শেন ওয়ার্ন মানেই চনমনে কিছু
শেন ওয়ার্ন মানেই চনমনে কিছু

উৎপল শুভ্রর লেখা

এই শেন ওয়ার্নকে হয়তো আপনি চেনেন না

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তখনো বেশি দিন হয়নি শেন ওয়ার্নের। বছর তিনেক হবে। ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কায় সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজের সময় সুপারস্টার হয়ে না ওঠা ওয়ার্নকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন উৎপল শুভ্র। নিয়েছিলেন সাক্ষাৎকারও। সেই সাক্ষাৎকার প্রশ্নোত্তর ফর্মে না লিখে গল্পের আদলে লেখায় ক্রিকেটার ওয়ার্নের সঙ্গে মানুষ ওয়ার্নও ফুটে উঠেছেন এতে। অকালে চলে যাওয়া শেন ওয়ার্নের জন্মদিনে লেখাটা আবার প্রকাশ করা হলো।

এর আগে তাঁকে দেখেছি শুধু টিভি পর্দায় আর তার চেয়ে বেশি পত্রিকার পাতায়। অথচ সামনে এই যে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের ডোরাকাটা ব্লেজার গায়ে লোকটা, হাতে ড্রিংকসের গ্লাস, মুখে মাথার ব্লন্ড চুলের চেয়েও উজ্জ্বল হাসি, মনে হচ্ছে তাঁকে আমি এই প্রথম দেখছি না। কারণটা কি এ-ই, টিভি পর্দায় আর পত্রিকায় ছবি দেখে, তাঁর সম্পর্কে অসংখ্য লেখা পড়ে শেন ওয়ার্নের যে চেহারাটা ছিল আমার কল্পনায়, হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি ঠিক সেরকম!

ঘটনাটা ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের। কলম্বোতে চার জাতি সিঙ্গার টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় চার দলের খেলোয়াড়দের জন্য হোটেল ওবেরয় লংকার লবিতে আয়োজন এক পার্টির। খেলোয়াড়রা হাতে ড্রিংকসের গ্লাস নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে অস্ট্রেলিয়ার ছয়-সাতজন খেলোয়াড় একসঙ্গে, তাঁদের মধ্যেই ওয়ার্ন। একজন ওয়েটার হাতে ড্রিংকসের ট্রে নিয়ে ওবেরয়ের উঁচু বেদির মতো লবি থেকে নেমে আসছিলেন। হঠাৎ একজন ট্রে থেকে একটা গ্লাস তুলে নেওয়ায় সিঁড়ির ওপর থেকে চোখ সরে গেল তাঁর মুহূর্তের জন্য। পা পড়ল সিঁড়ির কোনায়, হাত থেকে ছিটকে পড়ল ট্রে, শেষ দু'তিনটি ধাপ জেট প্লেনের গতিতে পার হলেন ওই ওয়েটার। পড়ে যেতে যেতে পুরোপুরি পতন থেকে বাঁচলেন কোনোমতে। নিঃসন্দেহে করুণ এবং একই সঙ্গে মজার দৃশ্য। ওয়ার্ন পেলেন মজাটাই। ওয়েটারের টালমাটাল অবস্থা দেখে সেই যে হাসি শুরু হলো তাঁর, রীতিমতো বাঁকা হয়ে গেলেন হাসির তোড়ে। তাঁর হাতের গ্লাস থেকে ছলকে পড়ছে কোক, তবুও হাসি থামাতে পারছেন না। তখনই বুঝে ফেললাম, মাঠে যে ওয়ার্নকে দেখেছি, মাঠের বাইরের ওয়ার্ন তার চেয়ে একটুও আলাদা নন।

শেন ওয়ার্ন, এই পৃথিবীতে পা রাখা সবচেয়ে বড়ো স্পিনার কি না, তা নিয়ে তর্ক করার লোক দিন দিন কমে আসছে। একের পর এক অতিমানবীয় কীর্তি গড়ছেন, আর বিশেষণের ভাণ্ডারে ক্রমেই বাড়ছে শূন্যতা। তাঁর লেগ ব্রেক টার্ন করে এক মাইল, মূর্তিমান আততায়ী তাঁর ফ্লিপার, দুর্বলতা যদি কিছু থাকে. তা হলো একমাত্র গুগলিতে, এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করতে থাকুন। আমরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছুব, সে জন্য এত সবের প্রয়োজন হবে না। যদি আপনি ক্রিকেটের মোটামুটি দর্শকও হন, ওয়ার্নের হাতে বল দেখলেই হৃদ্স্পন্দন একটু কি দ্রুত হয়ে যায় না? খেয়াল না করে থাকলে বুকের বাঁপাশে হাতটা রেখেই দেখুন পরবর্তী সুযোগে।

শেন ওয়ার্নের বোলিং দেখাটাও ছিল চোখের শান্তি

বোলার হিসেবে ওয়ার্নের অসাধারণ ক্ষমতা, প্রতিটি বলেই নতুন এক বিস্ময়ের উন্মোচন ঘটার প্রত্যাশা, এগুলো অবশ্যই এর কারণ, তবে সেটাই সব নয়। গম্ভীর মুখে প্রায় হেঁটে আসা রান আপ, বলটা ছেড়ে দিয়েই মুখে সেই ভুবনভোলানো হাসি, ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়েও উইকেট না পেলে ঠোঁট গোল করে শিস দেওয়ার ভঙ্গি... এটাই তাঁর হতাশা প্রকাশের মাধ্যম, উইকেট পেলে দু'হাত উঁচু করে দৌড়ে যাওয়া সতীর্থদের দিকে...সব কিছুই আমাদের স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়, এখানে এই যে একজন বল করছে, সে খেলাটা ভালবাসে। যা করছে, তা সে উপভোগ করছে, পেশাদারিত্বের যাঁতাকলে সব বিস্ময় এখনও বিসর্জন দিয়ে ফেলেনি।

মানুষ ওয়ার্নও সে রকম। জীবনও যেন তাঁর কাছে লেগ-স্পিনের মতোই অনন্ত এক রহস্যের আধার। সারা বিশ্বকে বিস্মিত করছেন তিনি তাঁর জাদুতে, কিন্তু নিজে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেননি। আর এটা কে না জানে, বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকে। একটা প্রশ্নের জন্য আমি পুরোপুরি প্রস্তুত, ক'দিন দেখেছেন ওয়ার্নকে যে, বেদবাক্যের মতো অমোঘ ভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করছেন তাঁর চরিত্র? প্রশ্নটা আসবে জেনেই তার উত্তরটা আগেই তৈরি করে রাখা। ধরুন, একজন মানুষকে আপনি ১৪ দিনে মোটামুটি বার চল্লিশেক দেখেছেন। সব সময়ই যদি তাঁকে একই রকম দেখেন, তার সেই মূর্তিটাই কি চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যাবে না মনে! শ্রীলঙ্কাতেই ওয়ার্নকে আমার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষ দেখা। তাঁর সম্পর্কে আমি অন্য কোনো ধারণা কি করে করব? আমি যে তাঁকে সবসময়ই উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত দেখেছি।

যে পার্টিতে প্রথম ওয়ার্নকে কাছ থেকে দেখা, সেখানেই জানানো তাঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার ইচ্ছার কথা। মুখের হাসিটা একটুও ম্লান হলো না, 'আগামীকাল দুপুরের দিকে একটা রিং করো। রুম নাম্বার ৫০১।' কিন্তু ওয়ার্ন তাঁর রুমে কতক্ষণ থাকেন, তা এক রহস্য। বলেছিলেন দুপুর, সকাল ১১টা থেকে চেষ্টা করতে করতে বেজে গেল ১টা, ওয়ার্ন রুমে নেই। তাঁর রুমমেট ডেভিড বুন হাউস টেলিফোনে একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে শেষে বিরক্তই হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরই শুরু হয়ে যাবে সিঙ্গার টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী খেলা, তাই সেদিনের মতো ওয়ার্নের আশা বাদ গিয়ে ছুটতে হলো মাঠে। দেখা হলো দু'দিন পর, কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ।

জীবনও যেন তাঁর কাছে লেগ-স্পিনের মতোই অনন্ত এক রহস্যের আধার। সারা বিশ্বকে বিস্মিত করছেন তিনি তাঁর জাদুতে, কিন্তু নিজে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেননি।

পাকিস্তানকে হারিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাটিংয়ে ৩০ রান আর বোলিংয়ে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ শেন ওয়ার্ন। ম্যাচ শেষে ভারতের চার/পাঁচ জন সাংবাদিকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শর্টস আর উর্ধ্বাংশে কমলা রঙের এক তোয়ালে জড়িয়ে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসা ওয়ার্নের সঙ্গে কথা বললাম।

বিদায় কিংবদন্তি

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সাধারণত খানিকটা গম্ভীর হয়ে যান যেকোনো খেলোয়াড়ই। কিন্তু ওয়ার্ন একই রকম সপ্রতিভ। প্রশ্ন শুনছেন হাসি মুখে, উত্তর দেওয়ার সময়ও সে হাসি অদৃশ্য নয়। ডাকা হচ্ছিল তাঁকে মিস্টার ওয়ার্ন, দ্বিতীয়বারেই বাধা 'শুধু শেন বললেই চলবে।' কথা চলল ছয়/সাত মিনিট। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তা মাত্র শেষ হওয়া ম্যাচ নিয়ে। সে দিনের জন্য সেটাই দরকার। কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য, নানা প্রসঙ্গে ডালপালা ছড়ানো ওয়ার্নের পুরো ক্যারিয়ার নিয়ে ইন্টারভিউ। তাই সাংবাদিকদের 'ওকে, থ্যাংক ইউ' বলে যখন ঘুরলেন ওয়ার্ন, তাঁর সঙ্গে দুটো সিঁড়ি ভাঙলাম, 'সেদিন দুপুরে ফোন করতে বললে, কিন্তু রুমেই তো পেলাম না তোমাকে।'

অন্য যেকোনো ক্রিকেটার হলে গলায় অভিযোগের সুরটার অস্তিত্বই রাখতাম না আমি। কিন্তু কেন যেন বিশ্বাস জমে গেছে, ওয়ার্নের সঙ্গে এভাবে কথা চলে। অনুমান ভুল হলো না, দুঃখ প্রকাশের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, 'আর কী জানার আছে? অনেক প্রশ্ন তো করলে!'

'সে তো শুধুই এই ম্যাচ নিয়ে, আমি চাই তোমার পুরো ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলতে।'

'তাহলে কাল দুপুর একটায় হোটেলে, ওকে?'

অবশ্যই ওকে। তবে দু'একটা প্রশ্ন করে ফেললাম সেখানে দাঁড়িয়েই। তাই পাঠিয়ে দিলাম 'ভোরের কাগজ'-এ। পরদিন বড় ইন্টারভিউ হচ্ছে, পরে সেটা পাঠানো যাবে ভেবে মনে বেশ আনন্দ। কিন্তু পরদিন হোটেলে গিয়েই মুছে গেল সে আনন্দ। হোটেলে যাওয়ার পথে রাস্তায় পাশ কাটিয়ে গেল একটা বাস, উইন্ডস্ক্রিনে আবছা মতো দেখলাম 'অস্ট্রেলিয়া' লেখা। হোটেলে ঢুকতেই সত্যি হলো আশঙ্কা, প্র্যাকটিসে গেছে অস্ট্রেলিয়া দল।

এগারোটায় প্র্যাকটিসে যাওয়ার অর্থ দু'টোর আগে ফেরার আশা নেই এবং এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ওয়ার্ন মাত্র তিনদিন আগে প্রথম দেখা বাংলাদেশের এক সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দেবেন, এমন আশা করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে মেনে নিতেই হলো। তারপরও অনেকটা জেদ করেই বসে রইলাম হোটেলের লবিতে, 'ওয়ার্নকে ধরবই আজ।' ঘড়ির কাটা দু্ইটা ছুঁই ছুঁই, এমন সময় হোটেলে ফিরল অস্ট্রেলিয়া দল। লিফটের সামনে ওয়ার্নকে ধরলাম, 'তোমার জন্য বসে আছি বারোটা থেকে।' 'কথা ছিল প্র্যাকটিস হবে বিকেলে, হঠাৎই পাল্টে গেছে প্রোগ্রাম' শুনেই চলে যেতে হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু অবাক করে দিয়ে ওয়ার্ন বললেন, “চেঞ্জ-টেঞ্জ করে একটু ফ্রেশ হয়ে নিই, তুমি আড়াইটার দিকে একটা রিং করো। আড়াইটায় রিং করে আবারও শুনতে হলো ডেভিড বুনের জলদগম্ভীর গলা : 'ওয়ার্নি ইজ নট ইন দ্য রুম।'

আমি যখন ছোট ছিলাম, এক লোক ছিল যে বল স্পিন করাতে পারত দু'দিকেই। কিভাবে এটা সম্ভব বুঝতে গিয়েই জড়িয়ে পড়লাম আমি। শুরুতে একটুও টার্ন করতে পারতাম না বল, এটাই আরও বেশি জেদি করে তুলল আমাকে। ব্যাপারটায় মজাও পেলাম খুব। তারপর একদিন ঠিকই টার্ন করালাম বল
শেন ওয়ার্ন

ওয়ার্নকে যে তাঁর টিমমেটরা ‘ওয়ার্নি’ বলেই ডাকে, সেটা লক্ষ্য করেছি আগেই। বুন মহাশয় বেশ বিরক্ত হয়ে আছেন বুঝতে পেরে বললাম, 'ও তো আমাকে আড়াইটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে। এ কারণেই ফোন করা।' গোলগাল চেহারার এই তাসমানিয়ান ব্যাটসম্যান আমার ব্যাখ্যায় খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলো না। শুধু বললেন, 'পরে ফোন করো।' পনেরো মিনিট করে বিরতি দিয়ে তৃতীয়বারের মতো যখন বুন একই কণ্ঠ শুনলেন, তখন তাঁর রিসিভার রাখার শব্দ শুনেই বুঝতে পারলাম, টেলিফোনে মার-টার দেওয়ার প্রযুক্তি চালু হয়নি বলেই বেঁচে গেলাম এ যাত্রা। চুলোয় যাক ওয়ার্ন। এনাফ ইজ এনাফ। ওয়ার্নের পেছনে আর ঘুরব না...পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।

চিরচেনা সেই ওয়ার্ন

কিন্তু ইন্টারভিউটা ঠিকই হলো। দু'তিনদিন পর হোটেলের লবিতে বসে আছি। হঠাৎ দেখি মার্ক ওয়াহর সঙ্গে হোটেলে ঢুকছেন শেন ওয়ার্ন। টেলিফোনে মার্ক ওয়াহর সঙ্গেও কথা হয়েছিল ইন্টারভিউ চেয়ে। এবার সামনে গিয়ে বলা হলো, টেলিফোনে যে তোমার ইন্টারভিউ চেয়েছিল, আমিই সেই বাংলাদেশি সাংবাদিক। ওয়ার্ন কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। মার্ক ওয়াহ আমাকে নিয়ে বসবেন বলে লবির দিকে এগোতেই আমার দিকে চোখ পড়ল তাঁর। 'কি, তুমি আমার ইন্টারভিউ নেবে না'...মুখে সেই হাসি। আমি বললাম, 'তোমার ইন্টারভিউ তো নিচ্ছি টুর্নামেন্ট শুরুর দিন থেকেই। আজ তোমার সময় হবে?' ওয়ার্নের সময় হবে জানার পরও আমি মার্ক ওয়াহকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সঙ্গে ছিল কলকাতার দৈনিক গণশক্তির সাংবাদিক প্রদ্যোষ ভট্টাচার্য। তাঁর হাতে সঁপে দিলাম ওয়ার্নকে। পাশের সোফাতেই ইন্টারভিউ শেষ করে চলে গেলেন মার্ক ওয়াহ। ওয়ার্ন বসলেন আরও কিছুক্ষণ। ইন্টারভিউয়ের চেয়ে অনেকটা আড্ডার মেজাজেই কথা হলো তাঁর সঙ্গে।

তিরানব্বই সালে ইংল্যান্ড সফরে অ্যাশেজ সিরিজে প্রথম বলটি করেছিলেন ওয়ার্ন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। ব্যাটসম্যান মাইক গ্যাটিং। বলটা পড়ল লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে। সেখান থেকে টার্ন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাধা পেলো তা অফ স্টাম্পে। অনেকেই বলেছেন 'বল অফ দ্য সেঞ্চুরি', এই শতাব্দীর সেরা ডেলিভারি!

কেন সব ফেলে লেগ স্পিনই টানলো তাঁকে? 'আমি যখন ছোট ছিলাম, এক লোক ছিল যে বল স্পিন করাতে পারত দু'দিকেই। কিভাবে এটা সম্ভব বুঝতে গিয়েই জড়িয়ে পড়লাম আমি। শুরুতে একটুও টার্ন করতে পারতাম না বল, এটাই আরও বেশি জেদি করে তুলল আমাকে। ব্যাপারটায় মজাও পেলাম খুব। তারপর একদিন ঠিকই টার্ন করালাম বল’...এই হলো ওয়ার্নের লেগ স্পিনার হয়ে ওঠার কাহিনী। একানব্বইয়ের ডিসেম্বরে যে শেন ওয়ার্ন প্রথম পা রেখেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, তাঁর সঙ্গে এই ওয়ার্নের অনেক পার্থক্য। বোলিংয়ের কথা বলা হচ্ছে না। একানব্বইয়ে ওয়ার্নের রীতিমতো এক নাদুস নুদুস চেহারা, এত তাড়াতাড়ি কিভাবে শরীরকে এমন করে ফেললেন? এর পেছনে আছে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, 'প্রতিদিন সকাল সাতটায় উঠে প্রথমে দৌড়, তারপর জিমন্যাসিয়াম। শুরুতেই বুঝে ফেলেছিলাম, হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফিট না হলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জায়গা নেই।'

টেস্ট অভিষেকের কথা কোনো ক্রিকেটারই ভুলতে পারে না, শেন ওয়ার্ন তো আরও পারবেন না। শুরুতেই তাঁকে দিতে হয়েছিল কঠিন পরীক্ষা, স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের সামনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। রবি শাস্ত্রী করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি, শচীন টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেমন কঠিন জায়গা, তা ওয়ার্নকে পুরোপুরি বুঝিয়ে দেওয়ার পর মায়া হয়েছিল শাস্ত্রীর। তাই ডাবল সেঞ্চুরির পর উইকেটটি দিয়ে যান তাঁকেই। ১৫০ রান খরচে ওই একটি উইকেটই ওয়ার্নের সম্বল। 'আমি তখন ছিলাম একেবারেই অনভিজ্ঞ। রবি আর শচীনও সত্যিই খুব ভালো খেলেছিল'...হাসতে হাসতে বসলেন ওয়ার্ন। রবি শাস্ত্রী খেলার মাঠ থেকে চিরতরে কমেন্ট্রি বক্সে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন মাত্র ক'দিন আগে। 'তাহলে তো আর প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ থাকল না' বলে দারুণ আফসোসের একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে তুললেন ওয়ার্ন।

মাঠ থেকে বিদায়বেলায় ওয়ার্ন

স্বপ্নের সেই বলটির কথা উঠল। তিরানব্বই সালে ইংল্যান্ড সফরে অ্যাশেজ সিরিজে প্রথম বলটি করেছিলেন ওয়ার্ন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। ব্যাটসম্যান মাইক গ্যাটিং। বলটা পড়ল লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে। সেখান থেকে টার্ন নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাধা পেলো তা অফ স্টাম্পে। অনেকেই বলেছেন 'বল অফ দ্য সেঞ্চুরি', এই শতাব্দীর সেরা ডেলিভারি! সেই একটি আউটই ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যান মানসিকভাবে গুঁড়িয়ে দিল পুরোপুরি। এরপর সিরিজের পুরোটাই ওয়ার্নের। সেই বলটি করার আগে কি ভেবেছিলেন ওয়ার্ন? চোখ ঝলমল করে উঠল তাঁর, 'আমি ওরকমই আশা করেছিলাম, এটা বললে বাড়াবাড়ি শোনাবে। কিন্তু উইকেটে ফুটমার্ক ছিল, আমি শুধু চেয়েছি বলটা ওখানে ফেলতে। তবে পরে টেলিভিশনে কতবার যে তা দেখেছি, বলতে পারব না'।

এটা যে দুর্ঘটনা ছিল না, পরে তা বারবার প্রমাণ করেছেন ওয়ার্ন। এই ইন্টারভিউ নেওয়ার পরদিনই শ্রীলঙ্কার ওপেনার রোশান মহানামাকে অনেকটা একইভাবে রাউন্ড দ্য লেগ বোল্ড করলেন। মঞ্চে ওয়ার্নের আবির্ভাবের আগে আবদুল কাদিরই ছিলেন অনেক, অনেক দিনের মধ্যে বিশ্বের সেরা লেগ স্পিনার। বলাবলি শুরু হয়েছে, কাদিরের চেয়েও ভালো করছে ওয়ার্ন। এটা বলতেই প্রতিবাদ, তা-ও 'ওয়ার্নীয়' ভঙ্গিতে। যেন দারুণ অন্যায় কথা, জিভে কামড় দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, 'আমি কাদিরকে শুধু ভিডিওতে দেখেছি। দারুণ এক বোলার।' পরে পাকিস্তান সফরে গিয়ে কাদিরের সঙ্গে ওয়ার্নের দেখা হয়েছে, সে কথা জেনেছি আমরা। আরেকটি অ্যাশেজ সিরিজের আগে ওয়ার্ন বলছেন, পাকিস্তানে কাদিরের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কেটেছে তাঁর। অনেক কায়দা-কানুনও দেখিয়েছেন কাদির। কার্পেটের ওপর বল ঘুরিয়ে অবাক করে দিয়েছেন তাঁকে।

শেন ওয়ার্নের মতো কেউ কি আসবে আর!

কপিল দেব তাঁর রেকর্ড ভেঙ্গে দেওয়ার পর স্যার রিচার্ড হ্যাডলি কপিলের উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওয়ার্নকে। এ কথাতেও মাথা ঘুরে যায়নি ওয়ার্নের। এটাকে যেভাবে দেখছেন তিনি, তাতে পরিচয় মেলে তাঁর পরিণত মানসিকতার, ‘এই রেকর্ড নিয়ে এখন চিন্তা না করাই ভালো। মাত্র এক শ উইকেট পার হয়েছি আমি। এটা এখনও অনেক দূরে।' অনেক দূরে তো বটেই। তবে শুধু হ্যাডলিই নন, এই রেকর্ড ভাঙায় সম্ভাব্য বোলার হিসেবে ওয়ার্নের নামই উচ্চারণ করছেন প্রায় সবাই। তাঁর বিস্ময়কর স্ট্রাইক রেট একটা কারণ। তবে স্ট্রাইক রেটের কথা বললে ওয়াকার ইউনিস বা ওয়াসিম আকরামের নামও আসে। ওয়ার্নের সুবিধা, স্পিনার হওয়ায় এই দুই ফাস্ট বোলারের চেয়ে তাঁর ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য অনেকটাই বেশি হওয়ার কথা। আর এটা তো জানা কথাই, তারুণ্যের বিদায় সংগীত বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ফাস্ট বোলাররা যেখানে ক্রমশ বিবর্ণ হতে থাকে, স্পিনাররা হয় ততই পরিণত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে আরও বিধ্বংসী হয়ে ওঠে স্পিনাররা। তাই যদি হয়, তাহলে আগামী দিনের ব্যাটসম্যানদের জন্য মায়াই হচ্ছে!

অস্ট্রেলিয়া দলের বর্তমান কোচ ও সাবেক অধিনায়ক ববি সিম্পসন মনে করেন, তাঁর প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ হলে সর্বকালের সেরা স্পিনার হওয়ার ক্ষমতা আছে ওয়ার্নের। পরিপূর্ণ বিকাশের প্রয়োজন নেই। যেটুকু হয়েছে, তা আর বছর চারেক বজায় থাকলেই তো প্রায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন ওয়ার্ন।

১৯৯৯ বিশ্বকাপও আলোকিত হয়েছে ওয়ার্ন-আলোয়

ওয়ার্নের সবচেয়ে বড় অবদান ক্রিকেটের মৃতপ্রায় একটা শাখাকে পুনর্জীবন দেয়া। ওয়ানডের আগ্রাসন, ভারি ব্যাট সব মিলে যখন স্পিন বোলিংয়ের পুরাকীর্তিতে পরিণত হওয়ার দশা, তখন এক ঝলক মুক্ত বাতাসের মতো আবির্ভূত হলেন ওয়ার্ন। ক্রিকেটের সবচেয়ে দুরূহ আর সৃষ্টিশীল বোলিংটিকে আবারও নিয়ে এলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। একই সময়ের আরও দুই লেগ স্পিনার অনিল কুম্বলে আর মুশতাক আহমেদও খারাপ করছেন না। কিন্তু ওয়ার্নের সঙ্গে তাঁদের তুলনা চলে না। শুধু বোলার হিসেবেই এগিয়ে নেই ওয়ার্ন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাঁর অভাব সবচেয়ে বেশি, তিনি সেই 'চরিত্র'। বোলিং করার সময় মুখে গ্রাউন্ড স্ট্রোক নেওয়া মনিকা সেলেসের মতো শব্দ, তাঁর আকর্ষণীয় ম্যানারিজম, জাদুকরী দক্ষতা, সব মিলিয়ে তাঁকে ঘিরে আছে এক রহস্যের মায়াজাল। কিশোর আর তরুণদের সামনে এতদিন রোল মডেল হিসেবে ছিলেন শুধুই ফাস্ট বোলাররা। কিন্তু ওয়ার্নকে দেখে, তাঁর বোলিং দেখে, নিশ্চিতভাবেই বিশ্বজুড়ে অনেক তরুণ ক্রিকেটারের স্বপ্ন এখন ওয়ার্ন হওয়া। 'একটা ক্রিকেট বলকে নিয়ে এত কিছু করা যায়' এই বিস্ময়ের ঘোরে আক্রান্ত অনেক তরুণকেই ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দর্শক মাঠে যায় সাধারণত ব্যাটসম্যানদের নামেই, ক্রিকেট সবসময়ই মূলত ব্যাটসম্যানের খেলা। কিন্তু এখন যে ম্যাচে ওয়ার্ন আছেন, তাঁর বোলিং দেখতে যাওয়া দর্শকও কম থাকেন না। ওয়ার্নের আর একটা আকর্ষণ, কখনোই রান বাঁচানোর বোলিং করেন। না তিনি। তাঁর বিস্ময়কর অ্যাকুরেসির কারণে ব্যাটসম্যানরা রান তুলতে হিমশিম খায়, সেটা ভিন্ন কথা। তবে তাঁর লক্ষ্য শুধুই উইকেট নেয়া, 'আমি সব সময়ই অ্যাটাকিং বোলার। যখনই বোলিং করি না কেন, ম্যাচের অবস্থা যা-ই হোক না কেন'...স্পষ্ট ঘোষণা ওয়ার্নের। কিন্তু যখন একজন ব্যাটসম্যান তাঁর ওপর চড়াও হন, তখনও কি রক্ষণাত্মক হবার কথা ভাবেন না ? ১৯৯৪-এর এপ্রিলে শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপে ভারতের বিনোদ কাম্বলি যেমন তাঁর এক ওভারে ২২ লান নেওয়ার অবিশ্বাস্য কাজটি করেছিলেন, এসব মুহূর্তেও কি রক্ষণাত্মক বোলিং করার একটা ইচ্ছা হয় না তাঁর? ওয়ার্নের অন্য কথা, 'আমি তো এটাই চাই। ব্যাটসম্যান যতো আক্রমণাত্মক হয়, উইকেট পাওয়ার সম্ভাবনাও তত বেড়ে যায়। তাই ব্যাটসম্যান চার বা ছয় মারলে আমি খুশিই হই। তাছাড়া ব্যাটসম্যান চার বা ছয় যা-ই মারুক, বলটা তো আমার হাতেই ফেরত আসবে। প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আমি পাবই।'

মাঠের বাইরেও বাহারি এক চরিত্র ছিলেন ওয়ার্ন

শ্রীলঙ্কায় ওয়ার্নের রুমমেট ডেভিড বুনেরও একটা ইন্টারভিউ করার ইচ্ছে ছিল। ওয়ার্নকে যতবার ফোন করেছি, তার বেশির ভাগই ধরেছেন বুন। প্রথমে ওয়ার্নের খোঁজ করে তাঁকে না পেয়ে পরে বুনের ইন্টারভিউ চাইলে খুব একটা ফল লাভের সম্ভাবনা নেই ভেবে আর তাঁর ইন্টারভিউ চাইনি। ওয়ার্নের ইন্টারভিউ করার দু'দিন পর হোটেলের লবিতে পেয়ে গেলাম বুনকে। ওয়ার্নও আছেন সঙ্গে। অন্য অনেক ক্রিকেটারকেই দেখেছি, আগের দিন হয়তো ১৫/২০ মিনিট কথা বলেছি, কিন্তু পরদিন চিনতেই পারলেন না দেখে। ওয়ার্ন একটু অন্যরকম। তিনি চিনলেন। তাঁকেই জানালাম, বুনকে ইন্টারভিউ করার ইচ্ছার কথা। বললেন, ' তুমিই সরাসরি বলো না ওকে।' আমার টেলিফোন ধরতে ধরতে বিরক্ত বুন পরিচয় দিতেই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন। সে কারণেই অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, নানা অজুহাত দেখতে লাগলেন। বিকেলে প্র্যাকটিস, সন্ধ্যের কথা বলায় তখন অন্য কাজ... এসব! হাত তিনেক দূরে দাঁড়ানো ওয়ার্ন কিন্তু খুব মজা পাচ্ছেন বুনের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেখে। ইশারা করছেন বুনকে আরও পীড়াপীড়ি করার জন্য।

অ্যাশেজ জিতে বিদায় নিয়েছেন ওয়ার্ন

আগের দিনই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচে ওয়ার্নের একটি ফ্লিপারে অর্জুনা রানাতুঙ্গা এলবিডব্লিউ বিবেচিত হয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান আম্পায়ার ছাড়া প্রায় সবার বিচারেই। পরে রানাতুঙ্গাই ম্যাচ জিতিয়ে দেন শ্রীলঙ্কাকে। ওয়ার্নকে যে-ই বললাম, 'কাল রানাতুঙ্গা মনে হয় আউট ছিল', অমনি হাসতে হাসতে দু'পা পিছিয়ে জিভে কামড় দিয়ে মাথার ওপর আঙুল তুলে দিলেন। ওয়ার্নের কথা উঠলেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সেই ম্যাচটির শেষে দেখা একটা দৃশ্যই মনে পড়ে আমার। পুরস্কার বিতরণী শেষে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে পথ করে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া দলের খেলোয়াড়রা ড্রেসিংরুমে ফিরছেন ম্লান বিষণ্ণ মুখে। ব্যতিক্রম শুধু ওয়ার্ন। দীর্ঘ ব্যর্থতার পর সিঙ্গার টুর্ণামেন্টের ফাইনাল ওঠার অপ্রত্যাশিত সাফল্যে উন্মাতাল শ্রীলঙ্কান দর্শকরা হই হই করছে, অস্ট্রেলিয়ানদের দেখে আরও বেশি। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের সবাই মাথা আরও নিচু করে ফেললেন। একমাত্র ওয়ার্নের মুখে তখনও হাসি। হাসতে হাসতে চারদিকে তাকাচ্ছেন, একজন তাঁর নাম ধরে ডাকতেই সেদিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। এই লোককে ভালো না বেসে পারা যায়!

লেখার সময়কাল: ডিসেম্বর ১৯৯৪।