আতহার আলী খান ধারাভাষ্য দেন। ম্যাচজুড়ে ক্রিকেটের নান্দীপাঠ শেষে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে ম্যাচসেরার সাক্ষাৎকার নেন। তবে আতহার নিজেই একবার ওই মঞ্চে সঞ্চালকের মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হয়ে কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচসেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।
ম্যাচটি ছিল ১৯৯০-৯১ চতুর্থ এশিয়া কাপ ক্রিকেটে। লিগ ম্যাচ, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে গিয়েছিল ৭১ রানে। কিন্তু পরাজিত দলে থেকেও অপরাজিত ৭৮ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস আতহারকে এনে দিয়েছিল ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার।
১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ম্যাচ। ক্রিকেটের অতি প্রিয় এই স্টেডিয়াম পৌষের রোদমাখা সুন্দর এক সকালের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সকালজুড়েই কুয়াশা আর কুয়াশা। রোদ উঁকি দেয় দেরিতে, ততক্ষণে ম্যাচটি সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, ৫০ ওভারের বদলে দাঁড়িয়েছে ৪৫ ওভারে। টস জিতে ব্যাটিং নেয় শ্রীলঙ্কা। মিনহাজুল আবেদীনের বাংলাদেশ বোলিংয়ে ভালোই করেছিল শুরুতে। একসময় শ্রীলঙ্কার স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ৮৭। এখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ায় অর্জুনা রানাতুঙ্গার দল। অরবিন্দ ডি সিলভাকে নিয়ে চতুর্থ উইকেটে ১৩৯ রান যোগ করেন রানাতুঙ্গা। ৬০ বলে ৮৯ রান করেন ডি সিলভা, শ্রীলঙ্কা ৪ উইকেটে ২৪৯। জবাবে তখন পর্যন্ত নিজেদের ইতিহাসের দুটি ব্যাটিং রেকর্ড গড়েও বড় পরাজয় এড়াতে পারেনি বাংলাদেশ। প্রথম রেকর্ডটি এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের সর্বোচ্চ দলীয় রান (১৭৮ /৯)। এর আগের সর্বোচ্চ ছিল ১৭৭ রান, আগের মৌসুমেই যা করা গিয়েছিল অস্ট্রেলেশিয়া কাপে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। দ্বিতীয় রেকর্ড সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান, আতহারের ওই অপরাজিত ৭৮।
২৭ বছর আগের কথা। তারপরও যে দিন গেছে তা একেবারেই যায়নি। আতহারের বরং মনে হয় এই তো চোখের সামনে ঘটছে সব আর তিনি আছেন ঘটনার বড় অংশজুড়ে। শ্রেণিমর্যাদায় পিছিয়ে থাকা এই ম্যাচটি দেখতেও কুয়াশামাখা সকালে হাজার দশেক দর্শক। চার নম্বরে ব্যাট করতে নামা আতহার প্রথম বলটি ঠেকিয়ে দেন। দ্বিতীয় বলটিই লাগে ব্যাটের মাঝখানে। একজন ব্যাটসম্যানের কাছে মাঝ ব্যাটে বল লাগার শব্দটি বড় মধুর। আতহার ভাবলেন, হয়তো ভালো কিছুই হবে। বাঁহাতি স্পিনার সনাৎ জয়াসুরিয়ার একটি বল পুশ করতে গিয়ে উঠে গেল। উঠবি তো ওঠ, একবারে সীমানা ছাড়া-ছয়! আতহারের কানে এখনো যেন করতালির মিষ্টি সুর তোলে সেই ছক্কা, ‘বলটা উঠে গেলে ভেবেছি নির্ঘাত ক্যাচ নিচ্ছে কেউ। পরে দেখি ছয়। গ্যালারিতে উল্লাস। এর পরই মনে হলো দিনটি আমার।’ ম্যাচের শেষ বলটি পর্যন্ত টিকে ছিলেন আতহার, ৯৫ বলের ইনিংসে আরও দুটি ছয়ের সঙ্গে মেরেছিলেন ছয়টি চারও। জয়াসুরিয়ার সঙ্গে আরেক বাঁহাতি স্পিনার ডান অনুরাসিরির বোলিংকেই সেদিন বেশি ‘ভালোবেসে’ ফেলেছিল তাঁর ব্যাট। কিন্তু পরাজিত দলের হয়ে বীরত্বব্যঞ্জক ব্যাটিং ছাড়া আর কিছু তো এটি ছিল না। আতহার বিস্মিত হলেন পুরস্কার বিতরণী পর্বে সঞ্চালকের ঘোষণায়। তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ, বিচারকেরা তাঁকেই বেছে নিয়েছেন ম্যাচের সেরা!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ম্যাচসেরার পুরস্কার, আতহারের কাছে এটি সব সময়ই আনন্দময় অনুভূতি। তবে একটি মন কেমন করা উপলব্ধিও সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে ঘোরে। ম্যাচটি যদি জিততে পারত বাংলাদেশ!
এরও আট বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে সেই জয়টি
আসে কেনিয়ার বিপক্ষে, হায়দরাবাদে। আতহারের তৃপ্তি, ওই জয়ে কিঞ্চিৎ ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। বাংলাদেশের ৬ উইকেটের জয়ে তাঁর অবদান ৪৭ রান। ম্যান অব দ্য ম্যাচ মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে তাঁর ওপেনিং জুটিটি ছিল ১৩৭ রানের।
যে ব্যাটে খেলে ইডেন গার্ডেনে ৭৮ রান করেছিলেন, পাওয়ার কোম্পানির সেই ব্যাটখানা শোকেসে সাজিয়ে রেখেছেন আতহার। সারা জীবন ওটা শোকেসেই থাকবে। প্রজন্মান্তরে জানান দেবে তাঁর ক্রিকেট-কীর্তি। ওটাই বলবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের একটি ‘প্রথম’ এনেছিলেন তিনি। টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে বাংলাদেশের হয়ে এ পর্যন্ত ৪৪ জন জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। সেই ৪৪ জনের মিছিলের প্রথম মুখটা আতহার আলীর। এখানেই যেন আরেকটু দুঃখ তাঁকে ছুঁয়ে যায়। বাংলাদেশ তখন বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেত না। পেলে আরও কিছু স্মারক জমতে পারত তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। ১০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ১৯ টি!
ম্যাচসেরা হিসেবে নগদ অর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন ১০ হাজার রুপি। কিন্তু টাকার চেয়েও দামি হলো শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক। জেনে আশ্চর্য হতে হয়, আতহারের কাছে ওই পুরস্কারের স্মারক কোনো ট্রফি নেই! আয়োজকেরা বলেছিলেন, ট্রফিটা পরে দেওয়া হবে। পরে আর পাওয়া যায়নি। ২৭ বছর আগের সেই এশিয়া কাপের স্মৃতির সরণি বেয়ে আতহার বলছিলেন, ‘ম্যাচ-ট্যাচ শেষ করে আমরা কলকাতা থেকে ঢাকামুখী বিমানে উঠে বসার পর আমাদের ম্যানেজার তানভীর হায়দার ভাইকে (প্রয়াত) জিজ্ঞেস করলাম, ট্রফিটা এনেছেন? উনি অবাক হয়ে বললেন, ওরা (আয়োজকেরা) কোনো ট্রফি দেয়নি তো!’ দলীয় ম্যানেজারের উত্তর শুনে আতহারের মুখে আর কোনো কথা জোগায়নি। বুক ফুঁড়ে বেরিয়েছিল একটি দীর্ঘশ্বাস।
আতহার এখন তাঁর ঘরে শোকেসের দিকে তাকান। ঘরোয়া ক্রিকেটের কিছু ট্রফি সেখানে আছে। এক কোণে বিশেষ একটি জায়গা নিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা ম্যাচের সেই ব্যাটখানা। কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ম্যাচসেরা হওয়ার স্বীকৃতির কোনো স্মারক নেই। একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে দীর্ঘশ্বাস পড়ে আরেকটি। এক দশকের ক্যারিয়ারে দশ দুগুণে ২০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলতে পারেননি। তবে দুটি দীর্ঘশ্বাসই আবার একটি ভালো লাগা অনুভূতির মধ্যে হারিয়ে যায়। এখনো ক্রিকেটের সঙ্গে আছেন। বাংলাদেশ দলের সঙ্গেই আছেন। যদিও ২০০০ সাল থেকে ভূমিকা বদলেছে। মাঠ ছেড়ে, ড্রেসিংরুম ছেড়ে জায়গা হয়েছে কাচঘেরা ধারাভাষ্যকক্ষে।