২০১৮ এশিয়া কাপে ভাঙা হাত নিয়েও এক বল খেলে সাহসের দারুণ উদাহরণ গড়েছিলেন তামিম ইকবাল। আজ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে মাংসপেশিতে টান নিয়ে অনেকক্ষণ ব্যাটিং করেছেন পারভেজ হোসেন।
কে বলে সাহসী সুন্দর ব্যাটিং সব সময় চার ছক্কার ফুলঝুরিতে হয়? কখনো কখনো সাহসের সৌন্দর্য শুধু একটা বল ঠেকিয়ে রাখাও হতে পারে। আবার কখনো ৩৪ বলে ৩ চারে ২২ রানের ইনিংসও হতে পারে সাহসী সুন্দর ব্যাটিংয়ের অনুপম নিদর্শন! মাংসপেশিতে চোট নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ে নেওয়া একেকটি রান হতে পারে সাহসের, সৌন্দর্যের উদাহরণ।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাহসী ব্যাটিংয়ের কথা বললে এত দিন শুধু ২০১৮ এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তামিম ইকবালের ওই এক বল খেলার ছবিটিই স্মৃতিতে ভাসত। সে তালিকায় এবার যোগ হয়ে গেল আরেকটি নাম—পারভেজ হোসেন! ইতিহাস যতবার যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেটেই বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের গৌরবের কাহিনি বলবে, যতবার পচেফস্ট্রুমে আজকের অনূর্ধ্ব-১৯ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের দারুণ দাপুটে জয়ে চোখ ফিরবে, সাহসের দারুণ ছবি হয়ে বারবার সামনে আসবে পারভেজের ৩৪ বলে ২২ রানের ইনিংসের ছবি।
স্কোরকার্ডে চোখ রাখলে একটু ভুল বোঝাবুঝির তৈরি হতে পারে। ভারতকে ১৭৭ রানে আটকে দেওয়ার পর বাংলাদেশের যুবারা যে ৩ উইকেটে ম্যাচটা জিতে গেল, পচেফস্ট্রুমে ভাসল বিশ্বজয়ের আনন্দে, সে পথে ওপেনিংয়ে নামা পারভেজের রান তো ৭৯ বলে ৭ চারে ৪৭ রানের। তাহলে ৩৪ বলে ৩ চারে ২২ রানের ইনিংসের কথা কোত্থেকে আসছে?
পারভেজের ইনিংসটা যে দুই ভাগে বিভক্ত! ৪৫ বলে ৪ চারে ২৫ রানের প্রথম ভাগটা বাংলাদেশ ইনিংসের সুর বেঁধে দিয়েছে, কিন্তু সে তো অনেক ওপেনারই করেন। হয়তো অনেকে আরও ভালোই করেন। কিন্তু ৩৪ বলে ২২ রানের পরের ভাগটাতে পারভেজের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ানো, একেকটি চার বাংলাদেশের তেজের গল্প বলে। বলে শৌর্যের গল্প।
২০১৮ এশিয়া কাপের ভাঙা এক হাতে প্লাস্টার বেঁধে এক হাতে তামিমের ব্যাট করার ওই দৃশ্য কেউ ভোলার কথা নয়। স্কোরবোর্ড বলবে, ভাঙা হাত নিয়ে তামিম সেদিন শুধু একটি বল খেলেছিলেন, কোনো রান নেননি। কোনোমতে ঠেকিয়েছেন শুধু। কিন্তু ভাঙা হাতে প্লাস্টার বেঁধে ঠেকানো তো নয়, তামিমের ওভাবে মাঠে নামাই অসীম সাহসের গান গায়। তামিমকে অন্য পাশে পেয়ে, বারবার ওভারের শেষ বলে স্ট্রাইক নিয়ে তামিমকে অন্য পাশে রেখে সেদিন দুর্দান্ত ব্যাটিং করা মুশফিকও যে ক্রিকেটের অনন্য সৌন্দর্যের গল্প লিখেছেন। তামিম-মুশফিকের জুটিটা সেদিন ছিল মাত্র ১৬ বলের, মাত্র ৩২ রানের, অল্প কিছু মিনিটের। আর অনেক সাহসের।
ওরকম কিছু ভাঙেনি আজ পারভেজের, পায়ের মাংসপেশিতে টানই পড়েছে শুধু। কিন্তু আগামী জুনে ১৮-তে পা রাখতে যাওয়া পারভেজের জন্য মঞ্চটা তো আরও বিশাল! বিশ্বজয়ের হাতছানি সামনে। কিন্তু যখন দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে নামতে হচ্ছিল তাঁকে, বাংলাদেশ তখন থরহরি কম্পমান! ২৩তম ওভারের শেষ বলে ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন ফিরে যাচ্ছেন অভিষেক দাস, তখনো জয় থেকে ৭৬ রান দূরে বাংলাদেশ! ভারতের বিপক্ষে গত বছর জুলাই-আগস্টে ইংল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল আর সেপ্টেম্বরে যুব এশিয়া কাপের ফাইনালে খুব কাছে গিয়েও হারের স্মৃতিতে তখন দুশ্চিন্তার থার্মোমিটারে পারদ চড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে এমন বিপদে পড়তে হওয়ার পেছনেও সম্ভবত পারভেজের মাংসপেশিতে টান পড়ার ভূমিকা আছে। নবম ওভারে তানজিদ হাসান আউট হওয়ার আগেই তাঁর সঙ্গে মিলে ওপেনিং জুটিতে ৫০ রান এনে দিয়েছিলেন পারভেজ। ভারতের যে দুই পেসার ভোগাতে পারেন বলে শঙ্কা ছিল, সেই কার্তিক ত্যাগি ও সুশান্ত মিশ্রকে সামলে নিচ্ছিলেন সহজেই। কিন্তু এর চার ওভার পর আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল হাসান ফিরতেই বিপদ। এর কিছুক্ষণ আগেই একটা রান নিতে গিয়ে পায়ের মাংসপেশিতে টান পড়েছিল পারভেজের, সেটিকে উপেক্ষা করেই হয়তো খেলে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মাহমুদুল আউট হতেই অন্য প্রান্তে মাটিতে শুয়ে পড়লেন পারভেজ। ব্যথাটা আর হয়তো সহ্য হচ্ছিল না! তিনিও উঠে গেলেন। বাংলাদেশের তখন বিপদ। দুই প্রান্তেই নতুন ব্যাটসম্যান। এর মধ্যে ভারতের লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণয় এসে বাংলাদেশের মিডল অর্ডার গুঁড়িয়ে দিলেন। ৬২ রানে ১ উইকেট থেকে ৬২ বলের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে গেল ৬ উইকেটে ১০২! চার উইকেট বিষ্ণয়ের।
ড্রেসিংরুমে ততক্ষণে কিছুটা শুশ্রূষা নেওয়া পারভেজ এরপর আবার মাঠে ফিরলেন। জুটি বাঁধলেন দারুণ ব্যাটিং করা অধিনায়ক আকবর আলীর সঙ্গে। ৪১ রানের সে জুটিতে পারভেজেরই রান ৩৪। জুটিতে বাউন্ডারি ৫টি, পারভেজের ৩টি। বাকি রানগুলোর মধ্যে চারটি রান এসেছে অতিরিক্ত থেকে, বাকি রানগুলো দৌড়ে। এর মধ্যে দুই রান দুজনে নিয়েছেন দুবার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ানো পারভেজের প্রতিটি রানই তো তাঁর বীরত্বের গল্প বলে।
তামিমের মতো হাতে হয়তো ব্যান্ডেজ ছিল না। কিন্তু পারভেজের গল্পটাও কম বীরত্বের নয়।