বাংলাদেশে একবারই টেস্ট সিরিজ খেলেছিলেন ওয়ার্ন, ২০০৬ সালে
বাংলাদেশে একবারই টেস্ট সিরিজ খেলেছিলেন ওয়ার্ন, ২০০৬ সালে

ওয়ার্নকে নিয়ে হাবিবুল বাশার

আরেকটা শেন ওয়ার্ন আর আসবে না

খবরটা যখন পেয়েছি, গাড়ি চালাচ্ছিলাম। এক বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি। এসএমএস এল, খেয়াল করা হয়নি শুরুতে। এরপর দেখলাম, শেন ওয়ার্ন আর নেই। করোনার সময়ে আসলে এমন অনেক খবর পেয়েছি। তবু এটা হজম করতে আমার আসলে একটু সময় লেগেছে। রডনি মার্শ চলে গেলেন এর আগে, সে খবর পেলাম। আর ওয়ার্নকে তো স্বাস্থ্যবান হিসেবেই জানতাম। পরিশ্রম করত বলেও জানি। এটা আসলে ভাবাই যায় না, এত কম বয়সে এভাবে চলে যাবে!

১৯৯৯ বিশ্বকাপেও আমি টিভিতে দেখেছি ওর খেলা, আমার তো সেবার খেলা হয়নি। এর আগেও দেখেছিলাম, তবে সে বিশ্বকাপে আরও ভালোভাবে দেখলাম। সেমিফাইনাল, ফাইনাল। আসলে ওয়ার্নের বোলিংটা দেখতেই ভালো লাগত আমার। অনেকেই হয়তো নির্দিষ্ট কোনো বল নিয়ে আলোচনা করে বা জানতে চায়। আমার কাছে কিন্তু শেন ওয়ার্নের বোলিং দেখতে পারাটাই ভালো লাগার একটা ব্যাপার ছিল। মানে, একজন যে বোলিং করছে—এটি যেন ফুটে উঠত সবকিছুতে। ও একটা প্যাকেজ—ওর উপস্থিতি, আগ্রাসন, বোলিংয়ের আগের ভাবটা, পরে যে আবেদন করার ভঙ্গিমাটা। সবই ভালো লাগত আমার, উপভোগ করতাম। উইকেট পেল কি না, তাতে কিছু যেত আসত না। ওর মধ্যে দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মতো আলাদা কিছু ছিল।

ওয়ার্নের মধ্য দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মতো অনেক কিছুই ছিল, বললেন হাবিবুল

২০০৩ সালে যখন সুযোগ এল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট খেলার, একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেন ওয়ার্নকে খেলা হলো না। বিশ্বকাপের আগে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে তখন সে নিষিদ্ধ। স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে খেলতে হয়েছিল সেবার। ম্যাকগিলও ভালো বোলার, কিন্তু শেন ওয়ার্ন তো নয়! আমি তো অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার ড্যারিল হার্পারকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম—‘ওয়ার্ন কেন আলাদা?’ ম্যাকগিলের বল তো আরও বেশি টার্ন করে। হার্পার বলেছিল, ‘দেখো, ম্যাকগিল খুব ভালো। কিন্তু ওয়ার্ন “ডমিনেটিং”। আমাদের ওপরও আধিপত্য থাকে ওর।’

সে সফরে খেলা না হলেও ওয়ার্নের সঙ্গে কিন্তু দেখা হয়েছিল। ডারউইনেরই হোটেলে। কোনো একটা কাজে এসেছিল, টেনিস খেলতে বোধ হয়। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের একটা ব্যাপার আছে, মাঠের বাইরে তাঁরা দারুণ মানুষ। মাঠের বাইরে খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। ওয়ার্নও তখন ‘হাই–হ্যালো’ করেছে, খবর নিয়েছে। তখন আমরা ভালো খেলছিলাম না খুব একটা, ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সেও ভুগতাম আসলে। ডেভিড হুকস সিরিজ শুরুর আগে এক দিনে টেস্ট শেষ করে দেওয়ার তত্ত্ব দিয়েছেন। তবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের আচরণে কোনো তাচ্ছিল্য ছিল না।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের ট্রফি নিয়ে দুই ওয়াহ ভাই স্টিভ ও মার্কের সঙ্গে শেন ওয়ার্ন

ওয়ার্নও যেমন দেখা হওয়ার পর উৎসাহ দিয়েছে, বলেছে, ‘উন্নতি করেছ তোমরা। তোমাদের ভবিষ্যৎ ভালো।’ খুব বেশি কথা হয়নি, তবে প্রথম দেখার ওই ব্যাপারটাও ভুলব না কখনো।

তিন বছর পর অস্ট্রেলিয়া যখন বাংলাদেশে এল, ওয়ার্নকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে, কথাও হয়েছে অনেক। আসলে ও অন্য রকম এক মানুষ ছিল। মাঠের বাইরে অনেক কিছু জানতে চাইত। প্রথম যখন দেখা হলো, কথা বলতে বলতে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই, তোমাদের এখানে সবচেয়ে কড়া সিগারেট কোনটা?’ আমি বলেছিলাম, ‘“ক্যাপস্টান”! শুনেই বলল, ‘ক্যান ইউ ব্রিং মি আ প্যাকেট অব ক্যাপস্টান?’

মাঠের বাইরে সাধারণত আমরা যখন ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলি, ক্রিকেট নিয়েই কথা বলি। কিন্তু ওয়ার্ন আমাদের সংস্কৃতি, জীবনযাপন—এসব নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করত বেশি। ক্রিকেট নিয়েই বরং কথা কম বলত। হয়তো প্রশ্ন করলে জবাব দিয়েছে। কিন্তু আমরা অবসরে কী করি, কোথায় যাই—এসবই জানতে চাইত বেশি।

২০০৬ সালে ফতুল্লা টেস্টে ওয়ার্নকে বারবার হতাশ করেছিল বাংলাদেশ

ফতুল্লা টেস্টের আগে শেন ওয়ার্নকে কীভাবে খেলব, এটা নিয়ে তো অনেক পরিকল্পনা টিম মিটিংয়ে। কেউই তো আসলে ওকে গেমপ্ল্যান অনুযায়ী খেলতে পারত না। আমাদেরও সংশয় ছিল। তবে ফতুল্লার উইকেট একটু ধীরগতির ছিল, বল একটু ধীরে ঘুরছিল। এতে একটু সুবিধা হয়েছিল আমাদের। ওয়ার্ন নিজেও হয়তো ভাবেনি, আমরা ওকে এত ভালো খেলব। সে আসলে একটু বিস্মিতই হয়েছিল। আমি আর শাহরিয়ার নাফীস ভালো খেলেছিলাম, ভালো একটা জুটি হয়েছিল। ওর বোলিংয়ে স্বচ্ছন্দেই ব্যাটিং করেছিলাম। সাধারণত এমন ক্ষেত্রে হয়তো ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বদলে যায়, স্লেজিং করে। ওই ম্যাচে অমন কিছু করেনি। মুখ ফুটে কিছু বলেনি, তবে ওয়ার্নের হাবভাবে মনে হচ্ছিল যেন উৎসাহই দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ানরা সাধারণত এমন করে না।

ফতুল্লায় খরুচেও ছিল প্রথম ইনিংসে, ওভারপ্রতি ৫-এর ওপর রান দিয়েছিল। সে টেস্টটা তো জিততে জিততে হারলাম আমরা। ওয়ার্ন খেলা নিয়ে তেমন কথা বলতে চাইত না ম্যাচের পর। তবে ওয়ার্ন কেন ওয়ার্ন, সেটার ইঙ্গিত পেলাম চট্টগ্রামে গিয়ে। ওখানকার উইকেট একটু ফ্ল্যাট ছিল, ফতুল্লার চেয়ে আলাদা, একটু শক্ত। তখন লাট্টুর মতো বল ঘোরানো যেটি বলে, সেটি করেছিল। আমিও ৪৯ রানে আউট হলাম ওর বলে, সেটিও ‘সিগনেচার ডেলিভারি’তেই—মিডল-লেগে পড়ল, পা বাড়িয়ে ডিফেন্ড করলাম, এজে লেগে ক্যাচ উঠল। চট্টগ্রামের ওই উইকেটে সময়ই পাচ্ছিলাম না। মানে বল ছাড়ার পর থেকেই যেন ঘূর্ণি দেখতে পাচ্ছিলাম।

ওয়ার্নের সঙ্গে সামনাসামনি এরপর দেখা হয়নি আর। তবে ওর বোলিং যেমন মুগ্ধতা দিয়ে দেখতাম, উপভোগ করতাম কমেন্ট্রিও। অনেকেই তো অনেক ভালো কমেন্ট্রি দেয়, কিন্তু ওরটা কেন যেন একটু ভিন্নমাত্রার মনে হতো।

আমার মনে হয় না, এমন ক্রিকেটার আর আসবে। এমনিতেও টি-টোয়েন্টির যুগ, ক্রিকেটারদের বেড়ে ওঠার পরিবেশটা ভিন্ন। শেন ওয়ার্নের মতো চরিত্র, এমন ক্রিকেটার—মনে হয় না দেখা যাবে। ও আসলে একটা ‘ক্যারেক্টার’ ছিল, ‘জেনুইন ক্যারেক্টার’। সব সময় টগবগ করত। ওর সঙ্গে সময় কাটানো ভিন্ন রকম এক অভিজ্ঞতা। কত কিছু নিয়ে যে কথা বলেছি, বোধ হয় শুধু ক্রিকেটটাই বাদে! ওর ব্যক্তিত্বটাই ছিল এমন।

লেখক: বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক