একটুর জন্য কত কিছু হয়নি...কবীর সুমনের গানের প্রথম কলিটাতে ‘কত কিছু’র বদলে ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ বসিয়ে দিলেই তা অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের মনের কথা হয়ে যাচ্ছে।
এখানে ‘একটু’ মানে একটুই, মাত্র ১ রান। যা করতে না পারায় টেস্টে দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিটা হলো না এই শ্রীলঙ্কানের। ১৯৯ রান করার আনন্দ মুছে দিয়ে বড় হয়ে উঠল মাত্র একটি রান করতে না পারার আফসোস।
মাঠেও তা গোপন করেননি, চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসেও না। সংবাদ সম্মেলনেই এক সাংবাদিকের কাছ থেকে জেনেছেন, তাঁকে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ১৯৯-দুর্ভাগাদের সংখ্যা ডজন ছুঁয়েছে। পরে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস কি এটাও জেনেছেন, এই ১২ জনের মধ্যে একটা জায়গায় তিনি এক ও অনন্য। বাকি ১১ জনের আর কারও ১৯৯-এর মতো ৯৯ রানেও আউট হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। এই যুগল দুঃস্বপ্ন শুধু ম্যাথুসকেই পুড়িয়েছে।
ও হ্যাঁ, ৯৯ আরেকজনেরও আছে। তবে তা অপরাজিত ৯৯। স্টিভ ওয়াহর সেই অপরাজিত ৯৯ রানে দারুণ একটা গল্প আছে। দারুণ গল্প বলছি, তবে স্টিভ ওয়াহর তা ‘দারুণ’ লাগার কোনো কারণ নেই। বরং মার্ক ওয়াহর কথা বিশ্বাস করলে ৪ মিনিটের ছোট যমজ ভাইকে তিনি কখনো ক্ষমা করেননি। এরপর থেকে আর কখনো ভাইয়ের কাছ থেকে ক্রিসমাসের উপহার পাননি—এটা অবশ্য মার্ক ওয়াহ মজা করেও বলে থাকতে পারেন।
ঘটনাটা আপনার জানা না থাকলে রহস্যটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। তা খুলে বলাই ভালো। ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পার্থ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার শেষ ব্যাটসম্যান ক্রেইগ ম্যাকডারমটের রানার হিসেবে নেমেছিলেন মার্ক ওয়াহ। ৯৯ রানে অপরাজিত স্টিভ ওয়াহ ব্যাটে বল লাগানোর আগেই দৌড় শুরু করে দেন নন–স্ট্রাইকার মার্ক ওয়াহ। রান নেই দেখে স্টিভই তাঁকে ফিরিয়ে দেন, মার্ক ওয়াহ আর ফিরতে পারেননি। একটুর জন্য তিনি রানআউট হয়ে যান। একটুর জন্য স্টিভ ওয়াহর একটা সেঞ্চুরিও মিস হয়ে যায়।
১৯৯ নিয়ে কথা হচ্ছিল, ১৯৯-তেই থাকি। ১৯৯ রানে অপরাজিত থাকারও দুটি ঘটনা আছে। এর একটি খুব ভালো মনে আছে ম্যাথুসের। কারণ, ২০১২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে যে গল টেস্টে কুমার সাঙ্গাকারা ১৯৯ রানে অপরাজিত ছিলেন, সেটিতে তিনিও খেলেছেন। ম্যাথুসের সেই টেস্টটা ভুলতে না পারার আরও কারণ আছে। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে একমাত্র ‘গোল্ডেন ডাক’টি যে সেই টেস্টেই। ১৯৯ রানে অপরাজিত থাকার অভিজ্ঞতায় সাঙ্গাকারার সঙ্গী আরেক বাঁহাতি—জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার।
অপরাজিত দুজনকে ধরলে টেস্ট ক্রিকেটে ‘১৯৯’-এর ভুক্তভোগী মোট ১৪ জন। অথচ ইতিহাসের প্রথম ৯৯৫ টেস্টে সংখ্যাটা ছিল শূন্য। ৯৯৬তম টেস্টে একটুর জন্য ডাবল সেঞ্চুরি মিস করার যন্ত্রণায় প্রথম পুড়েছেন পাকিস্তানের মুদাসসর নজর। ১৯৮৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ফয়সালাবাদ টেস্টে ওই দুর্ভাগ্যের শিকার হওয়ার বছর দুয়েক আগেই অবশ্য টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি পেয়ে গেছেন মুদাসসর। সেটিও ভারতের বিপক্ষেই।
দুই বছরের মধ্যেই মুদাসসরের সঙ্গী মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কানপুরে আজহারের ১৯৯ রানে আউট হওয়াটা তখন তুমুল আলোচিত ছিল। যেটির কারণ শুধু ১৯৯ ছিল না। দেশপ্রেমী হিসেবে ভারতীয় ও পাকিস্তানি আম্পায়ারদের তখন অনেক ‘সুনাম’। ১৯৯ রানে থাকা আজহারউদ্দিনের বিপক্ষে এলবিডব্লুর আবেদনে ভারতীয় আম্পায়ারের তর্জনী তুলে দেওয়াটা তাই একটু বিস্ময়েরই জন্ম দিয়েছিল।
প্রথম তিন টেস্টেই সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড গড়ে শুরু আজহারের ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি ১৬তম টেস্টে। সেটিই ওই ১৯৯। ক্যারিয়ার শেষেও যা তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংস। ‘১৯৯ ক্লাবে’ ম্যাথু এলিয়ট, কে এল রাহুল, ডিন এলগার, ফাফ ডু প্লেসিও টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি পাননি। তবে এঁদের কারও ক্যারিয়ারই তো আজহারের মতো বর্ণাঢ্য নয়। আজহারের দুঃখটাও তাই সবচেয়ে বেশি। ‘একটুর জন্য’ কথাটা অবশ্য আজহারের পুরো টেস্ট ক্যারিয়ারেরই শিরোনাম হতে পারে। ১ রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি পাওয়া হয়নি, ১ টেস্টের জন্য খেলা হয়নি শততম টেস্ট।
১৯৯ রানে আউট হওয়াটাই দুঃখ হিসেবে যথেষ্ট, তার ওপর তা যদি হয় রানআউট—তাহলে তো দুঃখের সীমা থাকার কথা নয়। অথচ জেনে আশ্চর্য হবেন, ১৯৯ রানে রানআউটের শিকার একমাত্র ব্যাটসম্যান পাকিস্তানের ইউনিস খানের দাবি, তাঁর এতে একটুও দুঃখ হয়নি। ২০০৬ সালে ভারতের বিপক্ষে ওই লাহোর টেস্টটা কাভার করেছি। শহীদ আফ্রিদির দোষে ১৯৯ রানে রানআউট হয়ে যেতে দেখেছি ইউনিস খানকে।
সংবাদ সম্মেলনে শুনেছি ওই অদ্ভুত দাবিও। এর কয়েক দিন পর একান্ত সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে আবারও যখন প্রসঙ্গটা তুলেছি, ইউনিস আবারও বলেছেন ওই কথাই, ‘আমি কোনো কিছু নিয়েই মন খারাপ করি না। রানআউট হওয়ার পর আমাকে আফ্রিদির দিকে একবারও তাকাতে দেখেছেন? ১৯৯ রানে আউট হলেও পৃথিবী শেষ হয়ে গেল নাকি!’
তা হয়তো শেষ হয় না। তবে বাকি সবার ওই মুহূর্তের অনুভূতিটা মনে হয় অমনই হয়েছে। সবাই তো আর ইউনিস খান না।