>বিপিএলে বেশ কয়েকজন আফগানি স্পিনার খেলছেন। লক্ষ্য, মোহাম্মদ নবী-রশিদ খান বা নিদেনপক্ষে মুজিব-উর রহমানদের মতো বিপিএলে ভালো খেলে পরে আরও নামীদামি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কিন্তু আফগানি স্পিনাররা বাংলাদেশের যে টুর্নামেন্টে ভালো খেলে পরে দীর্ঘমেয়াদি সফলতা অর্জন করছেন, সেখানে বাংলাদেশ থেকে নতুন ভালো স্পিনার বের হয়ে আসছেন কই?
জহির খান। এবার বিপিএলে খুলনা টাইটানসের হয়ে আঁটসাঁট বোলিং করে নজর কাড়ছেন বেশ। আরও নজর কাড়ছেন বাঁহাতি চায়নাম্যান বোলার হওয়ার কারণে। বিরলপ্রজ স্টাইলের এই বোলার তো বলতে গেলে দেখাই যায় না!
কায়েস আহমেদ। বর্তমান সময়ে আফগান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা রশিদ খানের মতো তিনিও জন্মেছেন নঙ্গরহারে, রশিদের মতো তিনিও করেন ডানহাতি লেগ স্পিন। বিপিএলে রান দেওয়ার প্রতি কৃপণতা দেখানোর পাশাপাশি তিন ম্যাচে এভিন লুইস, আরিফুল হক ও কাইরন পোলার্ডের মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের উইকেট নিয়ে তিনিও দেখাচ্ছেন তাঁর প্রতিভা।
এবার আফগানি স্পিনারদের মধ্যে বিপিএলে সবচেয়ে ভালো তারকা এই দুজনই। বিপিএলকে যাঁরা বেছে নিয়েছেন নিজেদের প্রকাশ করার মঞ্চ হিসেবে। সে তুলনায় বাংলাদেশের নতুন কোনো স্পিনার আলো ছড়াচ্ছেন এবার?
একজনের নাম বলা যেতে পারে। ঢাকা ডায়নামাইটসের আলিস আল ইসলাম। কিন্তু এই প্রতিভাবান স্পিনার অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করে গত দুদিন যতটা না আলোচনায় আছেন, তার চেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন সন্দেহজনক বোলিং অ্যাকশনের কারণে। চলমান মৌসুমে বিপিএলের নিয়মিত দেশীয় স্পিনারদের মধ্যে আরও নাম তোলা যায় রংপুর রাইডার্সের নাজমুল ইসলাম ও সোহাগ গাজী, খুলনা টাইটানসের তাইজুল ইসলাম, রাজশাহী কিংসের আরাফাত সানী, চিটাগং ভাইকিংসের সানজামুল ইসলাম, সিলেট সিক্সার্সের অলক কাপালি ও আফিফ হোসেন ধ্রুবর নাম। তাঁদের মধ্যে আফিফ ও কাপালি ছাড়া মোটামুটি সবাই কয়েক বছর ধরেই জাতীয় দলে আসা-যাওয়া করছেন। কিন্তু তারপরও কেউই বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের নিয়মিত স্পিনার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।
আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক। সাকিবদের উত্থানের পর, কিংবা রফিক-রাজ্জাকদের যাওয়ার পর কতজন স্পিনার বাংলাদেশের ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পেরেছেন? সোহরাওয়ার্দী শুভ, ইলিয়াস সানী, আরাফাত সানি, সোহাগ গাজী, সাকলাইন সজীব, সানজামুল ইসলাম—আক্ষেপ শুধু বাড়িয়েই গেছেন।
ওদিকে আফগানিস্তানের স্পিনাররা বাংলাদেশে খেলতে আসেন নিজেদের বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করার মঞ্চ হিসেবে। আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুই তারকা—মোহাম্মদ নবী ও রশিদ খান, কিংবা হালের মুজিব–উর রহমান সবাই বিপিএলের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিতে আলো ছড়িয়েই আইপিএল, বিগ ব্যাশের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়েছেন। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে এক মৌসুম খেলেছিলেন নবী। সেখান থেকে সিলেট রয়্যালসের হয়ে বিপিএলে অভিষেক। তা–ও প্রথমে তাঁকে কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিই কিনতে চাইনি। চোটের কারণে আন্দ্রে রাসেল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়লে তাঁর জায়গায় সিলেটের তৎকালীন কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন নিয়ে এসেছিলেন নবীকে।
দ্বিতীয়বারে পাওয়া সুযোগ হেলায় হারাতে দেননি নবী। সেবার ১৮ উইকেট নিয়ে সিলেট রয়্যালসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়ে বিশ্বকে দিয়েছিলেন নিজের আগমনী বার্তা। পরে চিটাগং ভাইকিংস, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস আর রংপুর রাইডার্সের মতো বিপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজিতে খেলা নবী এখন একে একে মেলবোর্ন রেনেগডস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, লেস্টারশায়ার, সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস প্যাট্রিয়টসের মতো বৈশ্বিক ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোতে খেলে নিজেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের অন্যতম কার্যকরী খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রশিদ খানের কথা তো যত কম বলা যায় ততই ভালো। মাত্র ২০ বছর বয়সেই বিশ্বের সেরা স্পিনার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন নঙ্গরহারের এই জাদুকর। এই লেগ স্পিনারের উঠে আসাটাও কিন্তু বাংলাদেশ থেকেই হয়েছিল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হয়ে আলো ছড়িয়ে আইপিএলের সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, বিগ ব্যাশের অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্স, ইংল্যান্ডের সাসেক্সের মতো ক্লাবগুলোর চোখে পড়েছিলেন তিনি। সুযোগগুলো নিয়েছেনও দুহাত ভরে। প্রথমবার আইপিএলে খেলতে গিয়ে ১৪ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, হারিয়ে যেতে আসেননি রশিদ। গায়ানা আমাজন ওয়ারিয়র্সের হয়ে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে নেমে সিপিএলের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে করেছেন হ্যাটট্রিক। বিগ ব্যাশে খেলতে গিয়ে অ্যাডিলেড স্ট্রাইকার্সকে জিতিয়েছেন শিরোপা।
মুজিব জাদরানকেই দেখুন। বয়স মাত্র ১৮, এর মধ্যেই তাঁকে নিয়ে টানাটানি করে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব, হ্যাম্পশায়ার ও ব্রিসবেন হিটের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো।
রশিদ-মুজিব-নবীরা বাংলাদেশের লিগগুলোকে নিজেদের সাফল্যের প্রথম সোপান হিসেবে ব্যবহার করতে পারলেও কতজন দেশীয় স্পিনার তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করতে পেরেছেন? এক সাকিব আল হাসান ছাড়া বাংলাদেশের কতজন স্পিনার ভারতের আইপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ, ইংল্যান্ডের নেটওয়েস্ট টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টের মতো কোনো এক ফ্র্যাঞ্চাইজির মূল বোলার, মূল স্পিনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন? আচ্ছা মূল বোলার হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে রাখা যাক, এসব টুর্নামেন্টে নাম লেখাতে পেরেছেন? বড় তিন টুর্নামেন্ট বাদ দিয়ে পাকিস্তান সুপার লিগ, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও বা কে যেতে পেরেছেন?
শুধু এটিই নয়। আফগানি স্পিনারদের বৈচিত্র্যের দিকেও চোখ রাখুন একটু। ডানহাতি অফ স্পিনার দরকার? আছেন নবী। আছেন মুজিব। উঠে আসছেন পারভেজ মালিকজাই, শামসুর রহমান, জাভেদ আহামাদি, নজীব তারাকাই, সাবির নূরি।
ডানহাতি লেগ স্পিনার দরকার? সেখানে আছেন রশিদ। উঠে আসছেন কায়েস আহমেদ। মোহামেডানে খেলে যাওয়া রহমত শাহও আছেন। আছেন সামিউল্লাহ শেনওয়ারিও, আফগান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার মানা হয় যাঁকে।
বাঁহাতি স্পিনার চাচ্ছেন দলে? আফগানিস্তান থেকে উঠে আসছেন তারিক স্টানিকজাই, জিয়া-উর-রহমান, আমির হামজার মতো কিছু প্রতিভা।
এমনকি ভারতের কূলদীপ যাদবের মতো বাঁহাতি চায়নাম্যানও পেয়ে গেছে আফগানিস্তান! জহির খান এবার খেলছেন খুলনা টাইটানসে। আগেরবার ছিলেন রংপুর রাইডার্সের মতো দলেও। এবং যথারীতি রাজস্থান রয়্যালস, ল্যাঙ্কাশায়ারের মতো দলগুলোকে আকৃষ্ট করে ফেলেছেন!
সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? আগে বাঁহাতি অফ স্পিনারদের স্বর্গ বলা হতো যে বাংলাদেশকে। কয়েক বছর আগেও যেখানে সাকিব-রফিক-রাজ্জাক ছাড়াও পাইপলাইনে ছিলেন আরাফাত সানী, সোহাগ গাজী, সোহরাওয়ার্দী শুভ, ইলিয়াস সানীর মতো স্পিনাররা, সেখানে এখন বাঁহাতি স্পিনারও উঠে আসছেন না তেমন। টি-টোয়েন্টির যুগে যেখানে লেগ স্পিনারদের গুরুত্বের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই, সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনে লেগ স্পিনার প্রসঙ্গ উঠলেই শোনা যায়, তানবীর হায়দার আর জুবায়ের হোসেনকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস। এতটাই হারিয়ে গেছেন যে এবার বিপিএলেও খেলছেন না তাদের কেউ! বাঁহাতি লেগ স্পিনার বা চায়নাম্যানদের প্রসঙ্গ না হয় বাদই দেওয়া যাক। অফ স্পিনারদের তালিকায় মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে বর্তমানে নাঈম হাসান আছেন। তবে এখনো সংক্ষিপ্ত সংস্করণে নাঈমের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
স্পিন খেলতে অস্বস্তি বোধ করা দলগুলোর বিপক্ষে কালো মাটির নিচু উইকেট বানিয়ে টেস্টে বেশ সাফল্য পাচ্ছে বাংলাদেশ। নিজেদের কন্ডিশন ব্যবহার করাটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। কিন্তু এমন উইকেট বানিয়ে স্পিনারদের স্কিল বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে না তো? কষ্ট না করেই মুফতে উইকেট মিললেই কেই-বা চায় অনুশীলনে বাড়তি ঘাম ঝরাতে? প্রয়োজনীয় স্কিল থাকলে যেকোনো কন্ডিশনেই যে সাফল্য পাওয়া যায় সেটা তো রশিদ, মুজিব কিংবা ভারতের চাহাল, যাদবরা দেখিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে বোলাররা কি স্কিল বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন? নাকি উইকেট পাওয়ার পর কীভাবে উদ্যাপন করবেন সেটা নিয়েই ভাবছেন বেশি?