এশিয়া কাপের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্য রকম সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের আদ্যোপান্ত লিখেছেন নাইর ইকবাল
এশিয়া কাপ ক্রিকেটের সঙ্গে বাংলাদেশের রীতিমতো আত্মার সম্পর্ক। আত্মার সম্পর্কই তো। আজ থেকে ২৭ বছর আগে এই এশিয়া কাপ দিয়েই তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আয়োজকের মর্যাদা পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত উইলস এশিয়া কাপেই দেশের মাটিতে প্রথম এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ। এশিয়া কাপই তো বাংলাদেশকে জুগিয়েছে ক্রিকেট দুনিয়ায় পা রাখার রসদ।
এশিয়া কাপ এরপর বাংলাদেশে ফিরেছে বারবারই। ১৯৮৮ সালের পর ২০০০ সাল, এরপর আরও দুবার—২০১২ ও ২০১৪। ঠুনকো বাণিজ্যিক অজুহাতে কিংবা অংশগ্রহণকারী অন্য দেশগুলোর অনীহা অথবা উপমহাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় বারবারই অনিয়মিত হয়ে পড়া এই এশিয়া কাপকে বাঁচিয়ে রেখেছে যেন বাংলাদেশই। বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কা প্রতিযোগিতাটি চারবার (১৯৮৬, ১৯৯৭, ২০০৪ ও ২০১০) আয়োজন করলেও, ভারত ও পাকিস্তান (১৯৯০ ও ২০০৮) আয়োজন করেছে একবার করে। দুবার (১৯৮৪ ও ১৯৯৫) সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজা আয়োজক হলেও চার বছর ধরে এটি আয়োজনের দায়িত্ব যেন বাংলাদেশেরই। এতে অবশ্য বাংলাদেশের বিন্দুমাত্র অনীহা নেই। বরং আত্মার-আত্মীয়কে এ দেশের মাটিতে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ যেন এশিয়া কাপের কাছে নিজেদের কৃতজ্ঞতার বার্তাটিই পৌঁছে দেয়। এশিয়া কাপ আবারও ফিরছে বাংলাদেশে। নতুন আঙ্গিকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পসরা সাজিয়ে এশিয়া কাপ যেন এই দেশের মাটি থেকেই শুরু করছে তার নবযাত্রা।
এই প্রজন্মের অনেকেরই জানার কথা নয়। আজকে ভাবলে অবাক হতে হয়, ১৯৮৮ সালে এশিয়া কাপের আয়োজন ছিল বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক অগ্নিপরীক্ষা। ২৭ বছর আগে ক্রিকেটের একমাত্র আদর্শ মাঠ বলতে ছিল কেবল ঢাকা স্টেডিয়ামই (আজকের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম)। ফুটবল মৌসুম শেষ হওয়ার পর শীত মৌসুমের আগ দিয়ে সে মাঠ মাস তিনেকের জন্য বরাদ্দ পেত ক্রিকেট। প্রায় অবকাঠামোহীন অবস্থায় এশিয়া কাপের মতো বিশাল একটি আয়োজনের দায়িত্ব নিয়ে সে সময়কার ক্রিকেট সংগঠকেরা বিরাট সাহসেরই পরিচয় দিয়েছিলেন। সেবার এশিয়া কাপের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রামেও। হালের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামকে (সে সময় কেবল চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম) তৈরি করা হয়েছিল ক্রিকেট-উপযোগী করে। বিদেশ থেকে কিউরেটর এনে এই দুটি মাঠে তৈরি করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানের উইকেট। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার ঠিক আগ দিয়ে ভয়াল বন্যায় পুরো দেশ ডুবে গেলে অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিল পুরো আয়োজন। শত প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতাকে জয় করে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের আয়োজন প্রশংসা কুড়িয়েছিল সবার। অনেকের কাছেই এখন পর্যন্ত এশিয়া কাপের সবচেয়ে জমজমাট ও বর্ণিল আসর বাংলাদেশের সেই আয়োজনই।
২০০০ সালে যে মুহূর্তে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের দুয়ারে কড়া নাড়ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশ আবারও দায়িত্ব পায় এশিয়া কাপ আয়োজনের। তত দিনে অবকাঠামো কিছুটা দাঁড়িয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশের সক্ষমতা তখন প্রমাণিত। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচার তো ছিলই, প্রথমবারের মতো রঙিন জার্সি আর দিন রাতের খেলা দিয়ে সেবার এশিয়া কাপ পেয়েছিল ভিন্নমাত্রা। প্রতিটি ম্যাচেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম-ভর্তি দর্শক এশিয়া কাপের আয়োজনকে দিয়েছিল পূর্ণতা। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়া কাপ আয়োজন ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন দিনের সূচনাও।
২০০০ সালের পর রীতিমতো হিমাগারে চলে যাওয়ারই উপক্রম হয়েছিল এশীয় ক্রিকেটের জমাটি এই আসরের। ২০০০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত—এই ১০ বছরে এশিয়া কাপের মাত্র তিনটি আয়োজন এটিকে পরিণত করেছিল ‘মৃতপ্রায়’ এক প্রতিযোগিতায়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ আবারও আয়োজনের ভার তুলে নিয়ে যেন নতুন করেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় এতে। কেবল প্রাণ প্রতিষ্ঠাই নয়, দারুণ ক্রিকেট খেলে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছে সে আসরকে বাংলাদেশ দেয় ভিন্নমাত্রা। ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে হেরে গেলেও ২০১২ সালের এশিয়া কাপ দিয়েই ক্রিকেট বিশ্বের সমীহটা দারুণভাবেই আদায় করে নেয় বাংলাদেশ।
২০১৪ সালে বাংলাদেশের মাটিতে আয়োজিত সর্বশেষ এশিয়া কাপটিও ছিল বাংলাদেশের জন্য নিজেদের প্রমাণের মঞ্চ। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন যখন অনিশ্চয়তায়, তখন তার ঠিক আগ মুহূর্তে এশিয়া কাপের আয়োজনই বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল এক নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এশিয়া কাপের নবযাত্রার সূচনার যোগ্যতর মঞ্চ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথায় হতে পারত! দুই বছর বাদে এশিয়া কাপের বাংলাদেশে ফেরাটা যেন এর নিজের বাড়িতে ফেরার মতোই।
এশিয়া কাপের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা যে আবেগেরই।