শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২১। ক্রীড়াঙ্গনে কেমন গেল বিদায়ী বছরটা? পেছন ফিরে তাকালে উঠে আসে হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কত উপাখ্যান! সেসব নিয়েই ধারাবাহিক এই বর্ষপরিক্রমা। দ্বিতীয় পর্বে আজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
দাপট—প্রতিপক্ষকে ক্রমাগত গুঁড়িয়ে দিয়ে পাওয়া সাফল্য। প্রত্যাবর্তন—হিসাবের বাইরে থাকা, খরচের খাতায় পড়ে যাওয়া কারও ঘুরে দাঁড়ানো। ক্রিকেট কেন, যেকোনো খেলাতেই গল্পের বড় একটা রসদ জোগায় এসব। সঙ্গে থাকে দায়মোচন আর বৃত্তপূরণ। এরপর আসে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গল্প—যখন ‘নাইস গাই’রাও ‘ফার্স্ট’ হন। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখেছে সবই।
গত বছরের শেষে বিরাট কোহলি যখন সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ তিন টেস্ট থেকে ছুটি নিলেন, ‘ডাউন আন্ডার’–এর সংবাদপত্র আর সম্প্রচার চ্যানেলের ভাষা ছিল এমন—কোহলিকে যা দেখার, তা সীমিত ওভারের সিরিজের পর অ্যাডিলেডেই দেখে নাও। অথচ অ্যাডিলেডে ৩৬-এর বুলডোজারে চূর্ণ হলো ভারত।
সেই কোহলির অনুপস্থিতিতেই অজিঙ্কা রাহানে, ঋষভ পন্ত, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, মোহাম্মদ সিরাজরা জয় করলেন মেলবোর্ন, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে তৈরি করলেন ভয়ংকর সুন্দর এক সিম্ফোনি, এ বছরের শুরুতে হানা দিলেন অস্ট্রেলিয়ার ‘গ্যাবা-দুর্গে’। কোহলি কি তখন জানতেন, বছর শেষে ভারত ক্রিকেটে তাঁর ‘দুর্গ’টাও নড়বড়ে হয়ে পড়বে?
আর ব্যাপারটা যখন টেস্ট ক্রিকেট, সীমিত ওভারে সাদা বল আর রঙিন পোশাকের রোশনাই তখন কদিন পরপরই যেন ঝলসে দিতে চায় শত বছরের পুরোনো দুর্গটা! এরপরই আসে ভারতের ওই অস্ট্রেলিয়া সফর।
আসে সাউদাম্পটন—একঘেয়ে বৃষ্টিভেজা ইংলিশ আবহাওয়া, অপেক্ষা, ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা পেরিয়ে আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনাল হুট করেই খুলে দেয় রোমাঞ্চের গিফট-বক্স—দেড় শ বছর ধরেই যেমনটা করে এসেছে টেস্ট ক্রিকেট।
২০২১ তো টেস্ট ক্রিকেটের নতুন ইতিহাসেরও। এবারই যে এ সংস্করণ অবশেষে দেখেছে বৈশ্বিক কোনো চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল! ২০১৫ ওয়ানডে, ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের হৃদয়ভঙ্গের বেদনায় পোড়া কেইন উইলিয়ামসনদের হাতে অবশেষে উঠেছে একটা ‘শিরোপা’, গদা হাতে তাঁদের ছবিটা আপনাকে বলবে—মাঝেমধ্যে ‘ফার্স্ট’ হন ‘নাইস গাই’রাও!
করোনাভাইরাসের তোপে ভারত যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে যেতে বাধ্য হলো মরুর দেশে, টুর্নামেন্টের আগে হট ফেবারিট ছিল তারাই। কোহলির এ সংস্করণের অধিনায়কত্বকে বিদায় বলার ঘোষণা যেন তৈরি করেছিল নতুন এক মঞ্চ।
তবে সে মঞ্চে দাঁড়িয়ে শাহিন শাহ আফ্রিদির ফ্রন্ট ক্যামেরায় আসিফ আলী, বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ানরা ধরা পড়লেন বিজয়-সেলফিতে। কিছুটা নিভৃতেই ব্যাক ক্যামেরায় ঠিক ধরা পড়ল না যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের টি-টোয়েন্টি সাম্রাজ্যের ধসটা!
নামিবিয়া মনে করাল প্রায় বিস্মৃত সহযোগী দেশের বিশ্বকাপ-রোমাঞ্চ। এউইন মরগানের ইংল্যান্ডের সীমিত ওভারের ‘ডাবল’-স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিল ওই কিউই ‘নাইস গাই’রা, উইলিয়ামসনদের সামনে যে তখন এক বছরে দুটি আইসিসি শিরোপা জয়ের হাতছানি!
তখন কে জানত, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক, জর্জ বেইলি, স্টিভেন স্মিথদের বুকের ভারটা বয়ে এনে মরুর বুকে কবর দেবেন অ্যারন ফিঞ্চ! আইপিএলে ব্রাত্য হয়ে পড়া ডেভিড ওয়ার্নার দেখাবেন ক্রিকেটীয় টিকটকের নতুন রোমাঞ্চ—যা শুধুই ক্ষণিকের বিনোদন নয়। ম্যাথু ওয়েডের ‘শেষ করা’ মনে করিয়ে দেবে, অস্ট্রেলিয়া শেষের আগে থামে না।
সেমিফাইনালে যাওয়ার পর থেকেই ফিঞ্চ বলছিলেন, তাঁদের হিসাবের বাইরে রেখেছেন সবাই। তাঁর দল দেখাল, আর যাকেই হোক না কেন, অন্তত অস্ট্রেলিয়াকে কোনো ‘বিশ্বকাপে’ হিসাবের বাইরে রাখতে নেই।
এই যে হিসাব-নিকাশ, সেটাও তো পাল্টাতে পারে কত দ্রুতই! আজিম রফিকের বর্ণবাদের অভিযোগ যখন একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে ইংলিশ ক্রিকেটকে, অ্যাশেজের আগে অস্ট্রেলিয়া হুট করেই টালমাটাল হয়ে পড়ল টিম পেইনের খুদে বার্তার বৃহৎ কেলেঙ্কারিতে। অধিনায়কত্ব হারানো পেইন মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে সরে গেলেন, অস্ট্রেলিয়া আবার দেখল কোনো পেসার অধিনায়ক।
সেই প্যাট কামিন্স আবার ছিটকে গেলেন দ্বিতীয় টেস্ট থেকে। অধিনায়কত্বের ভার গেল স্টিভ স্মিথের ওপর, যাঁর বল-টেম্পারিং কাণ্ডের পর দায়িত্ব পেয়েছিলেন পেইন! এই যে চক্রপূরণের ডামাডোল, এর মাঝেও থামল না অস্ট্রেলিয়া। তাদের সামনে পড়ে স্বপ্নের মতো বছর কাটানো ব্যাটসম্যান জো রুটও প্রথম দুই টেস্টে আটকাতে পারেননি অধিনায়ক রুটের ইংল্যান্ডের দুঃস্বপ্ন।
রিজওয়ানের টি-টোয়েন্টিতে এক পঞ্জিকাবর্ষে রেকর্ড-রানের বছরে রুট শেষ পর্যন্ত রেকর্ডটা গড়তে পারলে হবে নাটকীয় কিছু। বছর শেষে মেলবোর্নে রুট তাই লড়ছেন কিসের যেন আশায়, সেঞ্চুরিয়নে হয়তো কোহলি-যুগেরও নতুন মোড়ের শুরুটা হয়ে গেছে।
দাপট, প্রত্যাবর্তন, চক্রপূরণ বা দায়মোচনের মোড়কে গল্প তো হাজির হয় নাটকীয়তা নিয়েই—প্রায় পেরিয়ে যাওয়া বছরের শেষ কয়েকটা দিন দেখালেও দেখাতে পারে অমন কিছু। প্রস্তুত থাকুন, এবার না হলেও পরের বছরটা তো আছেই।
এজাজ প্যাটেলের জন্মের সময় শহরটার নাম ছিল বোম্বে। সেটা মুম্বাই হয়েছে, ভাগ্যবদলের দায় মেটাতে মা–বাবার সঙ্গে প্যাটেলকে পাড়ি জমাতে হয়েছে নিউজিল্যান্ডে। সেই মুম্বাইয়ে এসেই প্যাটেল গড়লেন অবিস্মরণীয় কীর্তি—সময়ের হিসাবে এক ইনিংসে ১০ উইকেটের যে কীর্তি ক্রিকেট দেখেছে ৭৯, ৪৩ ও ২২ বছর ব্যবধানে!
অথচ সেই এজাজ প্যাটেলই নেই নিউজিল্যান্ডের ঠিক পরের টেস্টের দলেই। দেশের মাটিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশেষজ্ঞ স্পিনারই রাখেনি কিউইরা।
নিউজিল্যান্ডে স্পিন-পতাকা উঁচিয়ে ধরার লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্যাটেল। তবে এর আগে ২০২১-এর ডিসেম্বর তাঁকে দিয়েছে দুই রকমের অনুভূতিই!