স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে ৩ উইকেটে ৩৭০। ব্যাটিং করছেন তাইজুল ইসলাম ও নাঈম হাসান।
কিছুক্ষণ পরই স্কোরবোর্ডে ৪ উইকেটে ৩৯৫। নাঈমের সঙ্গে নতুন ব্যাটসম্যান আবু জায়েদ রাহি।
কী ব্যাপার, বাংলাদেশের বোলাররা সব মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হয়ে গেল নাকি!
আসল ঘটনা তা নয়। টেস্ট সিরিজের আগে দুই দিনের প্রস্তুতি ম্যাচে সবাইকে ব্যাটিং প্র্যাকটিসের সুযোগ দিতে চারজন ব্যাটসম্যান স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। যে কারণে স্কোরবোর্ড অমন ভুল বোঝাচ্ছিল। ইচ্ছা করে অবসর নিলে যে সেটি ‘আউট’ হিসেবেই বিবেচিত হবে, স্কোরারের হয়তো সেটি জানাই নেই! যে কারণে দিনশেষেও সেটি দেখিয়ে গেল ৬ উইকেটে ৪১১। আসলে যা হবে ৪১১ অলআউট। খেলা হয়েছে ৯৬.১ ওভার, তাতে ৪১১ রানই বুঝিয়ে দিচ্ছে উইকেট আর বোলিংয়ের অবস্থা। তা সেটি যেমনই হোক, এক দিনে বাংলাদেশ চার শর বেশি রান করে ফেলাটা একটা ঘটনাই বটে। বিশেষ করে ওয়ানডে সিরিজে টপ অর্ডারের হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার স্মৃতি যেখানে এখনো টাটকা।
আর এখানে তামিম আর সাদমানের উদ্বোধনী জুটিতে ১০৩ রান। লাঞ্চের মিনিট তিনেক বাকি থাকতে তামিম আউট হয়ে গেলেন। দুঃস্বপ্নের ওয়ানডে সিরিজে সব মিলিয়ে উইকেটে ছিলেন মাত্র ৩৫ মিনিট। রানের চেয়ে উইকেটে একটু সময় কাটানোটাই বেশি জরুরি ছিল তাই তাঁর জন্য। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ব্যাটিং সেটির প্রয়োজন মোটামুটি মেটাল। ৮৩ বলে ৩৫ রানের ইনিংসে ৫টি চারের সঙ্গে ১টি ছক্কা একটু ভালোও বোধ করাল।
লাঞ্চের পর কিছুক্ষণের মধ্যেই আউট সাদমান। পুল করতে গিয়ে লং লেগে ক্যাচ দেওয়ার আগে যাঁর গোছানো ব্যাটিং গত নভেম্বরে অভিষেক টেস্টে ৭৬ রানের ইনিংসটির কথা মনে করিয়ে দিল। ইনিংসের শুরুতে নিজের ইচ্ছায় ফেরেননি শুধু প্রথম তিন ব্যাটসম্যানই। যাঁদের মধ্যে শুধু মুমিনুলের একটু আক্ষেপ থাকতে পারে। উইকেটে ৩৮ মিনিটের বেশি কাটাতে পারেননি বলে। ৩০ বল খেলে ২০ রান করার পর ক্যাচ দিয়েছেন স্লিপে।
চার থেকে শুরু করে সাত নম্বর পর্যন্ত চার ব্যাটসম্যানই স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌম্য সরকারই হাফ সেঞ্চুরি করার আগে। চা বিরতির সময় ৪১ রানে অপরাজিত থেকে ফিরেছিলেন সৌম্য, চার নম্বরে নামা লিটন তখন অপরাজিত ৬২। চা বিরতির পর দেখা গেল, মাঠে নামছেন নতুন দুই ব্যাটসম্যান। মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। হাফ সেঞ্চুরি করার পরও মাহমুদউল্লাহ কিছুক্ষণ ব্যাটিং করলেন। মিরাজ হাফ সেঞ্চুরি করেই হাঁটতে শুরু করলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। বাকি থাকে শুধু চার বোলার। তাঁদেরও নিউজিল্যান্ড একাদশের বোলিংয়ে খুব একটা অস্বচ্ছন্দ মনে হলো না।
স্বাগতিক দলের বোলিংয়ে চেনা নাম বলতে এক অ্যাডাম মিলনে। নিউজিল্যান্ডের হয়ে ৪০টি ওয়ানডে আর ২১টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। বলে ভালোই গতি আছে। কিন্তু মিলনে তো করলেন মাত্র ৪ ওভার। বোলারদের মধ্যে দুই ধরনের দুই বাঁহাতি স্পিনার মিলেই দিনের অর্ধেকেরও বেশি ওভার বোলিং করলেন। বাঁহাতি ফিঙ্গার স্পিনার লকরোজ সবচেয়ে বেশি ২৭ ওভার। চায়নাম্যান বোলার কোবার্ন ২৫.১ ওভার। শেষ দিকে ভুলা নামের এক অফ স্পিনারও ৫ ওভার করায় কারও মনে হতেই পারত, খেলাটা কি উপমহাদেশের কোনো মাঠে হচ্ছে নাকি!
আসলে হয়েছে ক্রাইস্টচার্চ শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের বার্ট সাটক্লিফ ওভাল মাঠে। লিঙ্কন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই ওই মাঠ। যেখানে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের একমাত্র একাডেমিটির ঠিকানা। ছবির মতো সুন্দর এই মাঠ আন্তর্জাতিক ভেন্যুও বটে। সেটির উইকেট এমনই ব্যাটিংবান্ধব যে মিরাজ পর্যন্ত অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাটিং করে ৮৩ বলে ৫১ রানের ইনিংসে ৬টি চারের সঙ্গে ২টি ছক্কাও মেরে দিলেন। বাংলাদেশ পারলে এই উইকেটটাই হ্যামিল্টনে নিয়ে যেত; ২৮ ফেব্রুয়ারি যেখানে শুরু হবে প্রথম টেস্ট। হ্যামিল্টনের সেডন পার্কের উইকেট নিশ্চিতভাবেই এমন ন্যাড়া থাকবে না।
নিউজিল্যান্ডের বোলিংও এমন দুধভাত নয়। টেস্টে যেটির মুখোমুখি হতে হবে, সেটির সঙ্গে বাংলাদেশকে আগেই পরিচয় না করিয়ে দেওয়ার ‘নীতি’র অবশ্যই ভূমিকা আছে এমন উইকেট বানানো আর স্বাগতিক একাদশ নির্বাচনে। তবে এতে বাংলাদেশের ভালোই হলো বলতে হবে। ওয়ানডেতে ব্যর্থতার পর প্রস্তুতি ম্যাচেও রান না পেলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাসটা একেবারে তলানিতে চলে যেত। মোটামুটি সবাই রান পাওয়ায় সেই আত্মবিশ্বাসের পালে একটু হলেও হাওয়া লেগেছে।
এটা আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছিল প্রথম টেস্টে মুশফিকুর রহিমকে না পাওয়াটা একরকম নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায়। তৃতীয় ওয়ানডেতে ব্যাটিংয়ের সময় ডান হাতের আঙুলে চোট পেয়েছিলেন। এখন আঙুলের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে কবজির সমস্যা। আগে থেকেই যেখানে একটু ব্যথা ছিল। আল্ট্রাসনোগ্রাম করানোর পর যে রিপোর্ট এসেছে, সেটি কমপক্ষে দুই সপ্তাহ কবজিকে বিশ্রাম দেওয়ার কথা বলছে। প্রস্তুতি ম্যাচে তাই মুশফিকের খেলার প্রশ্নই ওঠেনি। হ্যামিল্টন টেস্টেও তাঁর মুশফিকের দর্শক হয়েই থাকার কথা। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট থেকে ক্রমে সেরে উঠতে থাকা মোহাম্মদ মিঠুনও খেলতে পারেননি এই ম্যাচে।
টেস্ট ম্যাচের উইকেট আর বোলিং ভিন্ন হবে, সেটি তো জানা কথাই। তারপরও প্রস্তুতি ম্যাচের আসল যে উদ্দেশ্য, ব্যাটসম্যানরা নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার সেই কাজ মোটামুটি করতে পেরেছেন। আগামীকাল বোলারদের তা করার পালা। দুই দিনের ম্যাচে তো আর ফল আশা করা যায় না। এক দিন ব্যাটসম্যানদের, এক দিন বোলারদের—বাংলাদেশের এই পরিকল্পনার ৫০ শতাংশ তাই এরই মধ্যে সফল।