ত হলো না! অথচ যেকোনো বিচারেই এটি বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক এক জয়!
বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা অবশ্য ট্রফিটা হাতে পাওয়ার পর বেশ উচ্ছ্বসিতই ছিলেন। প্রেসবক্স থেকে মাশরাফির কথাটা স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল—‘অবশেষে! অবশেষে!’ মনে পড়ছিল, আগের দিন ফাইনাল শব্দটা নিয়ে অধিনায়কের সে কী টেনশন! আরও একবার ব্যর্থ হলে এর ক্ষতি যে হতো সুদূরপ্রসারী। তবে কি আমরা পারি না—এমন একটা ভয় স্থায়ী জায়গা করে নিত। সত্যি বলতে গিয়ে ম্যাচটা সেদিকেই যাচ্ছিল। বৃষ্টির আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান বিনা উইকেটে ১৩১। এরপর ৫ ঘণ্টার সেই দীর্ঘ বিরতি। ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে, বৃষ্টিতে ম্যাচ ভেসে গেলেই বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু যদি আবার খেলা শুরু হয়? ডাকওয়ার্থ-লুইসের হিসাব বলছে, একটা উইকেট ফেলতে না পারলে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া স্কোরেরও ঢের বেশি রান!
ম্যাচ যখন থেমে, আবার খেলা শুরু হয় কি না হয়—এমন অনিশ্চয়তা, মাশরাফির সঙ্গে ক্ষণিক সাক্ষাতের সুযোগ মিলল অপ্রত্যাশিতভাবেই। এমন ঠান্ডায় কিছুতেই লেখা যাচ্ছিল না বলে পাগলের মতো একটু উষ্ণ জায়গা খুঁজছি। ড্রেসিংরুম লাগোয়া একটা ভবন আছে, পুরো মাঠে এটাই একমাত্র স্থায়ী স্থাপনা। সেখানে যদি একটু উষ্ণতা পাই! সেখানে আবার ওয়াই–ফাই নেই! ফলে প্রেসবক্স থেকে সেই ভবন ছোটাছুটি করতে হয়েছে মাঝেমধ্যেই। এর মধ্যেই হঠাৎ দেখি ড্রেসিংরুমের পেছনে মাশরাফি। আইসিসির কর্মকর্তা সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন, এই অবস্থায় বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলার নিয়ম বুঝি নেই!
বৃষ্টির ছাঁট থেকে ল্যাপটপটাকে যতটুকু বাঁচানো যায়, সেভাবে বগলদাবা করে হেঁটে যেতে চকিতেই মাশরাফিকে বললাম, ‘জানেন তো, খেলা না হলে কিন্তু বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন!’ মাশরাফি জানতেন না। শুকনো হাসি হেসে বললেন, ‘ভালোই তো।’ বললেন বটে, কিন্তু তখনো তাঁর চোখমুখ বলে দিচ্ছিল, না খেলে অগৌরবের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ হতে চায় না।
কিন্তু বৃষ্টি থেমে ঝলমলে রোদ যখন উঠল, বাংলাদেশের কাজটা হয়ে গেল আরও কঠিন। ভাগ্য ভালো, শেষের ৩.৫ ওভারে বাংলাদেশ শুধু রানই আটকাল না, এর মধ্যে এক ওভারে মাত্র ৩ রান দেওয়া মিরাজ ওপেনিং জুটিটা ১৪৪ রানে থামালেন। এই একটা উইকেট না পড়লে বাংলাদেশের লক্ষ্য কিন্তু ২১০-এর অনেক বেশি হয়ে যেত! বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামার আগে মাশরাফি আরও একবার সবাইকে ঘাড়ে হাত রেখে বৃত্তবন্দী করালেন। সেখানে অধিনায়ক কী বলেছেন, সেটা ম্যাচ শেষে মোসাদ্দেকের কাছে জানা গিয়েছিল। অধিনায়ক বলেছেন, ‘আমরা পারব। না পারার কোনো কারণ নেই!’
তারপর সৌম্যের ব্যাটে ভর করল দুরন্ত সাহস। ২৭ বলে ফিফটি করলেন, ৫ ওভারের পাওয়ার প্লেতেই বাংলাদেশ ৫১। সৌম্যর রান তখন ৩৯, যার ৩৬-ই এসেছে বাউন্ডারি থেকে! ফ্লাইং স্টার্ট! সেই সাহসটাই পরে সঞ্চারিত হয়েছে মোসাদ্দেকের ব্যাটে। ২৩ বলে ফিফটি তুলে নেওয়া এই মোসাদ্দেক প্রথম ৮ বলে করেছিলেন ৭ রান! সেখান থেকে কী ঝড়টাই না তুললেন। ২৫টি সিরিজ জিতে আসার পর প্রথম টুর্নামেন্ট ট্রফি জিতল বাংলাদেশ। প্রথম, কিন্তু শেষ নয় নিশ্চয়ই।
পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে ট্রফিটা নিয়ে এসে যত দ্রুত সম্ভব সতীর্থদের দিয়ে দিয়েছেন মাশরাফি। তারপর সেটি একের পর এক হাতবদল হলো। কেউ কোলে নিচ্ছেন, কেউ চুমু খাচ্ছেন, কেউ ট্রফিটার সঙ্গেই তুলছেন সেলফি। এর মধ্যে একজন ‘চ্যাম্পিয়নস’ লেখা বিশাল একটা বোর্ড নিয়ে এল। যেন আগুনে পুড়ে লালচে আভা ছড়ানো সোনার অক্ষরে লেখা! সোনালি রঙের তিনটা স্টাম্পের আদলে বানানো ট্রফিটাকেও যেন আরও বেশি সোনালি লাগল।
ক্রিকেটারদের অনেকেই সেদিন রোজা রেখে খেলেছেন। মাহমুদউল্লাহ তো ড্রেসিংরুমে ঢুকেই নামাজ পড়তে শুরু করেছেন। তাঁর দেখাদেখি বাকিরাও। এরপর হোটেলে ফিরে ইফতারির তাড়া ছিল। ফলে মাঠের উদ্যাপন যতটা সংক্ষিপ্ত করা যায়, তার তাড়া ছিল। মাশরাফি-তাসকিনদের রাতেই ফ্লাইট ছিল দেশে ফেরার। তামিমও সে রাতেই ফিরেছেন দুবাইয়ে। চার-পাঁচজনের রাতের ফ্লাইট। বাকিদের সবার সকালে। ২০১৯ বিশ্বকাপের মূল স্কোয়াড পাশের দেশ যুক্তরাজ্যে, বাকিরা দেশে। মাশরাফির কথা বলার উপায়ই ছিল না। এমনকি ম্যাচ শেষে যে মোসাদ্দেক কথা বলেছেন, সেটিও তাঁকে প্রায় ছেড়ে দেয় দেয় করা টিম বাস থেকে নামিয়ে আনা।
এর মধ্যে কেউ কেউ দেশে ফোন দিয়েছেন। মুশফিক দলের মধ্যে সবচেয়ে আবেগপ্রবণ। হয়তো ক্রিকেটপাগল বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে মাত্রই মাকে ফোনে পেয়েছেন। দেশে তখন গভীর রাত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সবাই যে তখনো জেগে, তা–ও বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট!
টানা উত্তেজনার পর হঠাৎ অবকাশ পেলে কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগে! সব আয়োজন সাঙ্গ হলে আশ্চর্য নীরবতার ভেতরে যখন কেবল কিছু শব্দশ্রমিকের কি–বোর্ডের খুটখুট শুনতে পাচ্ছি, এর মধ্যে দেশ থেকে একজন খুব আবেগপ্রবণ মেসেজ পাঠালেন ফেসবুকে: ‘জানি না, এই জয় নিয়ে এত আদিখ্যেতা করা ঠিক হচ্ছে কি না। কিন্তু আজ রাত জেগে শুধু কাঁদতে ইচ্ছে করছে।’ পেশাদার সাংবাদিকের আবেগপ্রবণ হওয়া বারণ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তো সেই দায় নেই। তাঁকে এই বার্তার জবাব দিতে রবীন্দ্রনাথকেই অনুরোধ করেছিলাম। তিনি নাকি শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে লিখেছিলেন: এত দিনে জানলেম যে কাঁদন কাঁদলেম সে কাহার জন্য। ধন্য এ জাগরণ, ধন্য এ ক্রন্দন, ধন্য রে ধন্য!