বল টেম্পারিং—এই একটা ভুল এলোমেলো করে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটকে। স্টিভেন স্মিথ অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন, ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়েছেন এক বছরের জন্য। প্রায় নয় মাস কেটে গেছে। বল বিকৃতির ঘটনা ঘটানো ক্যামেরন ব্যানক্রফটের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ প্রায় শেষ হতে চলল। এমন অবস্থায় দুজনই মুখ খুলেছে তাদের অবস্থান সম্পর্কে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির জন্য বিখ্যাত সাবেক ক্রিকেটার অ্যাডাম গিলক্রিস্টের কাছে দিয়েছেন একান্তে সাক্ষাৎকার। কিন্তু সে সাক্ষাৎকার সন্তুষ্ট করতে পারেনি অনেককেই।
নিজেদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্মিথ ও ব্যানক্রফট দুজনই ইনিয়ে-বিনিয়ে চেষ্টা করেছেন দায় এড়িয়ে যেতে। সাবেক অধিনায়ক টেম্পারিংয়ের মূলে যেকোনো মূল্যে জয়ের সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। আর সে জন্য ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাবেক দুই কর্মকর্তা জেমস সাদারল্যান্ড (ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধান নির্বাহী) আর প্যাট হাওয়ার্ডকে (সাবেক পারফরম্যান্স পরিচালক) দোষী দেখিয়েছেন। এ দুজন নাকি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হারার পর ড্রেসিংরুমে এসে বলেছিলেন, ‘আমরা তোমাদের শুধু খেলার জন্য টাকা দিই না, জেতার জন্য দিই।’
মূল ঘটনার সময়ও বল বিকৃতির ঘটনাটিতে স্মিথ জড়িত ছিলেন না। ওয়ার্নারই নাকি সবকিছুর মূলে আর স্মিথের ভুল ছিল দেখেও না দেখার ভান করা। এ কথা বলে নিজেকে পাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন স্মিথ। মজার ব্যাপার, বল বিকৃত করা ব্যানক্রফটও দায়টা তুলে দিয়েছেন ওয়ার্নারের কাঁধে। তাঁর দাবি, বল যে বিকৃত হচ্ছে সে ব্যাপারে নাকি জানতেনই না। দলে একজন নতুন খেলোয়াড় হিসেবে শুধু নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেই চেষ্টা করছিলেন ব্যানক্রফট, ‘ম্যাচে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, তা দেখে ডেভ (ওয়ার্নার) আমাকে বলেছিল কাজটা করতে। আমি এ ব্যাপারে আর কিছুই জানতাম না। আমি শুধু চেয়েছিলাম দলে আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ হতে, দলে নিজের মূল্য বাড়াতে। এই তো! সেই মুহূর্তে আমি কী চেয়েছিলাম, সেটার একটা প্রভাব সিদ্ধান্তে ছিল। আর সে মুহূর্তে আমি চেয়েছিলাম দলে ভালোভাবে মিশে যেতে। দলে মিশতে পারলে সম্মান বাড়ে—এমনটাই তো ভাবে সবাই। তবে ওই ভুলটার বড় মূল্য দিতে হয়েছে আমাকে।’
কথাটি গ্রহণযোগ্য হতে পারত। কিন্তু দুটি বিষয় সেটা মেনে নিতে দিচ্ছে না। প্রথমত, ব্যানক্রফটের বয়স ২৫। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে ৭৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ফেলার পর ‘কিছুই জানতাম’ না বললে মানা কঠিন। ৭ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বল টেম্পারিং সম্পর্কে ভালোই ধারণা থাকার কথা তাঁর। আর দ্বিতীয়ত, ২০১৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়েছেন ব্যানক্রফট। তাঁর মতো ক্যারিয়ারে দুর্দান্ত শুরু খুব কম অস্ট্রেলিয়ানেরই হয়েছে। ‘ক্লোজ ইন’ ফিল্ডার হিসেবেও নাম কামিয়ে ফেলছিলেন ব্যানক্রফট। এমন একজনের দলে জায়গা নিশ্চিত করতে বল টেম্পারিং করতে হচ্ছে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।
দুজনের সাক্ষাৎকার দেখেই মনে হচ্ছে ওয়ার্নারের ‘ব্যাড বয়’ ইমেজ কাজে লাগাচ্ছেন। যেহেতু এই ওপেনার সম্পর্কে সবার আগ থেকেই নেতিবাচক একটা ধারণা রয়েছে, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছেন এ দুজন। ইনিয়ে-বিনিয়ে কোনোভাবে দায়টা ওয়ার্নারের ঘাড়ে চাপাতে পারলেই তো সবাই সেটা লুফে নিচ্ছেন। সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যের দায়িত্বে থাকা কেরি ও’কিফের এমন পলায়নপর মানসিকতা পছন্দ হয়নি। তাঁর মনে হয়েছে স্মিথ ‘আসলেই কী ঘটেছে’ সেটা খোলাসা করে বলেননি এবং নিজের দায় স্বীকার করেননি বরং কর্মকর্তাদের ঘাড়েও দায় চাপাতে চেয়েছেন, ‘আমি শুনতে চাই স্টিভ স্মিথ বলছে, “যা ঘটেছে আমি তার পূর্ণ দায় নিচ্ছি”, আমি শুনতে চাই না এটা প্যাট হাওয়ার্ড ও জেমস সাদারল্যান্ডের দোষ। তুমি তোমার বসের দায় দিতে পার না। সে একবারও বলেনি, “আমি সম্পূর্ণ দায় নিচ্ছি।”’
সাবেক অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারও এত কথা বার্তায় বিরক্ত, তাঁর ভাষায় দোষ স্বীকার করে নিতে তো কোনো লজ্জা নেই, ‘অনেক সাক্ষাৎকার শুনছি যা আমরা এরই মাঝে জানি সেটাই জানাচ্ছে। এসব জেনে আমাদের লাভ কী? আমার মনে হয়, ওদের উচিত ভুল করেছি এটা স্বীকার করে নেওয়া এবং এ ঘটনা ভুলে যাওয়া।’
স্মিথ ও ব্যানক্রফটের এভাবে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর সবাই ওয়ার্নারের দিকটাও শুনতে চাইছেন। গিলক্রিস্ট এরই মাঝে ইঙ্গিত দিয়েছেন, ওয়ার্নারের সাক্ষাৎকারও খুব দ্রুত হাজির করবেন। তবে তাঁর সতীর্থ শেন ওয়ার্ন এ নিয়ে আগ্রহী নন। বরং তাঁর সবটুকু সহানুভূতি ওয়ার্নারের জন্য। কারণ, এ ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত টু শব্দ করেননি ওয়ার্নার। কখনো অন্যের ওপর দায় চাপাননি এই ওপেনার, ‘আমার ডেভিড ওয়ার্নারের জন্য দুঃখ হচ্ছে কারণ সে এখন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। স্মিথ ও ব্যানক্রফট দুজনই নিজেদের অবস্থা ব্যাখ্যা করেছে... আমরা সবাই চায় ব্যাপারটা যে কোনোভাবে মুছে ফেলতে। ডেভিডের তো মনে হতেই পারে, “আমি এ নিয়ে কথা বলতে চাই না। এ নিয়ে যথেষ্ট বলেছি”। সে ক্ষেত্রে আমাদের এটা মেনে নেওয়া উচিত।’
তবে গিলক্রিস্ট যেহেতু ইঙ্গিত দিয়েছেন, ওয়ার্নারের দিকটা শোনার সুযোগ হয়তো শিগগিরই হবে। দেখা যাক, ওয়ার্নার অন্তত নিজের দায় স্বীকার করে নেবেন কি না, নাকি বোর্ড, অধিনায়ক অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার দর্শকের ঘাড়ে দায় চাপাতে চাইবেন!