>প্রভাত কি সব সময় দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়? কখনো দেয়, কখনো দেয় না। ক্রিকেটও এমনই। দুঃস্বপ্নের মতো শুরুর পরও যেমন আলো ছড়ানোর গল্প আছে, তেমনি হইচই ফেলে দেওয়া আবির্ভাবের পর পথ হারিয়ে ফেলারও। এসব গল্প নিয়েই উৎপল শুভ্রর ধারাবাহিকের শেষ পর্ব।
সবচেয়ে ভালো কী হতে পারে? অবশ্যই উইকেট। সবচেয়ে খারাপ? বড় জোর ছক্কা, এই তো! এমনিতে ধুকপুক করা হৃদপিন্ড বুকে তখন ড্রাম বাজাচ্ছে। মনে চলছে সবচেয়ে ভালো আর সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার কাটাকুটি খেলা! টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলটি করতে যাচ্ছেন বোলার। দর্শকও একটু নড়েচড়ে বসেছেন। হয়তো আগেই বোলারের নাম শুনেছেন, হয়তো শোনেনইনি। তাতে কি আসে যায়! টেস্ট ক্রিকেটে কোনো বোলারের প্রথম বলটি নিয়ে বাড়তি একটু আগ্রহ থাকেই। বেশির ভাগ সময় তাতে বলার মতো কিছুই হয় না। বোলার ছাড়া আর কারও হয়তো একটু পরে মনেই থাকে না, বলটিতে কী হয়েছিল। প্রথম বলেই উইকেট পেয়ে গেলে অবশ্যই মনে থাকে। ছক্কা খেয়ে গেলেও।
রেকর্ড বইয়ে প্রথম বলেই উইকেটের বিস্তারিত সব লেখা আছে। কিন্তু প্রথম বলেই ছক্কার নেই। একটু ভুল হলো। একটা ছক্কার আছে। কারণ সেটি শুধু অভিষিক্ত বোলারেরই প্রথম বল ছিল না, ছিল টেস্টেরও প্রথম বল। ম্যাচের প্রথম বলেই ছক্কা এই একবারই দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। প্রথম বলটিতেই তাই ইতিহাস হয়ে গেছেন সোহাগ গাজী।
ক্রিস গেইল ছক্কা মেরে দেওয়ার আগেই ইতিহাস নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেটি সোহাগ গাজীর হাতে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বল তুলে দেওয়ার পরই। কী আশ্চর্য, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলটিই করছেন কিনা এই টেস্টেই অভিষিক্ত একজন স্পিনার! এর আগে হয়েছে এমন? খুঁজতে খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হয়েছে এক শ বছরেরও বেশি। অবশেষে যা পাওয়া গেছে ১৯০৯ সালে গিয়ে। এই তো, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওভাল টেস্টের প্রথম বলটি করেছিলেন অভিষিক্ত ইংলিশ লেগ স্পিনার ডগলাস কার।
২০১২ সালের নভেম্বরে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হকচকিয়ে দেওয়া এমন একটা শুরুর পরও সগৌরবে ফিরে এসেছিলেন সোহাগ গাজী। প্রথম ওভারের চতুর্থ বলে আরেকটি ছক্কা খেয়েছেন। দুটি লেগ বাইসহ সেই ওভারে রান উঠেছে ১৮। নিজের তৃতীয় ওভারে গেইলকে আউট করে শেষ হাসিটা সোহাগই হেসেছেন। পরে তো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ওপেনারকে তাঁর 'বানি'-ই বানিয়ে ফেলেছেন। টেস্ট-ওয়ানডে-বিপিএল সবখানে মাঠে সোহাগ গাজীর 'অত্যাচার' আর প্রেস কনফারেন্সে এ নিয়ে প্রশ্ন শুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত গেইলের মেজাজ হারিয়ে ফেলার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে। বিপিএলের একটা ম্যাচের পরই তো মনে হয়, 'গাজী, গাজী, গাজী...এক কথা আর কত' বলে তাঁর বিস্ফোরিত হওয়া!
প্রথম বলে ছক্কা খাওয়ার পর গেইলকে আউট করার কারণেই শুধু স্মরণীয় হয়ে নেই সোহাগ গাজীর অভিষেক টেস্ট। এর চেয়ে বড় কারণও আছে। প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬। টেস্ট অভিষেকে বাংলাদেশের কোনো বোলারের সেরা বোলিংয়ের সেই রেকর্ড এখনো ভাঙেনি।
এটি তো শুধুই বাংলাদেশের রেকর্ড। অনেকের তা মনেও থাকে না। সোহাগ গাজীর আসল রেকর্ড তো অন্য। বিশ্ব ক্রিকেটকে সচকিত করে তোলা সেই রেকর্ড। কত বড় বড় অলরাউন্ডার দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট, তাঁদের কেউ যা করতে পারেননি, ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে সেটিই করে ফেলেন সোহাগ। একই টেস্টে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিক! সপ্তম টেস্টে অভূতপূর্ব এই কীর্তি গড়ার পর কোথায় সত্যিকার এক অলরাউন্ডার হয়ে উঠবেন, তা না, উল্টো যেন হারিয়ে যেতে লাগলেন সোহাগ। এরপর খেলেছেন আর মাত্র তিনটি টেস্ট। সর্বশেষটি ছয় বছরেরও বেশি আগে। মেহেদী হাসান মিরাজের পর নাঈম হাসানেরও আবির্ভাবে এক রকম নিশ্চিতই হয়ে গেছে, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টেস্টটিকে এক সময় 'সর্বশেষ' থেকে 'শেষ' লিখতে হবে। শেষটাও তাহলে তাঁর সবচেয়ে বড় কীর্তির সাক্ষী চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামেই!
ইতিহাসে তাঁর নাম থাকবে। চট্টগ্রাম টেস্টে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিকের ওই অনন্য 'ডাবল' তো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর দ্বিতীয়। এর আগে জাতীয় লিগেও তা করেছেন একবার। দক্ষিণ আফ্রিকার মাইক প্রোক্টর ছাড়া আর কেউ যা দুবার করতে পারেননি। ১০ টেস্ট আর ২০ ওয়ানডেতেই সোহাগ গাজীর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেলে সেটি তাই বড় আফসোস হয়ে থাকবে। টেস্টের পর ওয়ানডেতেও কী দারুণ শুরু! ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই সফরেই খুলনায় ২৯ রানে ৪ উইকেট ছিল অভিষেকে কোনো অফ স্পিনারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। পরপর দুই ওভারে গেইল আর স্যামুয়েলসকে তুলে নিয়ে বাংলাদেশের জয়ের ভিতটাও তাঁর হাতেই গড়া। ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফিটা ছিল সেটিরই স্বীকৃতি।
দুই বছর পার হওয়ার আগেই সেই সোহাগ গাজী কেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অপাংক্তেয় হয়ে পড়লেন, এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর সেভাবে খোঁজা হয়নি। ফিটনেস নিয়ে অমনোযোগী, অনুশীলনে অবহেলা...ছাড়া ছাড়া শোনা যাওয়া এ সব কথাই সত্যি হয়ে থাকলে মনে প্রশ্নটা জাগেই। তারকাখ্যাতির আলোতেই কি তাহলে ঝলসে গেছে তাঁর চোখ? নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্ব রেকর্ড গড়া ওই সিরিজ শেষে ঈদ করতে পটুয়াখালীতে তাঁর বাড়িতে যাবেন। সেটি নিয়েই জাতীয় দৈনিকে লঞ্চের কেবিনে বসে থাকা সোহাগ গাজীর বড় একটা ছবি দিয়ে স্টোরি। যেখানে যাচ্ছেন, ঘিরে ধরছে মানুষ। এ সবেই কি মাথা ঘুরে গিয়েছিল? সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিকের চট্টগ্রাম টেস্টের পর কথা বলে কিন্তু অন্যরকমই মনে হয়েছিল। হ্যাটট্রিক করেছিলেন টেস্টের শেষ দিনে। খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনেও এসেছেন। কিন্তু সেখানে এক-দুই লাইনের উত্তরে মন ভরেনি। সংবাদ সম্মেলনে বসেই তাই ঠিক করে ফেলেছি, সোহাগ গাজীর একটা একান্ত সাক্ষাৎকার নিতে হবে। নইলে এমন একটা রেকর্ডের প্রতি অবিচার করা হয়। সেটি কঠিন কিছু নয়। দুই দলই আগ্রাবাদ হোটেলে উঠেছে, আমিও তাই। সোহাগ গাজীর রুমও আমার ফ্লোরেই। তবে রুমে ঢুকে যাওয়ার আগেই তাঁকে ধরতে হবে, ডেডলাইনের তাড়ায় পরে আর সময় পাওয়া যাবে না। মাঠ থেকে শশব্যস্ত হয়ে হোটেলে ফিরেই অবশ্য একটা দু:সংবাদ পেলাম। একটু পরেই বাংলাদেশ দলের ঢাকা ফেরার ফ্লাইট। ক্রিকেটাররা হোটেলে এসেই বেরিয়ে যাবেন। সোহাগের রুম আমার রুমের দুটি কি তিনটি রুম পরে। আমি রুমের দরোজা খুলে তাই অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পরই সেটির সামনে সোহাগ। ইন্টারভিউয়ের কথা বলতেই পূর্ব অনুমিত উত্তরটা পেলাম---হাতে একদম সময় নেই। এখনই বেরিয়ে যেতে হবে। 'আরে, দশ মিনিটে কিছু হবে না' বলে সোহাগের হাত ধরে রুমে এনে বসালাম। এমন তাড়াহুড়ো, তারপরও সংবাদ সম্মেলনে মুখচোরা সোহাগ ইন্টারভিউয়ে অনেক স্বত:স্ফুর্ত। বাংলাদেশ দলে খেলার জন্য কত কষ্ট করেছেন, সেই বর্ণনা দিতে দিতে এক সময় বয়সভিত্তিক কোনো জাতীয় দলেই সুযোগ না পাওয়ার দু:খের কথা বলছিলেন। আর বলেছিলেন, বন্ধুরা সবাই বাংলাদেশ দলের জার্সি পড়লেও তিনি কোনো দিন তা পরেননি। মনে একটা জেদ ছিল, নিজে জাতীয় দলে খেলেই সেই জার্সি পরবেন। স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাওয়ার পর কি তাহলে সেই জেদটা হারিয়ে গিয়েছিল? শুধু সোহাগ গাজীই দিতে পারেন এই প্রশ্নের উত্তর।
সোহাগ গাজীর হ্যাটট্রিকটা বেশি বিখ্যাত হয়ে গেছে সেটির সঙ্গে সেঞ্চুরিও যোগ হওয়ায়। তবে শুধু হ্যাটট্রিককে আলাদা করে নিলে এর চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত হ্যাটট্রিকের দেখা মিলবে। লেখাটা যেহেতু শুরু আর শেষের বৈপরীত্য নিয়ে, আমরা তাই শুধু অভিষেকে হ্যাটট্রিকেই থাকি। একজন বোলার টেস্ট অভিষেকে প্রথম বলেই উইকেট নেওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। দেখতে পারেন ৫ উইকেট-১০ উইকেট, এমনকি ম্যাসি-হিরওয়ানির মতো ১৬ উইকেট নেওয়ার স্বপ্নও। কিন্তু হ্যাটট্রিক করে ফেলার স্বপ্ন কেউ দেখেন বলে মনে হয় না। হ্যাটট্রিক তো বলে-কয়ে করার জিনিস নয়, ওটা হয়ে যায়। যেমন হয়ে গিয়েছিল তাইজুল ইসলামের। ওয়ানডে অভিষেকে হ্যাটট্রিক করার প্রথম কীর্তিটা বাংলাদেশের এই বাঁহাতি স্পিনারের। অথচ দেখুন, সেই তাইজুল বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে জায়গাই পান না। ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মিরপুরে অভিষেকেই ইতিহাস গড়ার পর এই ছয় বছরে খেলেছেন আর মাত্র ৮টি ওয়ানডে।
টেস্ট অভিষেককে হ্যাটট্রিকে রঙিন করে তুলতে পেরেছেন মাত্র যে তিনজন বোলার, তাঁদের কারও ক্যারিয়ারও বলার মতো কিছু হয়নি। মরিস অ্যালম, পিটার পেথেরিক ও ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের মধ্যে একমাত্র ফ্লেমিংই পেরেছেন টেস্ট সংখ্যাকে দুই অঙ্কে নিয়ে যেতে। ২০ টেস্টে ৭৫ উইকেটকে ভালোই বলতে হয়, কিন্তু হ্যাটট্রিক দিয়ে শুরুর কথা মনে রাখলে? তখন কি মনে হয় না আরও বেশি কিছু হওয়া উচিত ছিল! হয়নি, কারণ দারুণ এই সুইং বোলারকে এক সময় টেস্টের চেয়ে ওয়ানডেতেই বেশি কার্যকরী বলে ভাবতে শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচকেরা। ৮৮টি ওয়ানডেতে ১৩৪ উইকেটে সেটির প্রমাণও আছে। এই পরিসংখ্যান থেকে অবশ্য ওয়ানডে বোলার হিসাবে ফ্লেমিংয়ের আসল বিশেষত্ত্বটাই জানার উপায় নেই। জানার উপায় নেই যে, তিনি ছিলেন 'শেষ ওভারের জাদুকর'। স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা আর নার্ভাসনেস জয় করে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্য্যাত ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ পরপর দুই বিশ্বকাপের দুই সেমিফাইনাল।
ওয়ানডেতে অভিষেক হয়ে যাওয়ার প্রায় নয় মাস পর ১৯৯৪ সালের পাকিস্তান সফরে ফ্লেমিংয়ের টেস্ট অভিষেক। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ওই হ্যাটট্রিক, যেটি ছিল দুই ওভারে বিস্তৃত। এক ওভারের শেষ দুই বলে আমির মালিক ও ইনজামাম-উল হক, পরের ওভারের প্রথম বলে সেলিম মালিক। সেলিম মালিক তাতে খুব বেশি মন খারাপ করেছিলেন বলে মনে হয় না। এর আগেই যে করে ফেলেছেন ২৩৭ রান।
ফ্লেমিং তা-ও ২০টি টেস্ট খেলেছেন, টেস্ট অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করায় তাঁর দুই পূর্বসুরী মরিস অ্যালম ও পিটার পেথেরিকের ক্যারিয়ার তো ৫ আর ৬ টেস্টেই শেষ। মরিস অ্যালমের কীর্তিটা শুধু হ্যাটট্রিকেই সীমাবদ্ধ নয়। টেস্ট অভিষেকে হ্যাটট্রিকে যেমন তিনি প্রথম, তেমনি টেস্টে পাঁচ বলে চার উইকেট নেওয়ায়ও। এটাও তাঁর পরে মাত্র দুজনই করতে পেরেছেন---ক্রিস ওল্ড ও ওয়াসিম আকরাম।
অ্যালমের টেস্ট অভিষেক মিলে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট ম্যাচের সঙ্গে। ১৯৩০ সালের সেই ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট আরেকটি কারণেও আলাদা। ইংল্যান্ড এখানে টেস্ট খেলছিল, একই সঙ্গে খেলছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজেও! তখন অবশ্য ইংল্যান্ড টেস্ট খেলত এমসিসি নামে। এমসিসি মানে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের ওপরই ন্যস্ত ছিল টেস্ট ক্রিকেট দেখভালের ভার। তখন তো কোনো সফরে যাওয়া মানে প্লেনে উঠলাম আর নামলাম নয়। সমুদ্রপথে যেতে আসতেই সময় শেষ। চাইলেই বছরে দুটি ট্যুর করা যায় না। ওয়েস্ট ইন্ডিজে যেতেই হবে, আবার নিউজিল্যান্ডকে বরণ করে নিতে হবে টেস্ট পরিবারে। এই মহান দায়িত্ব পালন করতে এমসিসি তাই একই সঙ্গে দুটি দল নির্বাচন করে তুলনামূলক দুর্বল দলটিকে নিউজিল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়, অন্যটিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। নিউজিল্যান্ডের ১১ জনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ৬ জনেরও তাই ক্রাইস্টচার্চে অভিষেক। মরিস অ্যালমের হ্যাটট্রিকটি তাই আরেকটি দিক থেকেও অনন্য হয়ে আছে। হ্যাটট্রিক করা বোলারের মতো হ্যাটট্রিকের তিন শিকারও ডেবুট্যান্ট---এমন আর হয়নি কখনো।
সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার পেস বোলার অ্যালমের ৫ টেস্টের ৪টি নিউজিল্যান্ডের ওই সফরেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ডারবানে আরেকটি টেস্ট খেলে বছর না ঘুরতেই তাঁর ক্যারিয়ার শেষ। তবে ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর সংশ্রব শেষ হয়নি। এমসিসির সঙ্গে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। এক সময় প্রেসিডেন্টও হয়েছেন। ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ করা না-করা নিয়ে যখন ক্রিকেট বিশ্ব টালমাটাল, সেই সময়টায় মরিস অ্যালম এমসিসির প্রেসিডেন্ট। একই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (পরে যেটি আইসিসি হয়েছে) চেয়ারম্যানও। যৌবনে একটা জ্যাজ দলে স্যাক্সোফোন বাজাতেন। কিন্তু তখন পরিস্থিতি এমন যে, স্যাক্সোফোনে আর ঠোঁট লাগাবেন কি, নিজের প্রাণই ওষ্ঠাগত!
অ্যালমের বছরখানেকের ক্যারিয়ারকেই পিটার পেথেরিকের তুলনায় দীর্ঘ বলতে হয়। এই অফ স্পিনারের তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাঁচ মাসও থাকা হয়নি। তাঁর টেস্ট খেলাটাই অবশ্য ঘটনাচক্রে। পেশায় ছিলেন মেকানিক, ক্রিকেটকেই ধ্যানজ্ঞান করেননি কখনোই। যে কারণে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক ৩৩ বছর বয়সে। এক বছর পরই ডাক পেয়ে যান পাকিস্তান সফরের নিউজিল্যান্ড দলে। সেটিও ঘটনাচক্রে, প্রথম পছন্দের স্পিনার হেডলি হাওয়ার্থ সফরে যেতে পারছেন না বলে। ১৯৭৬ সালে যে লাহোর টেস্টে পেথেরিকের অভিষেক, তাতে পাকিস্তান দলেও এক তরুণের অভিষেক হয়েছিল। তাঁর নাম জাভেদ মিয়াঁদাদ। মিঁয়াদাদকে আউট করেই পেথেরিকের হ্যাটট্রিক-যাত্রা শুরু। এর আগেই অবশ্য মিয়াঁদাদ ১৬৩ রান করে ফেলেছেন। হ্যাটট্রিকের বাকি দুই শিকারও নামি অলরাউন্ডার--ওয়াসিম রাজা ও ইন্তিখাব আলম। প্রথম ইনিংসে ওই ৩টিই উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ২টি। সেই দু্ই ব্যাটসম্যানও বিখ্যাত নাম। জহির আব্বাস ও মুশতাক মোহাম্মদ।
পাকিস্তান আর ভারতে ৫টি টেস্ট খেলে দেশে ফেরার পর আর একটি টেস্টেই সুযোগ পেয়েছিলেন পেথেরিক। অকল্যান্ডে সেই টেস্টে মাত্র ৪ ওভার বোলিং করার সুযোগ পান। উইকেট নিশ্চয়ই খুব পেস সহায়ক ছিল, নইলে নিউজিল্যান্ডের তিন পেসার হ্যাডলি, চ্যাটফিল্ড আর ল্যান্স কেয়ার্নস মিলেই কেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ৯৭.১ ওভারের মধ্যে ৮৩.১ ওভার করে ফেলবেন! দ্বিতীয় ইনিংসে পেথেরিকের বোলিং করার প্রশ্নই ওঠেনি। মাত্র ৩.৫ ওভার ব্যাটিং করেই যে ২৮ রানের জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে অস্ট্রেলিয়া।
৬ টেস্টে ১৬ উইকেটেই তাই শেষ পিটার পেথেরিকের গল্প। তবে সেই গল্পের রেশ রয়ে গেছে এখনো। শুধু অভিষেক টেস্টটি খেলেই যদি থেমে যেতেন, তাতেও থাকত। ডেমিয়েন ফ্লেমিংয়ের তা-ও বলার মতো আরও দু'একটা গল্প আছে। মরিস অ্যালম ও পিটার পেথেরিকের তো অভিষেক টেস্টে ওই হ্যাটট্রিকটাই সম্বল। পরলোকে দুজনের দেখা হলে ঘুরেফিরে সেই গল্পই হয়তো করেন তাঁরা দুজন!