টেস্ট ক্রিকেটে পেসারদের সফল হওয়ার মূল সূত্র অবশ্যই অ্যাকুরেসি বা আঁটসাঁট বোলিং। ঠিক লাইন-লেংথে বোলিং করেই নিতে হয় ব্যাটসম্যানদের দক্ষতার পরীক্ষা। কিন্তু কজন পেসার ধারাবাহিক নিয়ন্ত্রিত বোলিং করতে পারেন? ২০০৬ সাল থেকে টেস্টে অন্তত ১০০০ বল করেছেন এমন পেসারদের মধ্যে আঁটসাঁট বোলিংয়ে সেরা ১০ বোলারের মধ্যে সবার ওপরে আছেন মোহাম্মদ আব্বাস।
আব্বাসের অভিষেক ২০১৭ সালের এপ্রিলে। ৩০ বছর বয়সী পাকিস্তানি পেসার এ সময়ে খেলেছেন ২০ টেস্টে। এ সময়েই প্রমাণ করেছেন, ধারাবাহিক জায়গায় বোলিংয়ে তিনি কতটা দক্ষ। ‘গুড জোন’ বা ভালো জায়গায় বোলিং করার হার ৪৮.৫ শতাংশ। ২০ টেস্টে পেয়েছেন ৮০ উইকেট। প্রতিটি উইকেট পেতে তাঁকে খরচ করতে হয়েছে মাত্র ২০.৬৭ রান। তাঁর প্রায় ৮২ শতাংশ বলেই ব্যাটসম্যানরা রান নিতে পারেননি, ডট দিয়েছেন। বলে আহামরি গতি নেই, বোলিং করেন ঘণ্টায় গড়ে ১২৬.৭ কিলোমিটার গতিতে। আব্বাসের সাফল্যের মন্ত্র দুর্দান্ত অ্যাকুরেসি।
গত ১৪ বছরে নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সেরা দশে আব্বাসের সঙ্গে আছেন কাইল অ্যাবট, গ্লেন ম্যাকগ্রা, মোহাম্মদ আসিফ, জশ হ্যাজলউড, ভারনন ফিল্যান্ডার, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস, ভুবনেশ্বর কুমার, জ্যাকসন বার্ড ও যশপ্রীত বুমরা। অ্যাবটের ৪৬.৬ শতাংশ বলই ভালো জায়গায় পড়েছে। ডেল স্টেইন, ফিল্যান্ডার, মরকেল আর রাবাদা থাকায় এ নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের গুণটা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারেননি অ্যাবট। পরে তো কোল প্যাক চুক্তিতে চলে গেলেন। অ্যাকুরেসিতে গ্লেন ম্যাকগ্রাকে তিনে দেখে একটু অবাক হতে হবে! যেহেতু ২০০৬ সালের পর থেকে হিসাব করা হচ্ছে, টেস্টে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফাস্ট বোলারের মাত্র ৬টি টেস্টের হিসাব নেওয়া হয়েছে। ক্যারিয়ারের শেষ দিকের (২০০৬-০৭) যে ৬ টেস্টের হিসাব করা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে তাঁর ৪৫.৩ শতাংশ ডেলিভারিই ছিল গুড জোনে। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে বয়সের কোনো ছাপ পড়েনি তাঁর পারফরম্যান্স। ক্যারিয়ারজুড়ে তাঁর খ্যাতি ছিল ধারাবাহিক নিখুঁত লাইন-লেংথে বোলিং করে যাওয়া, শেষ পর্যন্ত সুনামটা ধরে রেখেছেন ১২৪ টেস্টে ৫৬৩ উইকেট পাওয়া অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তি। উইকেট থেকে বাড়তি বাউন্সের সঙ্গে বল মুভমেন্টের দক্ষতা তিনি সব সময়ই ছিলেন অনন্য। শেষ দিকের ৬ টেস্টে গড়ে ০.৬৮ ডিগ্রি বল মুভও করিয়েছেন।
এ তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো পেসার। তবে একটি জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায় মোস্তাফিজুর রহমানের নাম। ২০০৬ সালের পর অন্তত ১০০০ বল করেছেন এমন পেসারদের মধ্যে গড়ে সবচেয়ে বেশি মুভমেন্ট পেয়েছেন পল কলিংউড—০.৮৮ ডিগ্রি। কলিংউডের পরই আছেন মোস্তাফিজ। বাঁহাতি পেসার সিম মুভ করিয়েছেন গড়ে ০.৭৩ ডিগ্রি। এখানে তিনি পেছনে ফেলেছেন ম্যাকগ্রা (০.৬৮ ডিগ্রি) ও মাখায় এনটিনির (০.৬৮ ডিগ্রি) মতো কিংবদন্তিতুল্য পেসারদের। মোস্তাফিজ বেশির ভাগ টেস্ট খেলেছেন দেশের উইকেটে, যেখানে সাধারণত স্পিনারদের ছড়ি ঘোরাতে দেখা যায়।
সিম মুভমেন্টের এ পরিসংখ্যানে মোস্তাফিজের অবস্থান দেখে দীর্ঘশ্বাসই বাড়বে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। উইকেট থেকে বল ডানে-বাঁয়ের দক্ষতায় মোস্তাফিজ বেশ এগিয়ে থাকার পরও তাঁর সমসাময়িক কিংবা পরে কাগিসো রাবাদা, আব্বাস, শাহিন আফ্রিদিদের চেয়ে কত পিছিয়ে পড়েছেন! অথচ বাঁহাতি পেসারের টেস্টের শুরুটাও হয়েছিল অসাধারণ। মোস্তাফিজের পরে টেস্ট আঙিনায় আসা রাবাদা ৪৩ ম্যাচে নিয়েছেন ১৯৩ উইকেট। আব্বাসের কথা তো বলাই হলো।
গত পাঁচ বছরে সাদা বলের মতো লাল বলেও যদি নিয়মিত হতেন মোস্তাফিজের পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই ১৩ টেস্টে ২৮ উইকেটে আটকে থাকত না! কেন টেস্টে নিয়মিত নন, এ প্রশ্নটা নিয়মিতই শুনতে হয় বাঁহাতি পেসারকে। মোস্তাফিজ বলছেন, ভবিষ্যতে যেন এই প্রশ্নটা বেশি না শুনতে হয় সেই চেষ্টাই করছেন তিনি, ‘আমি নিয়মিত হতে পারিনি, সেটার পেছনে কিছু কারণ ছিল। তার মধ্যে ফিটনেস একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তবে এখন আমি টেস্টে বেশি মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। সামনে যদি সুযোগ পাই এবং ইনিংসে ৪-৫ উইকেট পেয়ে গেলে আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
টেস্টে নিয়মিত হতে গত ফেব্রুয়ারিতে মোস্তাফিজ পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসনের অধীনে বল ভেতরে আনার টেকনিক নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। করোনার কারণে সেই অনুশীলনটা থেমে গেছে তাঁর। করোনাবিরতি শেষে গিবসন ঢাকায় এলে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে মোস্তাফিজকে। ২৪ বছর বয়সী পেসার বলছেন, ‘অনুশীলনটা চালু থাকলে আমার জন্য খুব ভালো হতো। বলটা ভেতরে আনার কাজ বেশ রপ্ত করেছিলাম। কিন্তু সব তো থেমে গেল করোনায়। আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। তিন-চার মাস আলাদা কাজ করতে হবে। তবে ওখানে থেমে না গেলে অনেকটা এগিয়ে যেতাম।’
বিষয়টা অনেকটা তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের মতোই। শুরুটা এত ভালো, সেই অগ্রযাত্রা থেমে না গেলে আজ কি আব্বাস-রাবাদার চেয়ে এত পিছিয়ে থাকতেন!