অনেক 'প্রথম'-এর এক শহর

ডানেডিনের ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠ। আর দশটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মতো নয়—
ডানেডিনের ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠ। আর দশটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মতো নয়—

প্রথম দর্শনে প্রেম বলতে যা বোঝায়, ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠটার সঙ্গে আমার তা-ই হয়ে গিয়েছিল। সেই প্রথম দেখা ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। এই মাঠে প্রথম টেস্ট ম্যাচ। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে দক্ষিণের শহরের জন্য উদযাপনের একটা বিরাট উপলক্ষ। নতুন ইতিহাসও। বাংলাদেশ সেই ইতিহাসের অংশীদার। এই মাঠের ইতিহাসে তাই লেখা আছে বাংলাদেশের নামও। আশ্চর্যই বলতে হবে, দুই বছর পর এই মাঠে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের একটি দলও বাংলাদেশ!

সেই দুটি ম্যাচই কাভার করেছি বলে ইউনিভার্সিটি ওভাল আমার চেনা মাঠ, এবার যেটির সঙ্গে তৃতীয়বারের মতো দেখা। যেকোনো মাঠ প্রথম দেখার মধ্যে যে একটা রোমাঞ্চ আছে, সেটি তাই এবার থাকবে না, খুবই স্বাভাবিক। আজ দুপুরে আবারও এই মাঠে গিয়ে যেটিতে আক্রান্ত হলাম, সেটি রোমাঞ্চ নয়—নস্টালজিয়া। মাঠটা এগারো বছর আগে প্রথম যেমন দেখেছিলাম, তেমনই আছে। সেই ছোট্ট ড্রেসিংরুম। তার পাশেই মেম্বারস্ স্ট্যান্ড। বড় স্থাপনা বলতে এটিই। সেখান থেকে মাঠের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডান পাশে পাইনগাছের সারি। পৃথিবীর বিখ্যাত সব ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না এবং ইউনিভার্সিটি ওভালকে এত পছন্দ করার কারণও এটাই। সবকিছুতে একটা শান্ত সমাহিত ভাব, এক টানে যা নিয়ে যায় অতীতে। সেই সময়টায়, যখন খেলা হতো খেলার আনন্দে।

মেম্বারস্ স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মাঠের উল্টোদিকে ছোট্ট কাঠের দোতলাটা চোখে পড়ল। ছোট্ট একটা খোপমতো ঘরও। এটিকেই এখানে প্রেসবক্স বলা হয়। যেটি দেখা মাত্র জিহ্বায় চেরি ফলের একটু টক-টক স্বাদটা অনুভব করলাম। ২০০৮ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচের সময় সাংবাদিকদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা বুড়ো মানুষটা একটু পরপর প্লাস্টিকের ক্যান ভর্তি করে চেরি ফল এনে দিতেন। সেটি নিমেষেই শেষ হয়ে যেতে দেখে কপট বিরক্তি নিয়ে আবার নিয়ে আসতেন নতুন চালান। এই মাঠে প্রথম টেস্ট ম্যাচ নিয়ে খুব বড় কোনো আয়োজন কি হয়েছিল? মনে পড়ছে না। বোধ হয় হয়নি। হলে তো মনে থাকতই। যেমন মনে আছে ম্যাচের আগে ওই ব্যতিক্রমী সাংবাদিক বরণটা। টস হওয়ার আগে এই মাঠের কিউরেটর সব সাংবাদিককে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে উইকেট দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ইউনিভার্সিটি অব ওটাগো—নিউজিল্যান্ডের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শ বছর পূর্তি হলো এ বছর—ছবি: লেখক

‘ইউনিভার্সিটি ওভাল’ নামটাই বলে দিচ্ছে, এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ। একসময় মালিকানাটাও বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছিল। এখন এটির দায়িত্ব নিয়েছে ডানেডিন সিটি কাউন্সিল। বিশ্ববিদ্যালয়টা পাশেই। যেটির নাম ইউনিভার্সিটি অব ওটাগো। পড়াশোনার মানের দিক থেকেও যথেষ্টই নামডাক আছে। তবে একটা ঐতিহাসিক মর্যাদাই আলাদা করে দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। এটিই নিউজিল্যান্ডের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বাংলাদেশের ২০ জনের মতো ছাত্র। বেশির ভাগ ছাত্রই পিএইচডি করছেন। বাংলাদেশি শিক্ষকও আছেন। ছয় বছর আগে মেলবোর্নের মনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখানে যোগ দেওয়া ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষক ডক্টর শ্যামল নাথই আজ বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়টা ঘুরিয়ে দেখালেন। ২০০৮ সালে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি করতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ ফয়সাল হোসেন। ছাত্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরেছি, এবার শিক্ষকের সঙ্গেও। ষোলোকলা পূর্ণ হওয়া যাকে বলে।

দেড় শ বছরের ঐতিহ্য ফুটে বেরোচ্ছে ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোর ক্লক টাওয়ার থেকে—ছবি: লেখক

ইউনিভার্সিটি অব ওটাগোতে এখন উৎসবের আমেজ। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শ বছর পূর্তির উৎসব। এটির সগর্ব ঘোষণা দিয়ে ফেস্টুন উড়ছে লাইটপোস্টগুলোতে। বিদেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত চেহারার কোনো মিল নেই। এখানেও যথারীতি তাই। এটা আর্টস বিল্ডিং, এটা রিসার্চ সেন্টার—ডক্টর শ্যামল নাথ আঙুল দিয়ে যেগুলো দেখাচ্ছেন, আর দশটা বাণিজ্যিক ভবনের সঙ্গে সেগুলোর তেমন পার্থক্য নেই। দেড় শ বছরের ঐতিহ্যের ছোঁয়া কই? সেটি পাওয়া গেল ক্লক টাওয়ার বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে। গতবার দেখে থাকলেও মনে নেই। নাম থেকেই পরিষ্কার, ঘড়ির একটা ব্যাপার আছে এখানে। কালের চিহ্ন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের মতো ভবনটি থেকে একটা টাওয়ারের মতো উঠে গেছে। সেটিতেই একটা ঘড়ি। সামনের জায়গাটা এমন সুন্দর যে, চোখ জুড়িয়ে যায়। দুপাশের রাস্তা থেকে ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে ছোট-বড় পাথরের মাঝ দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলের ধারা দেখিয়ে শ্যামল নাথ বললেন, ‘এটা একটা নদী। নাম লিথ।’ আমি মজা করে বললাম, ‘বাংলাদেশ থেকে এসে এটিকে আপনি নদী বলছেন! আপনিও তো জানেন, বাংলাদেশে এটা খালের মর্যাদাও পাবে না।’

ইউনিভার্সিটি অব ওটাগো নিউজিল্যান্ডের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। নিউজিল্যান্ডে তা আলাদা মর্যাদা পেতে পারে, ডানেডিনে নয়। কারণ ডানেডিনে যে এমন ‘প্রথম’-এর ছড়াছড়ি! নিউজিল্যান্ডের অনেক কিছুই প্রথম হয়েছে একসময় সোনার খনির কল্যাণে এই দেশের ব্যস্ততম ও সবচেয়ে সম্পদশালী শহরে পরিণত হওয়া এই ডানেডিনে। প্রথম সংবাদপত্র বেরিয়েছে এখান থেকে। ১৮৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত সেই ওটাগো ডেইলি টাইমস টিকে আছে এখনো। নিউজিল্যান্ডে প্রথম গার্লস স্কুল এখানে, প্রথম চকলেট ফ্যাক্টরি (ক্যাডবেরি), প্রথম আর্ট গ্যালারি, প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন, প্রথম কেবল কার, প্রথম গ্যাসে জ্বালানো বাতি—এমন অসংখ্য ‘প্রথম’-এর গৌরব এই ডানেডিনের। এই দেশে টেলিফোনে প্রথম কলটাও করা হয়েছিল এখান থেকেই। এখন যা নিউজিল্যান্ডের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস, সেই হিমায়িত মাংস নিয়ে প্রথম জাহাজটাও ছেড়েছিল ডানেডিনের চামার্স বন্দর থেকে।

ডানেডিনের এত সব প্রথমের ভিড়ে বাংলাদেশও কি সুন্দর দুটি ‘প্রথম’-এর অংশ হয়ে গেছে! এই শহরে প্রথম টেস্ট ম্যাচ, প্রথম ওয়ানডে দুটিতেই বাংলাদেশ। সোনায় সোহাগা হতো যদি এখানেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়ের গল্পটাও লেখা হতো! আসলেই যদি তা হয়, ইউনিভার্সিটি ওভাল মাঠটা তখন নিশ্চয়ই আরও বেশি ভালো লাগবে।