অক্টাগন ও রবার্ট বার্নসের মূর্তি

ডানেডিনের প্রাণকেন্দ্র অক্টাগনে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নসের মূর্তি। সেটির মাথায় বসে আছে গাঙচিল—ছবি: লেখক
ডানেডিনের প্রাণকেন্দ্র অক্টাগনে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নসের মূর্তি। সেটির মাথায় বসে আছে গাঙচিল—ছবি: লেখক

ডানেডিন কিসের জন্য বিখ্যাত?
অনন্যতা বোঝাতে নিউজিল্যান্ডের প্রতিটি শহরেরই দ্বিতীয় একটি নাম আছে। অকল্যান্ডের নাম যেমন ‘বোটিং ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, কুইন্সটাউনের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। এর আগে অকল্যান্ডে তিন–চারবার আর কুইন্সটাউনে একবার গিয়ে এই দুই শহরের নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি। অকল্যান্ডে বাড়ির গ্যারেজে পাশাপাশি দেখেছি গাড়ি আর বোট।

এখন পর্যন্ত আমার দেখা সুন্দরতম শহর কুইন্সটাউনে দেখেছি রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের জন্য হাজারো আয়োজন। কেব্‌ল কারে চড়ে কয়েক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ে ওঠানামা যার মধ্যে নিরীহতম। এর বাইরেও কত কিছু—জেট বোটিং, রিফার রাফটিং, স্কাই ডাইভিং...। শরীরে রশি বেঁধে কয়েক শ ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ার ‘খেলা’ বানজি জাম্পিং প্রথম বাণিজ্যিকভাবে শুরুও কুইন্সটাউনে। এর মধ্যে শুধু কেবল কার আর জেট বোটিংয়ের অভিজ্ঞতাটা নেওয়ারই সাহস হয়েছিল আমার।

এর আগেও দুবার এসেছি বলে ডানেডিনের বিশেষত্বটাও আমার অজানা নয়। অকল্যান্ড যদি ‘বোটিং ক্যাপিটাল’ হয়, কুইন্সটাউন ‘অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল’—ডানেডিনের অন্য নাম ‘ক্যাপিটাল অব ওয়াইল্ড লাইফ’। আফ্রিকার অনেক শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টেকা যাবে না বুঝতে পেরেই এখানে আর ‘ওয়ার্ল্ড’ কথাটা যোগ করা হয়নি। আর ‘ওয়াইল্ড লাইফ’ বললেই আমাদের যেমন বাঘ–সিংহ–জেব্রা–জিরাফ মনে হয়, এখানে সেসব কিছু নেই। ‘সিংহ’ আছে, তবে তা সামুদ্র্রিক সিংহ! সি লায়ন বললেই যেটিকে চিনতে সুবিধা হয়। সিল আছে, অ্যালব্যাট্রস আছে, আর হলুদ চোখের পেঙ্গুইন নাকি আছে শুধু এখানেই। অ্যালব্যাট্রসকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে সাগরের মধ্যে ওটাগো পেনিনসুলায় সেটির জন্য একটা অভয়াশ্রমও আছে। ২০০৮ সালে বোটে ডানেডিন থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার দূরের ওই অভয়াশ্রম দেখে এসেছি।

অক্টাগনের সবুজ চত্বরে গাঙচিলের মেলা—ছবি: লেখক

ডানেডিন শহরের মধ্যে অবশ্যই দ্রষ্টব্য কিছুর কথা বলতে হলে প্রথমেই আসবে বল্ডউইন স্ট্রিট। এটির খ্যাতি বিশ্বের সবচেয়ে খাড়া রাস্তা হিসেবে। কতটা খাড়া, তা বোঝাতে প্রকৌশলবিদ্যার টার্ম ‘গ্র্যাডিয়েন্ট’ ব্যবহার করতে হয়। সহজ করে বোঝাতে বলি, প্রতি ২ দশমিক ৮৬ মিটারে রাস্তাটা এক মিটার উঁচু হয়ে গেছে। সেই রাস্তা বেয়ে ওপরে ওঠা বড় এক চ্যালেঞ্জ বলে পাশেই সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে। সেই সিঁড়ি ভাঙাও সহজ কম্মো নয়। ২০০৮ সালে ডানেডিনে প্রথমবার এসে রাস্তা আর সিঁড়ি মিলিয়েও ওপরে উঠতে হাঁসফাঁস অবস্থা হয়েছিল। নেমে আসার পর ছোট্ট স্যুভেনির শপটা থেকে একটা সার্টিফিকেটও পেয়েছিলাম। দিন–তারিখ উল্লেখ করে আমি যে বিশ্বের খাড়া রাস্তায় উঠেছি, সেটির স্বীকৃতি। সেটি অবশ্য বিনা মূল্যে মেলেনি। দুই ডলার দিয়ে কিনতে হয়েছিল।

অ্যালব্যাট্রসের অভয়াশ্রমে যাওয়ার পথে খোলা সাগরে উড্ডীন অ্যালব্যাট্রস দেখেছি, উঠেছি খাড়া রাস্তায়ও, বোটানিক্যাল গার্ডেন, পাহাড়ের ওপরে সিগন্যাল হিল নামে একটা চাতালমতো দাঁড়িয়ে পুরো ডানেডিন শহর—এবার তাহলে কী দেখি? আজ দুপুরে শহরে চক্কর দিতে দিতে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই কবিতার কথা মনে হলো। ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ই তো কত কিছু দেখার আছে। ডানেডিনে যে হোটেলে আছি, সেটি এক শ বছরের বেশি পুরোনো একটা হেরিটেজ টাইপ বাড়ি। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে ‘অক্টাগন’—যেটিকে বলতে পারেন ডানেডিন শহরের হৃদ্‌পিণ্ড। এর আগের দুবারও এখানে এসেছি বলে আবছা–আবছা মনে হলো, তবে এলেও খুব সময় নিয়ে বোধ হয় আসিনি। যে কারণে জায়গাটা একটু অচেনা এবং অনেক বেশি সুন্দর মনে হলো।

‘অক্টাগন’ নামটা থেকেই বুঝে নেওয়ার কথা, অষ্টভুজ জাতীয় কিছু একটা ব্যাপার আছে এখানে। অষ্টভুজ আকৃতির একটা চত্বর থেকেই এর নাম। ১৮৪৬ সালে নির্মিত যে চত্বর ক্রমেই আরও বড় হয়েছে। ঠিক মাঝখানে একটা মূর্তি। কাছে গিয়ে নামটা দেখলাম। সপ্তদশ শতাব্দীর স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস। তা স্কটিশ কবির ছবি এখানে কেন? ডানেডিনের ইতিহাস জানলে এই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে বলে দিতে হবে না। ডানেডিনের স্কটিশ কানেকশন অনেক পুরোনো। নিউজিল্যান্ডের এই একটা শহরই ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের মধ্যে স্কটিশদের অধিকারে ছিল। একসময় ডানেডিনের নামই ছিল নিউ এডিনবরা।

২০০৯ সালে স্কটল্যান্ডে এক জরিপে ‘সর্বকালের সেরা স্কট’ স্বীকৃতি পাওয়া রবার্ট বার্নসের মূর্তি আছে নিউইয়র্ক, ডান্ডি আর লন্ডন শহরেও। ডানেডিন শহরের কেন্দ্রস্থলে রবার্ট বার্নসের মূর্তি থাকার একমাত্র কারণ এই শহরের স্কটিশ কানেকশন নয়। রবার্ট বার্নসের ভাতিজা টমাস বার্নস ডানেডিন শহরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাহলে তো চাচার বদলে ভাতিজারই মূর্তি থাকা উচিত ছিল অথবা দুজনেরই। নেই কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম ইন্টারনেট ঘেঁটে। শহরের কোথাও ভাতিজারও একটা মূর্তি ছিল, কিন্তু টমাস বার্নস কোনো কারণে চরম অজনপ্রিয় হয়ে পড়ায় ১৯৪০–এর দশকে সেটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার টিম আর কলম্বিয়ার পলা—ছবি: লেখক

রবার্ট বার্নসের মূর্তিটার যে অবস্থা দেখলাম, তাতে অবশ্য মনে হলো, টমাস বার্নসের তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি। সামনের সবুজ ঘাসে ছাওয়া জায়গাটায় অনেকগুলো গাঙচিল। পালাক্রমে উড়ে গিয়ে সেগুলো রবার্ট বার্নসের মাথায় ওপর বসছে। মূর্তির গায়ে লম্বালম্বি অসংখ্য সাদা দাগ দেখে আগেই সন্দেহ হয়েছিল। ছবি তুলতে গিয়ে একটু জুম করেছিলাম বলে নিশ্চিত হওয়া গেল, আমার ধারণাই ঠিক। কবি ও কবিতার প্রতি চরম অশ্রদ্ধা দেখিয়ে রবার্ট বার্নসের মূর্তির মাথায় বসে থাকা গাঙচিলটা প্রাকৃতিক কর্মটা সেখানেই সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।

চারপাশে হাঁটাচলার জায়গা তো আছেই, চাইলে সবুজ ঘাসে বসে রোদও পোহাতে পারেন। সেখানে বসেই আলাপ হলো দুই তরুণ–তরুণীর সঙ্গে। পলা নামের মেয়েটা বেড়াতে এসেছে কলম্বিয়ার বোগোটা থেকে, অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে টিম নামের ছেলেটা। এখানে এসেই তাঁদের পরিচয়। ক্রীড়া সাংবাদিক হলে যা হয়, পলার দেশের নাম শুনেই আমার মনে পড়ে গেল কার্লোস ভালদেরামার কথা। পলা অবশ্যই ভালদেরামাকে চেনে, কিন্তু টিম চেনে না। টিম যেহেতু অস্ট্রেলিয়ান, তাঁর সঙ্গে আলাপের বিষয় অবধারিতভাবেই ক্রিকেট। দুদিন পর বাংলাদেশ এখানে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ওয়ানডে খেলছে শুনে সফরসূচিতে সেই ম্যাচটাও ঢুকিয়ে ফেলল। টিকিট চেয়ে ফেলে দিল একটু বিপদেও। কলম্বিয়ান পলা ক্রিকেট নামে কোনো খেলা আছে বলেই জানত না। জানার খুব একটা আগ্রহও নেই তাঁর। যে কারণে আমি টিকিটসংক্রান্ত ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলাম।

ক্রিকেট ছাড়াও টিমের আগ্রহ শিল্পকলায়, বিশেষ করে চিত্রকলায়। সে–ই সোৎসাহে জানাল, পাশেই পাবলিক আর্ট গ্যালারিতে ক্লদে মনের অরিজিনাল ছবি আছে। অক্টাগনে পাব–রেস্টুরেন্ট–চার্চ–সিনেমা হল এসব দেখতে পেয়েছি। আর্ট গ্যালারির কথা জানতামই না। সেটিতে ঢুকে ক্লদে মনের ‘লা ডিবেকল’ দেখতে দেখতে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম টিমকে। মুখেই তা দেব বলে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে আন্তমহাদেশীয় যুগলকে খুঁজলাম। তাদেরকে আর পেলাম না। একটু মরে আসা রোদে চারপাশ একটু অন্য রকম লাগছে। শুধু একটা জিনিসই বদলায়নি। রবার্ট বার্নসের মূর্তির মাথায় ঠিকই একটা গাঙচিল বসে আছে।