আধা ইংরেজ-আধা কিউই বাংলাদেশের এক সমর্থক!

হ্যামিল্টনপ্রবাসী বাংলাদেশি পরিবার এসেছে খেলা দেখতে। ছবি: উৎপল শুভ্র
হ্যামিল্টনপ্রবাসী বাংলাদেশি পরিবার এসেছে খেলা দেখতে। ছবি: উৎপল শুভ্র

বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচে গ্যালারিতে লাল-সবুজ পতাকা এখন আর ঘটা করে বলার মতো কিছু নয়। বিশ্বের যেখানেই খেলা হোক, গ্যালারিতে একটা বা দুটি হলেও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়েই। প্রেসবক্সে বসে গ্যালারির দিকে প্যানারোমিক দৃষ্টি ছড়িয়ে সেটিই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। নিউজিল্যান্ড সময় বেলা ১১টায় খেলা শুরুর সময় মাঠে দর্শকই হাতে গোনা কয়েকজন। লাল-সবুজের কোনো দেখা নেই। লাঞ্চের পর দূরে মাঠের দিকে নেমে যাওয়া ঘাসের ঢালটাতে সেটি চোখে পড়ল। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কয়েকটা পরিবারই মনে হয়। নিশ্চয়ই হ্যামিল্টনপ্রবাসী বাংলাদেশিই হবেন। গাড়িতে ঘণ্টা দেড়েকের দূরত্ব অকল্যান্ড থেকেও আসতে পারেন কেউ। সেই কৌতূহল থেকেই সেখানে যাওয়া।

হ্যাঁ, হ্যামিল্টনপ্রবাসী তিনটি পরিবারই এসেছে খেলা দেখতে। তাঁদের একজনের কাছ থেকেই জানলাম, হ্যামিল্টনে ২৫-৩০টি বাংলাদেশি পরিবারের বাস। ছুটির দিন হলে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে আরও অনেকেরই দেখা মিলত। শনি-রোববারে অনেকেই আসার পরিকল্পনা করে রেখেছেন। এ নিয়ে আর লেখার কী আছে! এমন কোনো অজানা তথ্য তো আর নয়। তখন কল্পনাও করিনি, কী চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য!

বাংলাদেশ খেলছে জেনে সকালেই সেডন পার্কে চলে এসেছেন তসলিম আরিফ। ছবি: উৎপল শুভ্র

প্রথমে ছোট চমকটার কথা বলে নিই। একটু দূরেই এক তরুণ একা বসে খেলা দেখছেন। চেহারা দেখে বাঙালিই মনে হলো। প্রশ্ন করে নিশ্চিত হওয়ার পর ‘আপনি কি হ্যামিল্টনেই থাকেন’ জিজ্ঞেস করে পাওয়া উত্তরটাই একটু চমকে দিল। ‘আমি জার্মানিতে থাকি। ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে মানহাইম নামে একটা ছোট শহরে।’ জার্মানিতে থাকেন? বাংলাদেশের খেলা দেখতে চলে এসেছেন এখানে? সত্যিই তা-ই হলে গল্পটা জমত। তবে আসল ঘটনা হলো, ওই তরুণ ছুটিতে ঘুরতে বেরিয়েছেন। শুরু করেছেন চীন দিয়ে। এরপর সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া হয়ে এসেছেন নিউজিল্যান্ডে। এখান থেকে যাবেন মালয়েশিয়ায়। এবারের বিশ্বভ্রমণ আপাতত সেখানেই শেষ করে ফিরে যাবেন জার্মানিতে। হ্যামিল্টন তাঁর সফরসূচিতে ছিল না। অকল্যান্ডেই তিন দিন থাকবেন বলে এসেছিলেন। এত কাছে বাংলাদেশ খেলছে জেনে কাল সকালেই চলে এসেছেন এখানে। দেশে থাকতে নিজে টুকটাক খেলতেন, এখনো ক্রিকেটের খোঁজখবর ভালোই রাখেন। এই ক্রিকেটপ্রেম যে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, সেটি বুঝতে পারলাম তাঁর নামটা শুনেই। ভুল বলা হলো। নাম শুনেই বুঝতেই পারিনি। ‘নাম কী আপনার’—প্রশ্নের জবাবে ‘তসলিম আরিফ’ শুনে বললাম, ‘এই নামে পাকিস্তানের একজন উইকেটকিপার ছিলেন। বেশি টেস্ট খেলেননি, তবে টেস্টে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন টেস্টে একটা ডাবল সেঞ্চুরি করে। অনেক বছর সেটি কোনো উইকেটকিপারের সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোরের রেকর্ড হয়ে ছিল।’ একটু বেশি জ্ঞান দিয়ে ফেলছি ভেবে থেমে গেলাম। ওই তরুণ পুরোটা শুনে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘আমি এত কিছু জানি না। তবে পাকিস্তানের ওই তসলিম আরিফের নামেই আমার নাম। নামটা রেখেছেন আমার বাবা, উনি পাকিস্তান আমলের মানুষ তো।’

পিটারের জার্সির পেছনে নামটা লেখা বাংলায়। ছবি: উৎপল শুভ্র

সেডন পার্কে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে থাকা ভদ্রলোকের ঘটনা তা নয়। ‘আপনি বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলা দেখছেন, ঘটনা কী’ প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম, ‘আমি বাংলাদেশি মেয়েকে বিয়ে করেছি।’ সেই ‘বাংলাদেশি মেয়ে’ মাঠে আসেননি। দ্বিতীয় দিন আসবেন। স্ত্রীর সূত্রেই বাংলাদেশে সমর্থক হয়ে গেছেন পিটার সিম্পসন। তা স্ত্রী বাংলাদেশি বলেই কিউই হয়েও বাংলাদেশকে সমর্থন করতে হবে? পিটার সংশোধন করে দিলেন, ‘আমি কিউই নই। আমি ইংলিশ। তেরো বছর আগে চাকরি নিয়ে হ্যামিল্টনে আসার পর ভালো লেগে যাওয়ায় এখানেই থেকে গেছি।’জার্মানিপ্রবাসী তরুণের খেলা দেখতে আসাতেই চমকিত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান ছিল। তসলিম আরিফ নামকরণের রহস্য জেনে সেটি আরেকটু বাড়ল। কিন্তু এরপর যেটা হলো, সেটিকে শুধু চমক বললে হচ্ছে না, বলতে হচ্ছে বিষম চমক। ওই তরুণের পেছনেই ফোল্ডিং চেয়ারে বসে খেলা দেখছেন মধ্যবয়সী এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। গায়ে বাংলাদেশের ওয়ানডে জার্সি। এটা দেখেও খুব বেশি চমকাইনি। অন্য দেশের অনেক মানুষকেই আমি বাংলাদেশের জার্সি পরতে দেখেছি। সবচেয়ে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল ২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপে। কোলনে কোনো একটা ম্যাচ কাভার করে বেরিয়েছি, সাদা ধবধবে নাদুসনুদুস এক তরুণকে দেখে রীতিমতো চমকে গেলাম। চমকে গেলাম তাঁর গায়ে পোশাকটা দেখে। বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশের ক্রিকেট জার্সি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক বিদেশি তরুণ! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, রিচার্ড স্নত নামের ওই তরুণ ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে কিচ্ছু জানেন না। তাহলে গায়ে বাংলাদেশের জার্সির রহস্য কী? জিজ্ঞেস করে যা জেনেছিলাম, নানা দেশের, নানা স্পোর্টস টিমের জার্সি সংগ্রহ করাটা তাঁর নেশা। ইংল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে বাংলাদেশের ২০০৩ বিশ্বকাপের ওই জার্সিটি ভালো লেগে গেছে বলে কিনে ফেলেছেন।

সেডন পার্কের গ্যালারিতে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে পিটার সিম্পসন। ছবি: উৎপল শুভ্র

আদি ঠিকানা ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম। বাংলাদেশি মেয়ের সঙ্গে পরিচয়ও সেখানেই। বিয়ে করেছেন ২৫ বছর হয়ে গেল। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার। স্ত্রী বাংলাদেশে নিয়মিতই আসা-যাওয়া করেন। তাঁর সঙ্গে পিটারও গেছেন একবার। ১৯৯৬ সালে কোথায় কোথায় গেছেন, সেটি জানালেন একটু বিচিত্র উচ্চারণে—ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী...। স্ত্রীর গ্রামের নামটা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। তবে সগর্বে জানালেন, ওয়ানডে জার্সি পরে টেস্ট দেখতে এলেও বাংলাদেশের একটা টেস্ট জার্সিও আছে তাঁর। দ্বিতীয় দিন সেটাই পরে আসবেন। জার্সির পেছন কী লেখা, সেটি দেখতে গিয়ে আরেকবার চমকে গেলাম। তাঁর নামই লেখা। তবে সেটি বাংলায়!

পিটার সিম্পসন সোৎসাহে জানালেন, বাংলাদেশের খেলা দেখে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নর্দাম্পটনে। ‘আমরা দল বেঁধে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। কল্পনাও করিনি, বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারিয়ে দেবে। ইউটিউবে ওই খেলার হাইলাইটস দেখলে গ্যালারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যে পতাকাটা দেখতে পাবেন, সেটি আমরাই নিয়ে গিয়েছিলাম’—বলার সময় তাঁর চোখে-মুখে যে আনন্দ, তাতে কে বলবে পিটার সিম্পসন ‘বাংলাদেশি’ নন, নিউজিল্যান্ডপ্রবাসী এক ইংরেজ!